কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন বনাম গণমানুষের ক্ষোভ প্রকাশ ।
লিখেছেন লিখেছেন ছাগু ও পাকি বিরোধী ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৫:৩৭:০২ সকাল
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন
রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার পথে ‘বিজয়সূচক’ চিহ্ন দেখান কাদের মোল্লা। মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। সেই আলুব্দী গ্রামে কান্না ও ক্ষোভঃ দুপুর ১২টা। মাইক্রোবাসে চড়ে আলুব্দী গ্রামের বাজারে এসে নামেন স্থানীয় সাংসদ শাহেদা তারেখ ওরফে দীপ্তি ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক খন্দকার মকবুল হোসেন। তাঁরা খবর দেন, কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড হয়েছে। শোনার পর রাজধানীর পল্লবীর পার্শ্ববর্তী গ্রামটিতে যেন খুশির বন্যা বয়ে যায়। কারণ, কাদের মোল্লার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল এই গ্রামে যে গণহত্যা হয়েছিল, তাতে প্রায় প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ শহীদ হয়েছেন। ওই গণহত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে করা মামলার সাক্ষী শফিউদ্দিন মোল্লা ও আমির হোসেন মোল্লার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক।
কিন্তু সেখানে উপস্থিত এক গণমাধ্যমকর্মী মুঠোফোনে খবর নিয়ে জানালেন, ‘ফাঁসি নয়, কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।’ এ তথ্য শুনে মুহূর্তেই যেন বিষাদের ছায়া নেমে এল সেখানে। আমির হোসেন মোল্লার মুখে হাসিও নিমেষে মিলিয়ে গেল। চোয়াল শক্ত আর চোখের তারায় ক্রোধ জমা হতে লাগল তাঁর। একপর্যায়ে পানিতে ভরে গেল সে চোখ। টলমল পানি চোয়াল গড়িয়ে পড়ল একাত্তরে রক্তভেজা আলুব্দীর মাটিতে।কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে করা মামলার আরেকজন সাক্ষী আলুব্দী গ্রামের শফিউদ্দিন মোল্লা রায় সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হলেন না। রায় নিয়ে দেশবাসী তাঁর মত জানতে চায়—এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শফিউদ্দিন মোল্লার ক্রোধ আর কান্না যেন একাকার হয়ে গেল। বললেন, ‘সাড়ে তিন শ (৩৪৪ জন) মানুষ খুনের নেতৃত্ব যিনি দিয়েছেন, যাঁকে আমরা সবাই কসাই কাদের হিসেবে চিনি। তাঁর যদি ফাঁসি না হয় তাহলে ন্যায়বিচার আর কই হইল।’
কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে উত্তাল শাহবাগঃ মুখে আবেগভরা স্লোগান। হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি। তাঁরা সমবেত হয়েছিলেন রাজধানীতে আন্দোলন-কর্মসূচির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ মোড়ে। উদ্দেশ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ ও প্রতিবাদ।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেল থেকে হাজারো মানুষ শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন। চলে খণ্ড খণ্ড মিছিল। কেউ কেউ মিছিল করেন মশাল নিয়ে। সবার দাবি, যাবজ্জীবন নয়, কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে হবে।
বেলা তিনটায় শাহবাগ মোড়ে সমবেত হয়ে অবরোধ শুরু করে ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্ক নামের একটি সংগঠন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক ও টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সূত্রে জেনে ধীরে ধীরে আরও অনেকে সেখানে জমায়েত হতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ‘স্লোগান ৭১’ নামের আরেকটি সংগঠনও একই দাবিতে অবস্থান শুরু করলেও পরে শাহবাগের কর্মসূচিতে যোগ দেয়। সমবেত বিক্ষোভকারীরা কাদের মোল্লার ফাঁসি দাবি করে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন। ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের সংগঠক চিকিৎসক ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন নয়, ফাঁসি চাই আমরা। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে।’
সরকারও অখুশি, সংসদে ক্ষোভ জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ে খুশি হতে পারেনি সরকার ও আওয়ামী লীগ। সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক ও জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী এ রায়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন।
মহাজোটের শরিক দলের সাংসদেরাও গতকাল মঙ্গলবার সংসদে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা বলেন, এই রায়ে দেশের মানুষ হতাশ ও অপমানিত হয়েছে।
সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নীতিনির্ধারক, মন্ত্রী-সাংসদ রায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও প্রকাশ্যে কিছু বলতে রাজি হননি। গতকাল জাতীয় সংসদে মাগরিবের নামাজের বিরতির সময়ও দলীয় সাংসদেরা জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের ঘিরে ধরে তাঁদের হতাশা ও অসন্তুষ্টির কথা জানান।
গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের পর নানা মহলে আলোচনা হয়, সরকার ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে কোনো গোপন সমঝোতা হয়েছে কি না। বিশেষ করে গত দুই দিনে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির পুলিশের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে রাজপথে মিছিল-সমাবেশ করায় মানুষের মধ্যে এ সন্দেহ বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরাও বিভিন্ন মহল থেকে এ রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী প্রথম আলোকে জানান, তাঁর কাছে অন্তত ২০ জন সাংসদ রায়ের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
আরেকজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেন, ফেসবুকে তাঁর অনেক বন্ধু সরকার ও জামায়াতের মধ্যে সমঝোতার প্রশ্ন তুলেছেন। এ রকম প্রশ্নের মুখে একপর্যায়ে তিনি ফেসবুক বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। সরকারের সঙ্গে জামায়াতের কোনো অপসরফা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে সরকারের একজন নীতিনির্ধারক ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘কে সমঝোতা করল, তা আমরাও জানার চেষ্টা করছি।’
তবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে এ রকম সমঝোতার কথা নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, ‘ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও কেন সর্বোচ্চ শাস্তি হলো না, তা সম্পূর্ণ রায় না পড়ে বলা যাবে না।’
আওয়ামী লীগ ও এর শরিক দলগুলোও রায়ে খুশি হতে পারেনি। গতকাল ১৪ দলের বৈঠকে রায় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম সারির নেতার সঙ্গে কথা বললে এ রায় প্রত্যাশিত নয় বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।
রায়ে হতাশ কেরানীগঞ্জবাসীঃ ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর। ঢাকার কেরানীগঞ্জের ঘাটার চরে সেদিন ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত অন্তত ৬০ জনকে হত্যা করা হয়। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তাদের এ দেশীয় দোসররা নির্মম এই হত্যাযজ্ঞ চালায়।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যে ছয়টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়, ঘাটার চরের হত্যাযজ্ঞ সেগুলোর একটি। অভিযোগ অনুসারে, কাদের মোল্লা ও তাঁর সহযোগীরা এই হত্যাযজ্ঞ চালান। তাই এ মামলার রায় ঘোষণা উপলক্ষে প্রায় ৪২ বছর পর গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই ঘাটার চর (শহীদনগর) বাজারে মানুষের মধ্যে ছিল উত্তেজনা। সবার চোখ ছিল বাজারের দোকানে টেলিভিশনের পর্দায়। অপেক্ষা রায় শোনার।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে টেলিভিশনে তাঁরা দেখলেন, রায়ে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় ঘাটার চরের হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন। রায় শুনে হতাশ ও অখুশি হন সমবেত মানুষ। আটিবাজারে জনতা বিক্ষোভ মিছিলও করে।
সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী ও এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সপ্তম সাক্ষী আবদুল মজিদ পালোয়ান রায় শুনেই চলে যান ঘাটার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। সেখানে একটি নামফলকে ৫২ জনের নাম লেখা, যাঁরা সেদিন শহীদ হন। এরপর তিনি নিয়ে যান বিদ্যালয়ের সামান্য দূরে তাঁদের গণকবরে। বলেন, একাত্তরের ২৫ নভেম্বর ভোরে গোলাগুলির শব্দে ঘাটার চর স্কুলমাঠের কাছে গিয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখেন, পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে লোকজনকে হত্যা করছে। সেখানে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা কয়েকজনের মধ্যে থাকা কাদের মোল্লাও হাতে রাইফেল নিয়ে গুলি করেন। সেখানে হিন্দু-মুসলমান মিলিয়ে ৫৬ জন মারা যান। এরপর পাকিস্তানি সেনা ও কাদের মোল্লার বাহিনীর লোকেরা এলাকা ছেড়ে যায়। তিনি বলেন, ‘পরে আমি মরদেহগুলো তুলে গণকবর দিয়েছি। সেই হত্যার কি বিচার হবে না?’
আবদুল মজিদ বলেন, ‘আমি নিজে কাদের মোল্লার হাতে বন্দুক দেখেছি। ট্রাইব্যুনালে সবই বলেছি। তাহলে কেন তাঁকে এই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো?’
একাত্তরের ২৫ নভেম্বর শহীদ মাল কাদেরের ছেলে আমির হোসেন রায় শুনে বলেন, ‘আমার বাবাকে যারা খুন করেছে, তাদের কি কোনো বিচার হবে না? আমি বাবা হত্যার বিচার চাই।’ একাত্তরে আমিরের বয়স ছিল মাত্র সাত মাস।
বিষয়: রাজনীতি
১৩৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন