শুকনোপাতার ওয়েডিং সেরেমনি
লিখেছেন লিখেছেন দুষ্টু পোলা ২৮ মার্চ, ২০১৪, ০৮:৩০:০৭ রাত
মাথায় মনে হয় বাজ পড়ল ইলার!!তাও আবার একটা না এক সাথে কয়েকটা…ধাম,ধাম,ধাম!
প্রথম বাজটা পড়ল যখন কনভেনশন সেন্টার অফিস থেকে ফোন করে জানানো হলো,আগামী বছরের জুন মাসের আগে তাদের কোন হলরুম খালি নেই,এবং আগামী ফেব্রুয়ারীর আগে কোনভাবেই কোন কন্ট্রাক্ট বাতিল করে হল দেয়া সম্ভব না,কথাটা শুনে ইলার মাথা মনে হল ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে…! কোন রকমে দৌড়ে আব্বুর রুমে আসতেই শুনতে পেল,আব্বু আম্মুকে বলছে,
–”ইলার মা,খারাপ খবর আছে…
–কি বলছ?কি খারাপ খবর?!!ওদিকে সব ঠিক আছে তো?
–কেমন ঠিক আছে বলি!আসিফের মামা ফোন করেছিল,ইলা আর আসিফ ইনভাইটেশনের জন্য যে কার্ডের ডিজাইন ওর্ডার করে এসেছিল,সেই কোম্পানী ফোন করে জানিয়েছে এ বছর তারা আর কোন নতুন ডিজাইনের ওর্ডার নিবে না,তাদের হাতে পুরোনো ডিজানেইরই এখনো অনেক ওর্ডার বাকী…যদি সেখান থেকে কোন ডিজাইন ওরা সিলেক্ট করে দেয় তাহলে একমাস পর ওরা সাপ্লাই করতে পারবে।
–হায় হায়!কি বল?!!ইলা শুনলে তো খবর আছে,গত সাতদিন ধরে দিন রাত খেটে মেয়েটা বিয়ের কার্ডের একটা আনকমন ডিজাইন বানিয়েছে,আর এখন যদি সেটা না হয়,তাহলে তো শেষ!!
আম্মু আর কি কি যেন বলছিল,কিন্তু ইলার আর কিছু শোনার ধৈর্য হলো না।নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিল।
ইচ্ছা করছে হাউমাউ করে কাঁদতে!এই কষ্ট সে কিভাবে সহ্য করবে,তার নিজের বিয়ে নিয়ে এতো দিনের সব প্ল্যান এইভাবে ভেস্তে চলে যাবে…!বান্ধবী-কাজিনদের কতো গর্ব করে শুনিয়েছিল তার বিয়ের সব কিছুই হবে সেই রকম…একদম আনকমন।
আসিফকে কল দিতে যেয়েও কল দিল না,এই ছেলে কে কল দিয়ে কোন লাভ নাই,সে আছে তার চাকরী নিয়ে।তারপরেও একটা এসএমএস করল,
”আমার এ বছর বিয়ে করতে ইচ্ছে করতেছেনা,ভাবছি সামনের বছর স্পেশাল একটা ডেট দেখে বিয়ে করব!”
পাঁচ মিনিট চলে গেল আসিফের কোন রিপ্লাই নেই।ইলা মোবাইল টা রেখে ডায়েনিং এ যেয়ে হল খালি না পাওয়ার খবরটা মা কে দিল।এবং এটাও জানালো,যদি মনের মতো কিছু না হয় তাহলে এ বছর বিয়ের অনুষ্ঠান হবে না।ওরকম সাদা-মাটা ভাবে সে বিয়ে করতে পারবে না।
ইলা একটা প্রাইভেটা ভার্সিটি থেকে এ বছর গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে,একটা জব করছে,আর পাশাপাশি এমবিএ করছে।ইলার ছোট একটা ভাই আছে,ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে,বাবা-মা,ভাই কে নিয়ে ইলার সাজানো জীবন।
আসিফ ইলার বাবার বন্ধুর ছেলে,ইলার থেকে দুই বছরের বড়,একটা ব্যাংকে আছে।আসিফরাও এক ভাই এক বোন,বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
আজকাল কার ভাষায় বলতে গেলে ইলা আর আসিফের বিয়েটা অনেকটা লাভ-এরেঞ্জড অথবা এরেঞ্জড-লাভ ম্যারিজ দুটোই বলা যায়।সে দিক থেকে ইলার ভাগ্য দেখে,ইলার সম বয়সী কাজিন আর বান্ধবীরা কিছুটা হিংসে তো করেই।আর সে জন্যই সব সারাক্ষন ইলাকে খোঁচায়,দেখবো ইলা তোর বিয়ে তে কি করিস!আর দশজনের মতো হলে কিন্তু খুবই অন্যায় হবে!স্পেশাল হতে হবে বুঝলি…!বিয়ের ড্রেস,মেকাপ সব কিছু সবার থেকে অন্যরকম হতে হবে..ইত্যাদি।
সবার এসব খোঁচা বন্ধ করতেই ইলার এত তোড়জোড়,এত প্ল্যানিং কিন্তু শেষ পর্যন্ত তীরে এসে তরী রক্ষা হলো না ইলার!
আসিফের অবশ্য এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই,আসিফের বাবা বলেছেন,”বাবা আসিফ,বিয়ে শাদীতে কি করতে হবে এটা হলো মেয়েদের চিন্তার বিষয়,ছেলে মানুষের এইসব নিয়া চিন্তা করা পূরাই বোকামী।”আসিফ ও ভেবে দেখেছে বাবার কথাই ঠিক।
একদিন শুধু মাত্র ইলার সাথে বসেছিল এ ব্যাপারে কথা বলতে,আসিফের মনে হয়েছে বিসিএস পরীক্ষা দিতেও মনে হয়না তাকে মাথা ঘামাতে হয়েছিল যতটা না বিয়ের প্ল্যানিং করতে ইলা মাথা ঘামাচ্ছে!বেচারী রাত দিন এক করে ফেলছে..! ইলা কষ্ট পাবে ভেবে আসিফ কিছু বলেনা।
নাজমা হাসানের মাথায় আসে না,একটা বিয়ের অনুষ্ঠান করতে এত কি আয়োজনের দরকার পড়ে যা নিয়ে তার মেয়ে রাত-দিন এক করে ফেলছে!বিয়ে তো তারও হয়েছে,ইলার বান্ধবীদের হয়েছে,কাজিনদের হয়েছে,কই এত মাতামাতি তো হতে দেখেননি!
আসিফের মায়ের সাথে নাজমা হাসানের বান্ধবীর মতো সম্পর্ক, সেদিন তিনিও কথায় কথায় বলছিলেন,
”ইলার মা,বুঝিনা আজকাল কার ছেলে-মেয়েদের মনোভাব,আমাদের ওতো বিয়ে হয়েছে,মেয়ের বিয়ে দিয়েছি,অনেক বেশী বাহ্যিক ধুম-ধাম না হলেও মনের দিক থেকে উপচে পড়া খুশী ঠিকই ছিল,আত্নীয়-স্বজনদের আন্তরিক দোয়া ছিল,বিয়ের পর মেয়ে ও সুখেই আছে,আর এখনকার বিয়ে দেখো..কতো আয়োজন,কতো ধুমধাম, খুশীতে বিয়ের সময় মেয়ে কাঁদতেও ভুলে যায়!অথচ ক’বছর যেতে না যেতেই শুনি,মেয়ে নাকি স্বামী সংসারে সুখী না,ডিভোর্স হয়ে গেছে!কি লাভ হয় মেয়ের বাবা-মায়ের এত খরচ করে মেয়ে বিয়ে দিয়ে,আর কি লাভ হয় ছেলের বাবা-মায়ের এত টাকা খরচ করে বউ ঘরে এনে..!”
আসিফের মায়ের কথা গুলো নাজমা হাসানের কানে এখনো বাঁজছে!ঠিকই তো বলেছেন ভাবী,যদিও আসিফের মা মুখে ইলাকে কোন কিছু করতে না করেন না,কিন্তু মা হিসেবে তো তার ও একটা দায়িত্ব আছে মেয়েকে বোঝানোর।ঠিক করলেন আজ অফিস থেকে আসার পর ইলার সাথে কথা বলবেন।
ইলা গত কয়েকদিন ধরে কেমন জানি গুম ধরে আছে।কারো সাথে খুব একটা কথা বলছে না।আসিফ ও লক্ষ্য করেছে কিন্তু কিছু বলেনি,খুব সম্ভবত বিয়ের আয়োজন নিয়ে ইলার মন খারাপ তাই আর কিছু বলেনি।ইলার পাশের ডেস্কে কাজ করেন নিশি আপু।
হাসি-খুশী একটা মানুষ,ইলা খুব পছন্দ করে তাকে।
ইলার চুপ থাকাটা নিশি আপুও খেয়াল করেছেন,ব্যাপার কি?! ক’দিন আগেও তো মেয়েটা অনেক ব্যাস্ত ছিল বিয়ের আয়োজন নিয়ে,কিন্তু আজকাল আর কিছুই বলেনা এ ব্যাপারে..কোন খারাপ কিছু হয়নি তো?!
সাতপাচ ভেবে অবশেষে লাঞ্চ আওয়ারে জিজ্ঞেস করলেন ইলাকে।
ইলাও মন হালকা করার জন্য সব কিছু খুলে বলল।সব শুনে কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন নিশি আপু।
–ইলা,তোমাকে আমি অনেক বুদ্ধিমতি আর চিন্তাশক্তি সম্পন্ন মেয়ে মনে করি এটা কি তুমি জানো?
ইলা মুচকি হেসে মাথা দোলালো।তা দেখে নিশিও একটু হাসল,
–দেখো,ইলা তুমি এই যুগের একটা শিক্ষিত মেয়ে।সব দিক থেকেই তুমি সবার থেকে অনেক ভালো অবস্থানে আছো,সুতরাং তুমি যা করবে বুদ্ধিমান মানুষদের মতোই করবে।দেখো,আমরা মেয়েরা ছোট থেকেই সংসার সংসার খেলতে খেলতে বড় হয়েছি,আল্লাহ আমাদেরকে সংসারী করেই বানিয়েছেন,আর বিয়ে আমাদের জন্য অনেক অনেক বিশাল একটা কিছু,সুতরাং বিয়ের গুরত্ব বা খুশীটা আমরা নিশ্চয়ই মানুষকে দেখানোর জন্য ফিল করিনা?!
দেখো,তুমি আর আসিফ যেহেতু নিজেদের ব্যাপারের মানে তোমার জীবন সাথীর ব্যাপারে ফুল স্যাটিসফাইড তাহলে তোমার এখন আর কি চাই?বিয়েতে আত্নীয়-স্বজনের উপস্থিতি,বন্ধু-বান্ধবদের কাজিনদের প্রাণ খোলা হাসি-আনন্দ,আর সবার তরফ থেকে তোমার আর আসিফের জন্য দোয়া,এইতো?তার জন্য কি বিশাল বড় দামী হলরুম,আনকমন ওয়েডিং কার্ড,আনকমন ব্রাইডাল ড্রেস,বিউটিফুল ব্রাইডাল মেকাপ এগুলো খুব বেশী দরকার?নাহ,এসবের মোটেও অনেক বেশী দরকার নেই।
–আমি জানি নিশি আপু,বাট তারপরেও বিয়ে তো জীবনে একবারই করব,সব কিছু যদি একটু পারফেক্ট না হয়..কেমন হয় বল?
–পারফেক্ট বিয়ে আর পারফেক্ট ওয়েডিং সেরেমনির মধ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে ইলা।পারফেক্ট বিয়ে মানে,মনের মতো মানুষটার সাথে বাবা-মায়ের দোয়া নিয়ে কবুল বলতে পারাকেও বুঝায় ওকে? দেখো ইলা,ওরকম সেলেব্রেটি ওয়েডিং সিরোমনি তো কতই হয় কিন্তু বিয়ের পর কি তারা হ্যাপি হয়?ওরা তো বিয়ের মানেই বোঝে না।ওদের কাছে বিয়ে মানে শো-ডাউন আর কিছুই না। এখন যদি তুমিও ওদের দেখাদেখি খাঁটি হিরাকে দূরে সরিয়ে দাও পুরনো মডেল বলে আর নকল হিরাকে হাতে তুলে নাও নতুন ডিজাইন বলে,তাহলে কি হবে?কিছুই হবে না।
ইলা কিছু না বলে চুপ করে রইল।ওকে চুপ থাকতে দেখে নিশি বলল,
–দেখো ইলা,আমি বলছি না তোমার ভাবনা ভুল,তুমিও ঠিকই আছো,তবে একটু ভেবে দেখো,তুমি বিয়ে করছো,ভালোবাসা আর আন্তরিকতাপূর্ণ জীবন তুমি চাও,সো সেখানে লোক দেখানো ব্যাপার গুলোকে এভোয়েড করাটাই ব্যাটার।আর দশজনের মতোই তোমার বিয়ে হবে,গায়ে হলুদ হবে,আত্নীয়-স্বজন আসবে,বিয়ে হবে বৌ-ভাত হবে সবই হবে,এবং ধুম-ধাম করেই হবে,এসব কে এতটা আলাদা করে ভেবোনা।মনে রেখো,তোমাদের বাবা-মাদের ইচ্ছার মূল্যও কিন্তু দিতে হবে,তাদের খুশীকে কোনভাবেই ছোট করে দেখতে পারবেনা।
অফিস শেষে ইলা অফিসের গাড়ির জন্য ওয়েট না করে একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে।ইলার মনে হচ্ছে,ও একটা ঘোরের মধ্যে ছিল এতক্ষন,পেছনের সব কিছু চিন্তা করতে যেয়ে নিজেকে অনেক স্বার্থপর মনে হয়!!
কি পাগলের মতোই না ভাবছিল সে!নিশি আপুর কথাটাই ঠিক ও বিয়েকে বিয়ে না ভেবে একটা ওয়েডিং সেরেমোনি ভাবছিল!জাস্ট একটা ফাংশন! আনকমন ওয়েডিং ড্রেস,ওয়েডিং কার্ড,ব্রাইডাল মেকাপ,ওয়েডিং ফটোগ্রাফি!!এসব ভাবতে ভাবতে তো বিয়েটাকেই ভেস্তে পাঠিয়ে দিচ্ছিল!
ইলা বাসায় এসেই ডাকা-ডাকি শুরু করেছে দেখে দৌড়ে আসলেন ইলার মা,
–কি হইছে,বাড়ি মাথায় তুলেছিস ক্যান?
ইলার ভাই বলল,
–কিরে আপু?এইবার তোর কোন প্ল্যান ভেস্তে গেল?তোর বিয়ে কি আবারো পিছিয়েছে?
–নাহ,আমার বিয়ে এই বছরই হবে,এবং ফিক্সড ডেটেই হবে।এই সময়ের মধ্যে যেভাবে প্রিপারেশন নেয়া যায় সবাই সেভাবেই প্রিপারেশন নাও,হলরুম না পাওয়া গেলে গায়ে হলুদ,বিয়ে দুই অনুষ্ঠান আমাদের বাসার ছাদেই হবে..
–কই হবে?!!!!চিৎকার করে উঠল ইমন
–আমাদের বাসার ছাদেই হবে বলছি।ক্যান,আমাদের বাসার ছাদ কি কম বড় নাকি?বাকী সব কিছু যেভাবে এই সময়ের মধ্যে করা সম্ভব সেভাবেই হবে।ওকে?আমার কথা শেষ,তোমরা এই সব কথা এখন বাকীদের কাছে পৌছে দাও।আমি আমার রুমে গেলাম।
–আম্মু তোমার মেয়ে তো মনে হয় টেনশনে পাগল হয়ে গেছে!
ইমনের কথা শুনে ওর মাথায় একটা চাটি দিয়ে ইলা মায়ের দিকে ফিরল,তারপর একটু লাজুক লাজুকভাব নিয়ে বলল,
–আম্মু,আমি আমার রুমে যাই,নানী বলেছেন,বিয়ের আগে বিয়ার কইন্যার কথা কম বলা উচিত,আর চেহারায় সব সময় একটা লাজুক ভাব রাখা উচিত!তাই না আম্মু?..হিহিহি।
ইলার চলে যাওয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে রইল সবাই!!
( ইহা একটি কপি পেষ্ট পরিবেশণা)
বিষয়: বিবিধ
১৯৬৭ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তাই নাকি
মন্তব্য করতে লগইন করুন