নাটের গুরু কী এরশাদ!

লিখেছেন লিখেছেন রিপোর্টার ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১২:৩৭:১২ দুপুর

সম্প্রতি আবারও নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সরকারের বিরুদ্ধেও তাকে সোচ্চার দেখা যাচ্ছে। মহাজোট সরকারকে নাকি হটানো দরকার। জনগণকে তারপর কি করতে হবে তারও পরামর্শ দিয়েছেন এরশাদ। নিজের বুকের ওপর আঙুল ঠেকিয়ে বলেছেন, তাকে ছাড়া নাকি জনগণের উপায় নেই! অর্থাৎ এরশাদকেই মতায় বসাতে হবে। কিভাবে মতায় আসবেন তিনি সে সম্পর্কে সুনিদিষ্টভাবে না জানালেও জনগণকে ভয় দেখানোর ব্যাপারে কার্পণ্য করেননি এই সাবেক স্বৈরশাসক। গত ২৬ জানুয়ারি রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেছেন, আবারও ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সত্যি তেমন কিছু ঘটলে ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচনের স্বার্থে ওয়ান-ইলেভেনকে ‘স্বাগত’ জানাবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক দল জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কথাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে শুনলে মনে হতে পারে যেন সরকারের ব্যর্থতায় সত্যিই তিনি ুব্ধ ও বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে তার এ ধরনের বক্তব্যের প্রকৃত কারণ কিন্তু অন্য রকম। পাঠকরা দেশজুড়ে র‌্যাব ও পুলিশের মাধ্যমে চলমান তাণ্ডবের সঙ্গে এইচ এম এরশাদের কথাটাগুলোকে মিলিয়ে দেখতে পারেন। ভয় দেখানোর স্টাইলটাও তার নিজের একটি অসাংবিধানিক পদেেপর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ১৯৮২ সালে অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রাক্কালে সেনাপ্রধান হিসেবে সাপ্তাহিক বিচিত্রাকে দেয়া এক সাাৎকারে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারকে তুলোধুনো করেছিলেন তিনি। সেটা ছিল এক নজীরবিহীন ঘটনা। পরবর্তীকালে আরো অনেক নাটকীয় ঘটনারই জন্ম দিয়েছেন এরশাদ। বর্তমান পর্যায়েও কথা ওঠার পেছনে গুরুতর কারণ ল্য করা গেছে। বেছে বেছে এমন এক সময়ে তিনি ওয়ান-ইলেভেনের ভয় দেখিয়েছেন যখন একদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের প থেকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে এবং অন্যদিকে ও জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে চলছে প্রচণ্ড দমন অভিযান। এরশাদও অকারণে মহাজোট থেকে সরে পড়ার ভাব দেখাচ্ছেন না। তিনি অন্তত এই সত্য বুঝতে পেরেছেন, সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী মহাজোটের পে মতায় ফিরে আসা সম্ভব হবে না। আর ঠিক সেজন্যই কৌশল হিসেবে আগে-ভাগে পদপে নিয়েছেন এরশাদ। তাই বলে উদ্দেশ্যও আবার মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া নয়, তিনি আসলে মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়েছেন। এমন অবস্থার ফায়দা কারা নিয়েছে, নিচ্ছে বা নিতে পারে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর দরকার পড়ে না।

ঘটনাপ্রবাহে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে এসেছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যকার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক বন্ধুত্বের এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার। ১৯৮২ সালের মার্চে সেনা প্রধান হিসেবে জেনারেল এরশাদ যখন অবৈধভাবে মতা দখল করেছিলেন, তখন আওয়ামী লীগ তাকে সমর্থন যুগিয়েছিল। অবৈধ সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে নানা কৌশলে এরশাদকে রাও করেছিল আওয়ামী লীগ। বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, ২১ মার্চ গভীর রাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার একদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, পাঁচ দফার ভিত্তিতে চলমান আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে যারা স্বৈরাচারীর নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজেই নেত্রীর সে ঘোষণার উল্টো কাজ করেছিল। সেবার সংসদে ৭৬টি আসন পাওয়ার পর এরশাদের অবৈধ শাসনকে বৈধতা দিতে সাহায্য করেছিল দলটি। ১৯৯১-৯৬ সময়কালে জাপা ও আওয়ামী লীগ একযোগে আন্দোলন করেছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে এরশাদ চার দলীয় জোটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আওয়ামী লীগের পে ভূমিকা পালন করেছেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতার সম্পর্ক অনেক পুরনো।

লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মতায় আসার ব্যাপারেও দল দুটি খুবই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য দল দুটির মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। ঘটনাস্থল ছিল লন্ডন। সেবার ঢাকায় ফিরে এরশাদ বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে তিনি ‘বোন’ ডেকেছেন। সুতরাং ‘বোনের’ সঙ্গে ‘ভাইয়ের’ বৈঠক হয়ে থাকলে তাতে ‘দোষের’ কিছু থাকতে পারে না! এরশাদ একই সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, মহাজোট বিজয়ী হলে তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন। এ শুধু তার ইচ্ছা নয়, শেখ হাসিনাও তাকে রাষ্ট্রপতি পদে মেনে নিতে রাজি হয়েছেন। এরশাদকে অবশ্য শেষ পর্যন্ত আরেক বৃদ্ধ নেতা জিল্লুর রহমানের কাছে পরাস্ত হতে হয়েছিল। নিজে ‘প্রস্তুত’ থাকলেও ‘ভগিনী’ শেখ হাসিনা লন্ডনের সমঝোতা অনুযায়ী এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বানাননি। তা সত্ত্বেও এবং বিভিন্ন সময়ে মহাজোট ত্যাগ করার ও যথাসময়ে ‘অ্যাটাক’ করবেন বলে হুমকি দেয়ার পরও এরশাদ এখনও শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই রয়েছেন। সম্ভবত থেকেও যাবেন অন্তত আগামী নির্বাচন পর্যন্তÑ যদি সে নির্বাচন আদৌ যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়।

পর্যবেকরা কিন্তু মনে করেন, এরশাদের কথাগুলোকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া দরকার। কারণ, রাজনীতির এই পাকা খেলোয়াড় অনেক ‘গভীর জলের মাছ’ এবং তার কাছে সব খবরই রয়েছেÑ শুধু বাইরের নয়, ভেতরের সব খবরও। যথেষ্ট পারঙ্গমতার সঙ্গে বহুবার ‘খেল’ দেখিয়ে আসা সাবেক এই ধুরন্ধর জেনারেল নিজেও হয়তো কোনো না কোনো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন! এজন্যই এমন ভাবনা মোটেই ঠিক নয় যে, এরশাদ কেবলই আওয়ামী মহাজোট থেকে কেটে পড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। ওয়ান-ইলেভেনের ভয়ও তিনি অযথা দেখাননি।

এ ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যাবে যদি রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে, বিশেষ করে জামায়াত ও শিবিরের বিরুদ্ধে সরকারের প্রচণ্ড দমন অভিযানের দিকে ল্য করা যায়। বিগত কয়েকদিনে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেও এই অভিযান চলছে আসলে বহুদিন ধরেই। র‌্যাব-পুলিশ এবং আওয়ামী গুণ্ডা-সন্ত্রাসীদের দাপটে জামায়াত দেশের কোথাও কোনো মিছিল-সমাবেশ করতে পারছে না। অবস্থা এমনও হচ্ছে যখন পুলিশ আর আওয়ামী গুণ্ডা-সন্ত্রাসীদের মধ্যে পার্থক্য করা যাচ্ছে না। রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত জামায়াতের সব অফিসেই তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে সরকার। একযোগে চলছে মিছিল-সমাবেশ পণ্ড করার কর্মকাণ্ড। উদাহরণ দেয়ার জন্য গত ২৮ জানুয়ারির সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহের কথাই বলা যাক। মতাসীনদের পাশাপাশি মিডিয়ার একটি চিহ্নিত অংশও সবকিছুকে কেবলই ‘শিবিরের তাণ্ডব’ হিসেবে উল্লেখ করে তারস্বরে চিৎকার করেছে। জামায়াত-শিবিরকে এক হাত নিতে লাফিয়ে এসে গেছেন পরিচিত সেই টকশোওয়ালারাও। অন্যদিকে টিভির ভিডিও ফুটেজের পাশাপাশি প্রত্যদর্শীদের বর্ণনাতে কিন্তু জানা গেছে, পুলিশের ওপর কথিত হামলা শিবির আগে চালায়নি। রাজধানীতে শিবির কর্মীরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দৈনিক বাংলার মোড় পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ মিছিলই করেছিল। দৈনিক বাংলার কাছাকাছি আসার পর পুলিশই হঠাৎ তাদের ওপর হামলা চালিয়ে বসেছে। আর তখনই শুরু হয়েছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। শিবির কর্মীরা তাই বলে কোনো পুলিশের ‘হাড্ডি’ ভেঙে দেয়নি। টিয়ার শেলের বিরামহীন আঘাত ও প্রচণ্ড ধাওয়ার মুখে তেমন সুযোগই তাদের ছিল না। তারা বরং জীরন বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিল! প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে কারা? কারাই বা পুলিশের মাথা ফাটিয়েছে এবং হাড্ডি ভেঙে দিয়েছে? অনুসন্ধানে কিন্তু বিস্ময়কর তথ্যই বেরিয়ে আসছে। মতাসীনরা আজকাল কিছু হলেই যে ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ দিকে আঙুল তুলে থাকেন সে ধরনের কোনো নিয়োজিত গ্রুপই সম্ভবত পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছিল। এর কারণ, বিগত কিছুদিনে জেলাকরণসহ অনেক কারণেই পুলিশের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটেছে। সব কাজ ফেলে কেবলই বিরোধী দলকে পেটানোর কাজে ব্যস্ত রাখার কারণেও পুলিশের মনোবল কমে গেছে। সে কারণে পুলিশকে নতুন করে উজ্জীবিত করে তোলার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। বলা হচ্ছে, এজন্যই ‘ধন্বন্তরী’ ওষুধের প্রয়োগ করা হয়েছে। কৌশল হিসেবে মতাসীনরাই অতি গোপন ব্যবস্থাপনায় দলীয় ক্যাডারদের শিবিরের মিছিলে অনুপ্রবেশ করিয়েছেন। তাদের দিয়ে পুলিশের ওপর এমনভাবে হামলা চালিয়েছেন পুলিশ যাতে আবারও মতাসীনদের কথায় ওঠা আর বসা শুরু করে।

পাঠকরা এর সঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমেদের ‘সাড়া জাগানো’ হুকুমের কথাটা মিলিয়ে দেখতে পারেন। ২৮ জানুয়ারিই তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের কাউকে ‘দেখা মাত্র’ গুলি করার জন্য পুলিশকে আদেশ দিয়েছেন। বলেছেন, ‘এখন থেকে শিবির দেখলেই গুলি করবা।’ চরম ফ্যাসিস্টসুলভ এ আদেশটি তিনি পুলিশের আইজির সামনেই দিয়েছেন। তারও আগে ােভের সঙ্গে তিনি জানতে চেয়েছেন, পুলিশ কেন হামলাকারীদের হাত-পা ভেঙে দেয়নি! ওদিকে অধীনস্থজনকে নিষেধ করার বা কোনো বাধা দেয়ার পরিবর্তে আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকারও ঘোষণা করেছেন, এভাবে চলতে থাকলে পুলিশ আর ‘সংযম’ দেখাতে পারবে না। পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। অর্থাৎ কিছুটা এদিক-সেদিক করে পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তাও আসলে একই হুকুম ও হুমকি দিয়েছেন।

বলা দরকার, ডিএমপি কমিশনারের হুকুম জনগণকে স্তম্ভিত তো করেছেই, ভীত-সন্ত্রস্তও করে তুলেছে। কারণ, আইনত ডিএমপি কমিশনার কেন, কেউই এভাবে ‘দেখা মাত্র’ গুলি করার আদেশ দিতে পারেন না। গুলির ফলে মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে বলেই এ ব্যাপারে যথেষ্ট সংযম দেখানো দরকার। তাছাড়া ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ কোনো সংগঠন যেমন নয় তেমনি ‘শিবির’ কথাটা কারো গায়েও লেখা থাকে না। সব জেনেও ডিএমপি কমিশনার এত ভয়ঙ্কর একটি হুকুম দেয়ায় এবং আইজি প্রকারান্তরে তার সমর্থনে পাশে দাঁড়ানোয় আপত্তি উঠেছে আইনগত কারণে। বাংলাদেশের সংবিধানেও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবেই বলা আছে। পুলিশ কর্তাদের উচিত সংবিধানের ৩১ থেকে ৩৯ পর্যন্ত ধারা ও অনুচ্ছেদগুলো পড়ে দেখা। এসবের কোনো একটিতেই ‘দেখা মাত্র’ গুলি করার বা গুলি করার নির্দেশ দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইন এবং আন্তর্জাতিক কোনো আইন বা বিধিবিধানেও এ ধরনের অনুমতি নেই। বাংলাদেশ ‘ইউনিভারসাল ডিক্যারেশন অব হিউম্যান রাইটস’ এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস’সহ সাতটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ নিয়েছে, সেগুলোর দলিলে স্বার করেছে। এসব সংস্থার প্রতিটির সনদ ও আচরণবিধিতেই পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর বিধান রয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব চিফস অব পুলিশ’-এর নয়টি অনুচ্ছেদসংবলিত আচরণবিধির কোনো একটিতেই বিনাবিচারে গুলি করা দূরে থাকুক, কোনো নাগরিকের ওপর বলপ্রয়োগেরও অধিকার দেয়া হয়নি। বরং এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সমস্যা দেখা দিলে শেষ পর্যন্তও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার চেষ্টা করার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো কারণে যদি সেটা সম্ভব না হয় এবং বলপ্রয়োগ যদি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে সে েেত্রও এমন সংযমের সঙ্গে পদপে নিতে হবে যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ‘যন্ত্রণার’ শিকার না হয়। সহজ কথায় এর অর্থ হলো, গুলি করে হতাহত করার প্রশ্ন ওঠে না, পুলিশ এমনকি লাঠিপেটাও করতে পারবে না। কারণ, লাঠিপেটা করলে আক্রান্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ অনিবার্যভাবেই ‘যন্ত্রণার’ শিকার হবে।

এভাবে যে কোনো পর্যালোচনাতেও দেখা যাবে, ডিএমপি কমিশনার সব দিক থেকেই আইনের পরিপন্থী অবস্থানে চলে গেছেন। বেআইনি কাজ করেছেন। তার হুকুমের অন্য দিকটিও খুবই গুরুত্বপূুর্ণ। কারণ, আইন হলো, কেউ অপরাধ করলে প্রথমে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা দায়ের করতে হবে এবং তারপর তাকে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশকে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে হবে। বাকি সবকিছু করবে আদালত। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আদালতই অভিযুক্তকে সাজা দেবে। পুলিশ আদালতের সে হুকুম তামিল করবে মাত্র। এখানে পুলিশের জন্য নিজের উদ্যোগে করার কিছুই নেই। ওদিকে আদালতে সাধারণত বিভিন্ন মেয়াদের সাজাই হয়ে থাকে। ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধের েেত্র মাননীয় বিচারপতিরা ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডও দিয়ে থাকেন। কিন্তু গুলি করে হত্যার রায় দেয়ার নজীর বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে ডিএমপি কমিশনার সরাসরি গুলি করার হুকুম দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি শুধু সংবিধানই লঙ্ঘন করেননি, একই সঙ্গে দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইন এবং আন্তর্জাতিক সকল বিধিবিধানের প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। কারণ, গুলি করা একটি ভয়ঙ্কর কাজ। এটা সাধারণত গুণ্ডা-সন্ত্রাসীরা করে থাকে। তাদের উদ্দেশ্যই থাকে কাউকে হত্যা করা। এখানেও বিষয়টিকে সেভাবেই দেখা দরকার। কারণ, গুলিতে মানুষের মৃত্যু ঘটে। ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ সে নির্দেশই দিয়েছেনÑ শিবির কর্মীদের প্রকারান্তরে তিনি হত্যাই করতে বলেছেন। তাও বিনা বিচারে! অথচ এ ধরনের বেআইনি ও সংবিধানবিরোধী আদেশ দেয়ার কোনো অধিকারই তার নেই, থাকতেও পারে না। চাকরির শর্ত এবং আচরণবিধির কোনো কিছুই তাকে তেমন অধিকার দেয়নি। সব জেনেও তাহলে তিনি অমন একটি ভয়ঙ্কর ও বেআইনি আদেশ দিয়েছেন কিভাবে?

এ প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই রয়েছে আগামীর সম্ভাবনা সম্পর্কিত ইঙ্গিত। জেনারেল এরশাদ হঠাৎ কেন ওয়ান-ইলেভেনের ভয় দেখিয়েছেন তারও কারণ রয়েছে ওই উত্তরের মধ্যে। ল্য করলে পাঠকরাও দেখতে পাবেন, বাস্তবে মতাসীনরাই ডিএমপি কমিশনারকে ঔদ্ধত্য দেখানোর এবং বেআইনি হুকুম দেয়ার সাহস যুগিয়েছেন। মাত্র ক’দিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. ম খা আলমগীর ‘যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই’ জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের পাকড়াও করার জন্য পুলিশকে হুকুম দিয়েছেন। এত পেছনেই বা যাওয়া কেন, ২৯ জানুয়ারি আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম তো পুলিশকে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোরও হুকুম দিয়েছেন। ‘জিরো টলারেন্স’-এর অর্থ কিন্তু ডিএমপি কমিশনারের হুকুমের মতোই। এভাবেই মতাসীনদের উদ্যোগে সুচিন্তিতভাবে পরিস্থিতিকে সংঘাতমুখী করে তোলা হচ্ছে, যার পরিণতি আরো একটি ওয়ান-ইলেভেন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এরশাদও মূলকথায় সে ইঙ্গিতই দিয়ে রেখেছেন। অন্তরালে সত্যিই তেমন কোনো পরিকল্পনা থেকে থাকলে পুলিশের মাধ্যমে দমন-নির্যাতনই কেবল অব্যাহত থাকবে না, লাফিয়ে লাফিয়ে তা বেড়েও চলবে। একযোগে শুরু হতে পারে নতুন পর্যায়ে হত্যা-সন্ত্রাসও। সব মিলিয়েই পরিস্থিতিকে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এর দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে, যখন এরশাদের কথাই সত্যে পরিণত হবে। তেমন অবস্থায় আরো একটি ওয়ান-ইলেভেনই শুধু ঘটবে না, এর মাধ্যমে মতায় আগতদের উদ্যোগে আবারও একটি ডিজিটাল নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও পদপে নেয়া হবে। ‘সুষ্ঠু’ সে নির্বাচনের স্বার্থেই সম্ভাব্য ওয়ান-ইলেভেনের প্রতি আগে-ভাগে সমর্থন জানিয়ে রেখেছেন এরশাদ। বলে রেখেছেন, তিনি একে ‘স্বাগত’ও জানাবেন!

আমরা জানি না, শেষ পর্যন্ত এরশাদের কথাই সত্য হবে কি না, বাংলাদেশকে আরো একবার ওয়ান-ইলেভেনের ঠ্যালাই সামলাতে হবে কি না। যদি হয়, তাহলে কী এবার নাটের গুরু হবেন এরশাদ? যা কিছুই ঘটুক না কেন, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে অন্তত একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে গেছে। সেটা হলো, গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসার কোনো ইচ্ছা বা চিন্তাই নেই মতাসীনদের। তারা বরং ওয়ান-ইলেভেন ঘটানোর এবং নতুন প্রোপটে আরো একটি ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও মতায় আসার পাঁয়তারা করছেন। সেটা তারা করতেই পারেন। অন্যদিকে তাদের ইচ্ছা বা চাওয়াটাই কিন্তু সব নয়। কারণ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো রাজনৈতিক দলগুলো তো রয়েছেই, মাঝখানে রয়েছে জনগণও।

বিষয়: বিবিধ

১২৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File