হলুদ আলেআ থেকে হুবহু তুলে ধরলাম
লিখেছেন লিখেছেন বাংলার তেীহিদ ০৪ মার্চ, ২০১৩, ১২:৫৭:৫৯ দুপুর
বগুড়া ও আশপাশের উপজেলায় গতকাল ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে জামায়াত-শিবির। দিনভর এদের তাণ্ডবে নিহত হয়েছে ১২ জন। তারা দফায় দফায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করেছে থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, রেলস্টেশন, উপজেলা পরিষদ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর, গণমাধ্যমের কার্যালয়, রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি ও দলীয় কার্যালয় এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে।
১২ জনের মধ্যে বগুড়া সদরে পাঁচজন, শাজাহানপুর উপজেলায় পাঁচজন ও শিবগঞ্জে দুজন নিহত হয়েছেন।
বর্বরতা শুরু যেভাবে: ভোর চারটার দিকে বগুড়া শহরতলির বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে মানুষকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানানো হয়। মসজিদ থেকে বলা হয়, চাঁদে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুখ দেখা যাচ্ছে। তাঁকে রক্ষা করা ইমানি ও জিহাদি দায়িত্ব। এ ঘোষণার পর থেকে জামায়াত-শিবিরের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল বের করে। লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় আসার চেষ্টা করেন। খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাতমাথায় অবস্থান নেয়। এ সময় শহরের শেরপুর সড়কে র্যাব কার্যালয় থেকে একদল র্যাব ও পুলিশ সাতমাথায় আসার সময় ইয়াকুবিয়া স্কুলের মোড়ে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এখানে সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়। আহত হয় বেশ কয়েকজন।
এ ঘটনার পরপরই শহরের ফুলবাড়ী, নারুলী, কৈগাড়ি, স্টেডিয়াম, উপশহর ও সদর ফাঁড়িতে একযোগে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে জামায়াত-শিবির। তারা ফুলবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ির গ্যাস লাইনে অগ্নিসংযোগ করলে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ফাঁড়িটি। পুলিশ সদস্যরা তখন ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন। পুলিশের অন্য সদস্যরা গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করেন।
একই সময় শহরের চক লোকমান এলাকায় বগুড়া-১ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ আবদুল মান্নান, উপশহর এলাকায় সাবেক সাংসদ ও প্রবীণ সাংবাদিক আমানুল্লাহ খানের বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। শেরপুর সড়কে এস এ পরিবহনের কার্যালয়, করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিস, এটিএন বাংলা ও এটিএন ইলেকট্রনিকসের শোরুমে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। একই সময়ে শহরের কালীতলায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের বাসায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বাসার নিচে থাকা দুটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন নিহত হয়।
সকাল সাড়ে আটটার দিকে বগুড়া রেলস্টেশনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে জামায়াত-শিবির। এ ছাড়া বগুড়া-সান্তাহার লাইনের বিভিন্ন স্থানে স্লিপার খুলে ফেলা হয়। পরে জামায়াত-শিবির শহরের সাতমাথায় আসার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। এ তাণ্ডবের পর শহর প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বেরোয়নি।
বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ সহিদ আলম জানান, জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের পর সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এঁরা হলেন সদরের পালশা গ্রামের আলম হোসেনের ছেলে টিটু (২২), গাবতলী উপজেলার আলমগীর হোসেন (২৭) ও আফতাব আলী, জয়পুরপাড়ার আলতাফ হোসেনের ছেলে বাদল হোসেন (২৫) ও শহরের বাদুরতলার লিটন মিয়া (২০)।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পৌর এলাকায় গতকাল রোববার থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
শাজাহানপুর থানায় হামলা: ভোররাতে উপজেলার প্রত্যন্ত বিভিন্ন গ্রাম থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল বের করেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। তাঁরা মাঝিড়া বন্দর ও থানার বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কে বিক্ষোভ করতে থাকেন। একপর্যায়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়।
সকাল সোয়া সাতটার দিকে জামায়াত-শিবির শাজাহানপুর থানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। এ সময় লাঠির আঘাতে ওসি মাহমুদুল আলমসহ সাত পুলিশ সদস্য আহত হন।
থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আতিয়ার রহমান জানান, হামলাকারীরা থানার সামনে থাকা পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করে। একপর্যায়ে তারা ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা অস্ত্রাগার লুটের চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। এঁরা হলেন সাজাপুর পশ্চিমপাড়ার মেহরাজের স্ত্রী আরজিনা বেগম (৪৫), ডোমনপুকুর গ্রামের তোতা মিয়ার স্ত্রী মঞ্জিলা বেগম (৩৮) একই গ্রামের মৃত মনছের আলীর স্ত্রী আছিয়া বেগম (৫০) ও বাকির উদ্দিনের পুত্র আবদুর রহমান (৬০) এবং আমরুল ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের আবদুল কাছির (৪৬)।
কাছির ছাড়া অন্য চারজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে পুলিশ। তবে শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইয়াছিন আলী ও আমরুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান কাছিরের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ ঘটনার পর পুলিশকে সহযোগিতা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেখানে টহলে যায় দুই প্লাটুন সেনাসদস্য। পরে সন্ধ্যায় তাঁদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। দুপুর দেড়টা থেকে উপজেলা সদরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
জেলা প্রশাসক সারোয়ার মাহমুদ জানান, শাজাহানপুর থানায় আক্রমণের পর পুলিশ ও থানা রক্ষা করতে সেনাবাহিনী যায়। সেনানিবাস এলাকায় শাজাহানপুর থানা হওয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থেই তারা সেখানে গিয়েছিল।
শিবগঞ্জে পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে হামলা: প্রথম আলোর প্রতিনিধি জানান, গতকাল ভোরের দিকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা মোকামতলা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে হামলা চালান। এ সময় সংঘর্ষে মুরাদপুর পশ্চিমপাড়ার দবির উদ্দিনের ছেলে দুলু মিয়া (৪৫) ও পারড়আচলাই গ্রামের লুৎফর রহমানের ছেলে জিয়াউল ইসলাম (৩০) নিহত হন। এই সংঘর্ষে বাবু মিয়া (১৮) ও আবদুর রশিদ (২০) নামের আরও দুজনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও শিবগঞ্জ থানার ওসি ফজলুল করিম তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ঘটনার পর মোকামতলা ও দেউলি ইউনিয়নে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
নন্দীগ্রামে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ: মধ্যরাতে উপজেলার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইক থেকে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুখ চাঁদে দেখা যাচ্ছে। এরপর ভোরের দিকে নন্দীগ্রাম বাসস্ট্যান্ডে বগুড়া-নাটোর মহাসড়কে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র হাতে অবস্থান নেয় জামায়াত-শিবির। একপর্যায়ে তারা মিছিল করতে করতে উপজেলা পরিষদে দুই দফা হামলা চালায়। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে এ হামলায় উপজেলা পরিষদ চত্বরে ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যানের কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকটি সরকারি দপ্তরের ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওর সরকারি গাড়িও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
হামলাকারীরা একপর্যায়ে উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল আশরাফ ও ইউএনও আসিব আহসানের বাসভবনেও হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এরপর নন্দীগ্রাম থানায় হামলা হয়। পরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহেদুর রহমানের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক তপন চন্দ্র ও উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলামের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। এসব ঘটনার পর বিকেলে উপজেলা সদরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
বগুড়ার পুলিশ সুপার মোজামেঞ্চল হক প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াত-শিবির বগুড়ায় যে তাণ্ডব চালিয়েছে তা একাত্তরের হানাদার বাহিনীকেও হার মানায়। থানা ও ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে পুলিশকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ি এমনকি বাদ যায়নি গণমাধ্যমের কার্যালয়ও।
তবে এসব ঘটনার সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জেলা প্রচার সম্পাদক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ হরতালের জন্য আসেনি। চাঁদে সাঈদীর মুখ দেখতে রাস্তায় নেমে আসে তারা। পুলিশ তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।’
বিষয়: বিবিধ
১৩০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন