এসব কীসের আলামত
লিখেছেন লিখেছেন ঢাকাটাইমস ২৬ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৫:২৫:০৫ বিকাল
‘৭৩ সালে ফেনী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সাংবাদিক এ বি এম মূসা। আওয়ামী লীগের টিকিটে। শুধু কি তাই; বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক হয়েছিলেন তিনি, বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় থাকাকালীনই। বঙ্গবন্ধুর সরাসরি হস্তক্ষেপে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি পদ দিয়েছিলেন। এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? মোটেও না। জাতির জনক বুঝেশুনেই সাংবাদিক এ বি এম মূসাকে কাছে টেনেছিলেন। প্রবীণ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক এ বি এম মূসা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম ধারক ও বাহক-বিষয়টি জাতীয়ভাবে স্বীকৃত। এনিয়ে কেউ কখনো কোনো প্রশ্ন তোলেননি। কিন্তু সেই স্পর্ধা দেখালেন একজন মাহবুব-উল-আলম হানিফ। যিনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীও বটে। কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এই সহ-সভাপতি যে এখন বিশেষ ক্ষমতাধরÑ এটিও এখন কারো অজানা নয়।
ক্ষমতার দাপটে প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক এ বি এম মূসাকে জনাব হানিফ বানিয়ে দিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী। বললেন, এ বি এম মূসা ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে হংকংয়ে গিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় অংশ নেন। শুক্রবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জনাব মাহবুব-উল-আলম হানিফ যেভাবে একজন প্রবীণ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিককে কটাক্ষ আর ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কথা বলেছেন তা নজিরবিহীন। অগ্রহণযোগ্যও বটে। কী কারণ? জনাব হানিফ তাঁর ব্যাখ্যায় বলেছেন, এ বি এম মূসা ‘বঙ্গবন্ধু তৃতীয় শ্রেণীর নেতা ছিলেন’ বলে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ, অশোভন কটূক্তি করেছেন তা নিতান্তই অনাকাক্সিক্ষত, দুর্ভাগ্যজনক। এই ব্যাখ্যায় আমিও ভড়কে যাই। বলে কি! মূসা ভাই বঙ্গবন্ধুকে তৃতীয় শ্রেণীর নেতা বলেছেন! এও কী সম্ভব? তন্ন তন্ন করে শুক্রবারের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা খুজলাম। জনকণ্ঠে এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। আমি জনকণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদটির প্রথম কয়েক প্যারা প্যারা হুবহু তুলে দিচ্ছি:
‘নানান আয়োজনে পালিত হলো উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান দিবসটি। বাঙালীর স্বাধীনতার প্রথম মাইলফলক হিসেবে পরিচিত এ দিনটিকে ঘিরে আলোচনা সভা, সেমিনার, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়।
গণঅভ্যুত্থানের আলোচনায় প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা বলেন, গণঅভ্যুত্থানে জন্ম দেয়া ছাত্রলীগের এখনকার জীর্ণ ও ভয়াবহ দশা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। এখনকার ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে সাবেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিব্রত হন। বর্তমান ছাত্র সংগঠনগুলোর শাখা এখন গণভবন থেকে তৈরি করে দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান দিবসে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ছাত্রলীগ শেষ হয়ে গেছে। আমরাও তো এক সময় ছাত্রলীগ করতাম। এ থেকে উত্তরণ খুবই জরুরি। প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা প্রতিবাদ করুন। আপনারা বলুন-ছাত্রলীগের নামটাকে তোমরা কলঙ্কিত করিওনা। প্রয়োজনে তোমরা একে ‘হাসিনালীগ’-‘বামলীগ’ নাম দাও।
এ বি এম মূসা বলেন, ঐতিহাসিক ৬ দফা ছাত্রদের সূচনা। আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ কর্তৃক সৃষ্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন তৃতীয় শ্রেণীর নেতা ছিলেন। নিজ গুণে তিনি এগিয়ে এলেন এবং ছাত্রদের চেষ্টাতেই তিনি প্রথম শ্রেণীর নেতা হলেন। বঙ্গবন্ধু যতটা না উর্বর মস্তিষ্কের নেতা ছিলেন, তার চেয়েও বড় ছিল তাঁর উপর জনতার বিশাল আস্থা।’
সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের দেওয়া বক্তব্য এবং ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানের আলোচনা সভায় তাঁর দেওয়া যে বক্তব্য জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছে সে ব্যাপারে জানতে চেয়ে মুঠোফোনে কথা বললাম মূসা ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু আমার প্রিয় মুজিব ভাই। তাঁর সঙ্গে কত স্মৃতি। তাঁকে আমি যতটা শ্রদ্ধা করি তার কি কোনো তুলনা আছে। আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই লিখেছি। আর তাঁকে ছোট করে কথা বলবো এ-ও কি সম্ভব? তাহলে জনকণ্ঠে তো ছাপা হযেছে আপনি বলেছেন,‘বঙ্গবন্ধু তখন তৃতীয় শ্রেণীর নেতা ছিলেন’। মূসা ভাই বলেন, আমি যেভাবে বলেছি ছাপা হয়েছে উল্টোভাবে। প্রবীণ এই সাংবাদিকের বক্তব্য, তিনি বলতে চেয়েছেন শেখ মুজিব নিজ নেতৃত্বের গুণে এক সময়ের থার্ড গ্রেডের নেতা থেকে প্রথম শ্রেণীর নেতা হয়েছেন। মূসা ভাই বলেন, ছাত্রলীগের এখনকার কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইতিবাচক অর্থেই তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গটি টানেন। কিন্তু তা যে এভাবে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে সেটি তিনি ভাবতেও পারেন নি।
মূসা ভাইয়ের এই ব্যাখ্যা কতটা গ্রহণযোগ্য তা বিচার করা আমার সাজে না। তবে এটুকু নিঃসন্দেহে বলতে পারি বঙ্গবন্ধুকে তৃতীয় শ্রেণীর নেতা বললে তাঁর আদর্শে বিশ্বাসী যে কেউ তো বটেই, কষ্ট পাবেন আরও অসংখ্য মানুষ। দুঃখে তাঁদের হৃদয়ে দহন হবেই। আমারও খারাপ লেগেছে প্রথমে একথা শুনে। কারণ যে মানুষটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি তাঁকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য! এটি মেনে নেওয়া যায় না।
কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দল, যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায়ও বটে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানালে অবশ্যই সে সম্পর্কে তাদের শতভাগ নিশ্চিত হওয়া উচিত। দুঃখজনক হলো এক্ষেত্রে সেটি হয়নি। মূসা ভাই ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার স্পিরিট কি ছিল সেটি বোঝার চেষ্টা করা দরকার ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের। কারণ মূসা ভাই তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করার চেষ্টা করবেন আর ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতারা তা চুপচাপ মেনে নেবেন সেটি আমার বিশ্বাস হয় না। আমি নিশ্চিত, এমনটি ঘটে থাকলে সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্রলীগের ওই সাবেক নেতারা ঘটনার প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু এমন কোন ঘটনা ঘটেনি।
তাহলে আওয়ামী লীগ কেন এমন ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাল? এই প্রশ্নই ঘুরেফিরে আসছে। এমন তো হতেই পারত আনঅফিসিয়ালি মূসা ভাইয়ের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন নেতা কথা বলতে পারতেন। জানার চেষ্টা করতে পারতেন যে পত্রিকায় মূসা ভাইকে উদ্ধৃত করে যা ছাপা হয়েছে আসলে কি তিনি সেটা বলেছেন? অথবা তাঁর বক্তব্যই বা কি ছিল? সেটি না করে একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক মূসা ভাইকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে বসল আওয়ামী লীগ। তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীও বানিয়ে দেওয়া হলো। বিষয়টি দু:খজনক।
‘৯৯ সালে এ বি এম মূসা একুশে পদক পান। তখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। জানতে ইচ্ছে করছে, কথিত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী একজনকে আওয়ামী লীগ সরকার কেন একুশে পদক দিয়েছিল?
শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেছেন, বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত এবিএম মূসা সাহেব বর্তমান সরকারের কাছে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমতি না পাওয়ায় তার ক্ষোভ ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া নানাভাবে ব্যক্ত করে চলেছেন। এটি হতেও পারে, নাও পারে। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ সরকার এই মেয়াদে যাদেরকে টিভি লাইসেন্স দিয়েছে তাদের যোগ্যতা কি? কেন তারা পেলেন আর এ বি এম মূসা পেলেন না এর উত্তর জানাও জরুরি। বিটিভির প্রথম মহাপরিচালক টিভি লাইসেন্স পান না অথচ গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্কহীন ঝুট ব্যবসায়ী, ভেজাল খাদ্য কারবারীরা অবলীলায় তা পেয়ে যান- এটিও বিস্ময়কর।
কিছুদিন আগেও এ বি এম মূসা একটি সরকারি সফরে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন। সম্ভবত মিশরের শার্ম আল শেখে। অথচ কয়েক মাসের ব্যবধানে তিনিই কি-না হয়ে গেলেন স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী। মাহবুব-উল-আলম হানিফের ভাষায়। আসলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলে যা কিছু তাই করা যায়, বলাও যায়। থানা পর্যায়ের নেতা থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদও পাওয়া যায়। কিন্তু চাইলেই একজন এবিএম মূসা হওয়া যায় না। দীর্র্ঘ পরিক্রমার মধ্য থেকেই এবিএম মূসা আজকের এই পর্যায়ে এসেছেন। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। সাংবাদিক সমাজের নমস্য তো বটেই, সমাজের বহু গুণীজনের ও অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র।
ইদানীং একটি বিষয় লক্ষণীয়। সমাজের বহু গুণী ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে কটাক্ষ করা হচ্ছে। সারা বিশ্বে সমাদৃত, দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর প্রথম শিকার। প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হককে নিয়েও তুচ্ছ,তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। এই তালিকায় আরও অনেকে আছেন। আমরা কোথায় যাচ্ছি? এসব কীসের আলামত!
আরিফুর রহমান
লেখক: সম্পাদক, ঢাকা টাইমস২৪.কম
ইমেল
লেখাটি এর আগে এখানে প্রকাশিত:
http://www.dhakatimes24.com/index.php?view=details&data=Host&news_type_id=1&menu_id=1&news_id=25334
বিষয়: বিবিধ
১২৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন