রক্তের রং কালো

লিখেছেন লিখেছেন হাফেজ আহমেদ ২৫ মে, ২০১৬, ১২:৫৬:৪৯ দুপুর

এক

হে স্বর্গ রানী,

আমার একলা রজনী

আজও কাটে তোমার ধ্যান মগ্নতায়।

সারাক্ষণ সারাবেলা রই তোমাতে বিভোর।

কালের পর কাল অনন্তকাল

আঁধারের ঘনঘটায় ক্ষত বিক্ষত

এই দগ্ধ বক্ষের স্পর্শে সেদিন তুমি এসেছিলে।

সেই তের তে নববর্ষের উৎসবে প্রথম দেখা

আর মনে মনে স্বপ্ন বুনে চলেছিলেম আমি একা,

বাবাকে শুধু একবার বলেছিলুম ১৭ মাইল দূরের সেই

রুপসির হাটখোলার পাশে ডাকপিয়নের বাড়ীর

স্বপ্ন রানীর নামটি।

অবশেষে ষোড়শীর ক্রোড়ে প্রনয় লগ্নে

সেই মিনিট তিনেক ২য় বারের দেখায় হৃদয়কে বলি দেয়া।

তারপর প্রতিমাসে একটি চিঠি

যা ছিল আমার প্রেরনার জ্বালানি।

দুই

আবার তুমি এসেছিলে তৃতীয় বারের মত

লাশের মিছিলে চিল শকুনের ছায়া পেরিয়ে।

তোমার শুভাগমনে অমবশ্যার রাত দিয়েছিল হাতছানি।

ঐ লাবণ্যময় মুখশ্রীর চাহনিতে,

জোৎসনামাখা হাসির খিলখিলানি আর

খুনসুটিতে সেদিন বড্ড নতজানু ছিল চাঁদের কিরণ।

দ্বীপ্রহর রাত্রিতে আমার স্বপ্নের পুস্পকাননে উঁকি দিয়েছিলে তুমি।

প্রবল প্রতীক্ষারর প্রহর যেন বিষাদ সিন্ধুর এক

বিস্তৃত প্রাচীর গড়েছিল বক্ষেে ।

সব কিছুর অবসান ঘটিয়ে হঠাৎ

তোমার নগ্ন পায়ে নূপুরের ঝংকারে চমকে উঠিয়া

শুনেছিলুম সেই কোমল হাতের কাকনের ঝুমঝুম ধ্বনি।

নৃত্যের তালে তালে

স্বর্গীয় আহলাদে মাতোয়ারা ছিল আমার সমস্ত হৃদয়।

তুমি এসেছিলে এলোকেশী অপ্সরী রুপে,

খোপায় ছিল না রক্ত জবা।

তবুও লজ্জায় লাল গালিচা যেন

সদ্য কাননে ফোটা টগবগে রক্তিম পাপড়ি।

নাকের ডোগার চিমচাম ঘাম যেন

পুস্প রেনুর মত উড়ো উড়ো ভঙ্গিতে উঁকি দিয়েছিল।

তোমার চুম্বনে সিক্ত ললাট ছুঁয়ে দিল আমার ঠোটের দু"পাট।

এই প্রশান্ত আত্মা হারিয়েছিলেম তোমাতে।

তোমার সেই তীক্ষ্ণ কোমল স্পর্শে

তীব্র উল্লাসে উল্লাসিত রোমাঞ্চে শীতলে শীতলে

সিক্ত হয়েছিল আমার সমস্ত কায়া।

ঠিক যেন হিমাদ্রীর ঐ রং তরঙ্গে মিশ্রিত

বালিরাশী হতে আবদ্ধ হওয়া শুষ্ক একটি বালিকনা

অবহেলায় সূর্য দহন সয়ে শত লাঞ্ছনার পর

একফোঁটা জ্বলের অমৃত সুধায় সিক্ত হল।

তোমার অভ্যার্থনায় নৃত্যের তালে তালে

আবারো ছুটেছিলুম তোমাতে।

নয়নে নয়ন রেখে কাছে আরো কাছে

তুমি আর আমি সাথে পুস্প কুঞ্জ,

হিমেল হাওয়া,

তারকারাজির খেলা,

চাঁদের হাসি আর জোনাকির মেলা।

এ যেন পৃথিবীর ইতিহাসে প্রেম লীলাময়

এক অদ্ভুত বাসর সাজিয়ে দিয়েছে বিধাতা তার এই নগণ্য বান্দার।

ধীরে ধীরে তোমার দু'চোখের পাপড়ি নিভে এল,

আর আমি পেয়েছিলুম সেই অমৃত সুবাস তোমাতে।

আমার বাম হস্ত তোমার মাথার উপর রেখে

অন্য হস্তে ঠিক যখন নাকের ঘাম স্পর্শ করলুম,

মুহুর্তেই ধোঁয়াশার ধুম্রজালে একাকার হয়ে

আমার পৃথিবী ডুবে যায় গহিন অন্ধকারে।

রজনী তিমিরে নিমজ্জিত হয়ে ঢেকেছিল সমস্ত অচলা।

মেঘাচ্ছন্ন আকাশের হুংকারে কেঁপেছিল এ ধরা।

প্রবল বেগে চারিদিকে বইছে ঘূর্ণি।

ধমকা হাওয়ার ঢেউ যেন আজ

অন্ধকার পৃথিবীকে উড়িয়ে নেবে ঐ দক্ষিণ সাগরে।

একনিমিষেই হারিয়ে গেল চাঁদ তারা জোৎসনারা।

কোন যুগে এ ধরায় জোনাকির অস্তিত্ব ছিল বলেও

আজ অনুমান করা মুসকিল।

আস্তে আস্তে থর থর করে নিচে নেমে এল আমার দু'হাত।

কাঁপা কাঁপা সুরে বারবার

স্বর্গ রানীকে ডাকতে গিয়ে হয়েছিলুম বাকরুদ্ধ।

আঁধার রাজ্যে দু'হাত বাড়িয়ে খুঁজতে গিয়ে

থমকে দাড়িয়েছিলুম।

অন্ধকারাচ্ছন্ন শর্বরীর এই পুস্প বেদীতে আমি একেলা

তুমি নেই তুমি নেই কোথাও।

প্রলয়কারী সিডরের ঐ ভয়ংকর আঘাতে

সর্বহারা করে তছনছ করে দিয়েছে বক্ষ।

হাহাকার,

রুদ্ধ শ্বাস,

তপ্ত হৃদয়,

ক্লান্ত শরীর,

ঘর্মাক্ত কপাল একাকার।

হতভাগার কাঁপা কাঁপা দু'হাত

রক্ত ললাটে প্লাবিত আঁখিপাতের কোমল ছোঁয়ায় সিক্ত।

যত জল ছিল দু চোখের শুকিয়ে গেছে সেই চৈএের খরায়।

আজ হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ বইছে আঁখি স্রোতে।

রক্তের রং আমি সেদিন কালো হতে দেখেছি

তবে দেখতে পাইনি সেই

গহিন আধারে ডুবে থাকা আমার দু'হাতের ছাঁয়াটুকুও।

শীশাঢালা প্রাচীরর ন্যায় প্রবল ঘূর্ণিতে দাঁড়িয়েছিলুম।

লোমগুলো তখনো স্থির হয়নি।

সে দিনের বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় মিশ্রিত ছিল

এই হৃদয়ের রক্ত ক্ষরন আর কপালের ঘাম।

যা ঝরছে আজো অঝোরে।

তিন

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মৃত্যুন্জয়ী

গাজী হয়ে ফিরে এসে পাইনি তোমায়।

লাশের পল্লীতে শত শত চীল শকুনের ভীড়ে

এক একটি শব স্বহস্তে সরিয়ে

মরা পচা লাশের ভীড়ে পাইনি তোমার গন্ধ।

লাশের স্তুপ হতে শহিদানের দেহ আর

রক্তের পচা গলা কালো রসের সাগর দেখছি।

দেখিনি তোমার চিন্হ।

প্রনয় রজনীতে আংটি পরাতে পারিনী তোমায়,

প্রনয় লগ্নেই রণতরী ভিড়েছিল তীরে এসে।

টলমলিয়ে ক'ফোটা টাটকা ঝলমলে অশ্রুজলে

হাসিমুখে নব বধূর হাতছানি আজও বৃষ্টি ঝরায় দু'চোখে।

শুকিয়ে শুটকি হয়ে কবেই ছাই হয়ে গিয়েছিল রক্ত গোলাপ,

তুলে দিতে পারিনী তোমার হাতে।

পেরেছি তোমার স্বপ্নের

স্বাধীন বাংলার পতাকা ছিনিয়ে আনতে,

তবে ফিরে এসে পাইনি তোমায়।

জানিনা হে স্বর্গ রানী,

তুমি কোথায় আছো কোন অজানায়।

কোন শকুনে ছিড়ে খায়নিতো তোমায়?

আজও লাঠি হাতে ঘোলা চোখে

তোমার চিঠির স্পর্শে চশমা ভেজে যায়।

যুদ্ধ শেষের তিন মাস আগে

যখন তোমার চিঠি পাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল

আমি তখনও ফিরে আসার চিন্তা করিনি

কারন তুমি শুধু আমার আর আমি শুধু তোমার

কিন্তু এই জন্মভূমি আমাদের দু'জনার।

আজ তোমার জন্য স্বাধীন বাংলার পতাকা এনে

প্রহর গুনছি তোমার অপেক্ষায়।

আমি আছি আজ তোমার স্বপ্নের সেই স্বাধীন দেশে

কিন্তু তুমি নাই তুমি নাই।

আছে শুধু স্বাধীন পতাকা আর মুক্ত আকাশ।

নীল আকাশের বুকে আজও স্বাধীনভাবে

পাখনা মেলে উড়ে বেড়ায় সেই চীল শকুনের দল।

ইচ্ছে করে উড়ে যাই ঐ নীল আকাশের পানে,

খামচে ধরি পাষাণ্ড শকুনের কলিজায়।

চাবুকের আঘাতে খন্ড খন্ড করে দেই ঐ পাপিষ্ঠ বক্ষ।

দেখি তুমি কোন শকুনের পেটে।

উড়তে গিয়ে দাড়াতেই দেখি

এই বৃদ্ধার চশমাটি ভেঙে খানখান।

আজও উড়ছে তোমার স্বপ্নের

স্বাধীন বাংলার মুক্ত আকাশে চীল শকুনের দল।

মেতেছে নতুন খেলায়।

জানিনা এবার আঘাত করে কোন মায়ের কলিজায়।

বিষয়: বিবিধ

১১৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File