শিশুদের কুরআন শিক্ষা - ভাবনার বিষয়
লিখেছেন লিখেছেন কানিজ ফাতিমা ২৫ মার্চ, ২০১৫, ০৪:১৯:১৭ রাত
সচরাচর মুসলমানেরা তাদের শিশুদের ছোটবেলা থেকেই শুধু জাহান্নামের আগুনের ভয় দেখান, কিন্তু আল্লাহর ভালোবাসা, দয়া এবং সমবেদনা অথবা জান্নাতের সৌন্দর্যের কথা সেভাবে তুলে ধরেননা । আমরা শিশুদেরকে ভয় যতটা জোর দিয়ে দেখাই যে তারা যদি আল্লাহর অমান্য করে, মা-বাবার কথা নাশুনে , বা পাপ কাজে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের দোজখের আগুনে জ্বালানো হবে; ততটা তাদেরকে আশাবাদ দেই না যে তারা যদি সৎ কাজ করে, আল্লাহ ও মা-বাবাকে মান্য করে এবং কোনো ভালো কাজ করে তবে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে। আমরা সবসময় তাদেরকে ভয় দেখাই, জাহন্নামের হুমকি দেই অথচ খুব কমই তাদেরকে সাহস যোগাই অথবা ভালো আচরণের জন্য আল্লাহ’র ভালোবাসার কথা, পুরুষ্কারের কথা উল্লেখ করি। এমন পরিবেশে, শিশুরা আতঙ্কগ্রস্ত ও ভীতু হিসাবে বেড়ে উঠে। ফলে তাদের মধ্যে নেতীবাচক মানসিকতা জন্মায় এবং আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয় এবং তদেপেক্ষাও খারাপ যে তারা তাদের বিশ্বাসের প্রতি নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে।
শিক্ষকরা সাধারণত: কুরআনের শেষ অধ্যায় থেকে (ত্রিশ পারা) শিশুদের পড়ানো শুরু করে। এই অধ্যায় ছোট ছোট সূরা সম্বলিত যেগুলো ওহী আসার প্রাথমিক পর্যায়ে মক্কায় নাযিল হয়। মূলত কুরাইশ গোত্রের বিপথগামী, অহংকারী এবং অত্যাচারী পৌত্তলিক নেতাদের (আবু জেহেল, আবু লাহাব) উদ্দেশ্যে এই সূরা গুলো নাযিল হয়েছিলো। তাছাড়া যারা মুসলমানদের অত্যাচার করছিলো, মুসলমানদের মধ্যে থেকে কয়েকজনকে হত্যা করেছিলো, নবীজী (সাঃ)কে হত্যার পরিকল্পনা করছিলো এবং বিশ্বাসীদের ধ্বংস করতে যুদ্ধ বাধিয়ে ছিলো-কুরআন নাযিলের সূচনার অধ্যায়গুলো মুলত তাদের উদ্দেশ্যেই। এই সূরা গুলো এসব অত্যাচারীদের তাদের হুশ/জ্ঞান ফিরিয়ে আনার জন্য ছিলো। এদিকে আয়াতের দৃঢ় কথাগুলো তাদের কানে বজ্রধ্বনি হিসাবে কাজ করতো কারণ আয়াতগুলো ভয়ানক সতর্কবার্তা সম্বলিত ছিলো। যেমন নিচের আয়াতগুলো-
“আবু লাহাবের হস্তদ্বয় ধ্বংস হোক এবং ধ্বংস হোক সে নিজে” (সূরা লাহাব, ১)
“প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ” (সূরা হুমাজাহ, ১)
“আপনার কাছে আচ্ছন্নকারী কেয়ামতের বৃত্তান্ত পৌঁছেছে কি? অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে লাঞ্ছিত, ক্লিষ্ট, ক্লান্ত। তারা জ্বলন্ত আগুনে পতিত হবে। তাদেরকে ফুটন্ত নহর থেকে পান করানো হবে। কন্টকপূর্ণ ঝাড় ব্যতীত তাদের জন্যে কোন খাদ্য নেই” (সূরা গাসিয়া, ১-৬)
“যারা মাপে কম করে, তাদের জন্যে দুর্ভোগ (সূরা মুতাফফিফিন, ১)
“বলুন, হে কাফেরকূল” (সূরা কাফিরুন, ১)
“যখন পৃথিবী তার কম্পনে প্রকম্পিত হবে” (সূরা যিলযাল, ১)
এটা খুবই দুঃখজনক যে এসব কঠিন বার্তা কোমলমতি শিশুদের উদ্দ্যেশে নাযিল না হলেও এগুলোই শিশুদের সর্বপ্রথম শিখানো হয়। হ্যা, প্রথমেই এ সূরাগুলো শিখানোর একটা কারণ হচ্ছে এগুলো ছোট এবং সহজে মুখস্ত করা যায়। তবুও শিশুদের এ বয়সে জাহান্নাম ও শাস্তির ভয় দেখানোর বদলে আমাদের উচিত তাদেরকে আল্লাহর ভালোবাসা, মা-বাবার দয়া এবং জান্নাতের সৌন্দর্য প্রভৃতি বিষয়ে বুঝানো।এর ফলে শিশুকাল থেকে তাদের মনে নিরাপত্তার অনুভুতি, ভালোবাসা, দয়া, কোমলতা, মহত্ত্ববোধ, উদারতা এবং সহানুভুতি প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যগুলো ধীরে ধীরে প্রবেশ করবে। আল্লাহর ভালোবাসা, দয়া, মমতা, ক্ষমাশীলতা, ধৈর্যশীলতা এবং উদারতা ইত্যাদি আল্লাহর সুন্দর গুণাবলীগুলোর শিক্ষার মধ্য দিয়েই শিশুদের প্রথম পাঠ শুরু করা উচিত। প্রথমে তাদের মনে এই বিশ্বাস দিতে হবে যে তারা ভালো এবং আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন। এরপর তাদেরকে শেখাতে হবে যে তাদেরও উচিত আল্লাহকে ভালবাসা। শিক্ষার ক্রমটি এমন হতে হবে যে , প্রথমত তাদের প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা সম্পর্কে তাদের অবগত করা, তারপরে তাদেরকে আল্লাহকে ভালোবাসতে হবে সেই বাধ্যবাধকতা শেখানো।
এরপর যখন সন্তান কিছুটা বড় হবে এবং বুঝতে শিখবে, তখন মা-বাবা ধীরে ধীরে তাদেরকে খারাপ কাজের জন্য জাহান্নামের শাস্তির কথা বলতে শুরু করবেন। যেসব সূরাগুলো বড় বড় গুনাহের জন্য শাস্তির আগাম সতর্ক বার্তা দেয়- সেসব সূরাগুলো এসময় শুরু করা উচিত, যাতে তারা এসব থেকে ভয়ে সন্ত্রস্ত না হয়ে বরং শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।এটা তাদের শৈশবের শেষ পর্যায় কিংবা টিনেজ (১৩-১৯) বয়সের দিকে হতে পারে যখন তারা কিছুটা বড় হয়েছে এবং কিছুটা জটিল বিষয়গুলো ও কর্মের ফলাফল বুঝতে সক্ষম।
কুরআনের শিক্ষা দেবার সময় আমদের সচেতন থাকতে হবে যে আমরা শিশুর দর্শন ও মানসিকতাকে কিভাবে তৈরী করছি। এটা আবশ্যক যে, শিশুদের বেড়ে উঠার সাথে সাথে বাবা- মাকে সচেতনতার সাথে তাদের বয়সের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সুরা বা আয়াত নির্ধারণ করতে হবে।রাসূলুল্লাহ সাঃ এর বেশির ভাগ সাহাবী তাদের প্রপ্তবয়সে (শিশু বয়সে নয়) কুরআনের সাথে পরিচিত হন। সেই বয়সে কুরআন তাদের ওপর অভূত প্রভাব ফেলেছিলো। কুরআন তাদের চরিত্রকে আরো বেশী মজবুত ও সাহসী করেছিল এবং তাদেরকে উচ্চতর নৈতিকতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলো। শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাবিদ, সামাজিক বিজ্ঞানী ও কুরআন বিশেষজ্ঞরা মিলে কুরআন শিক্ষার একটা ক্রম ঠিক করা জরুরী যাতে অভিভাবকরা কিভাবে সন্তানদের বয়স অনুযায়ী তাদেরকে আয়াত বা সুরা শিক্ষা দিবেন সেটা জানতে পারেন। এটা অনস্বীকার্য যে ব্যক্তিজীবনে কুরআনের সবগুলো আয়াতেরই শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।তবে প্রশ্ন হলো কোন ক্রম বা ধারায় এটা শেখা বেশী কার্যকর? কোন আয়াত বা সুরাগুলিকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে এবং কোন বয়সে কোন আয়াতের শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন? ৩৭টি ছোট সূরা আছে বলেই প্রথমেই সম্পূর্ণ ৩০ পারা দিয়ে শুরু করা নিঃসন্দেহে উপযুক্ত নয়। তাছাড়া কেবলমাত্র মুখস্ত করার ক্ষেত্রে সহজতার ভিত্তিতে সূরা বিবেচনা করা সঠিক পন্থা নয়। - Translation Parent-Child Relations.
-------------
" শিক্ষাবিদ, সামাজিক বিজ্ঞানী ও কুরআন বিশেষজ্ঞরা মিলে কুরআন শিক্ষার একটা ক্রম ঠিক করা জরুরী যাতে অভিভাবকরা কিভাবে সন্তানদের বয়স অনুযায়ী তাদেরকে আয়াত বা সুরা শিক্ষা দিবেন সেটা জানতে পারেন।" - কেউ কি আছেন এই গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টটি হাতে নেয়ার ?
বিষয়: বিবিধ
১৬৮৬ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
,
ছোট্ট শিশুকে কি কোরআনের অর্থসহ পড়ানো হয়? নাকি সে তখন অর্থ অনুধাবন করার সামর্থ রাখে? রিডিং পড়ানো, মুখস্ত পড়ানো করানোর জন্য বড় সূরার চাইতে ছোট উপযোগী, তাই ছোট সূরা দিয়ে শুরু করে, কিন্তু যখন সে বুঝতে শিখে, অর্থস পড়তে পারে, তখন তাঁর পড়ায় ভারসাম্য আনা উচিত। শুধু জাহান্নাম সম্পর্কিত আয়াতগুলো যেমন পড়ানো উচিত নয়, তেমনি জান্নাত সম্পর্কিত আয়াতগুলোতে জোর দিতে গিয়ে জাহান্নাম সম্পর্কিত আয়াতগুলো এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়, যেমন আমরা জান্নাতে বড় বড় মুরগীর রান খাওয়ার লালসে নামাজ পড়ি, জাহান্নামের ভয় না থাকায় ইবাদতসমূহ হালকাভাবে পালন করি।
আমি মনে করি, শিশুদের মনে ভাল কাজের বিনিময়ে জান্নাতের দারুণ সব পুরুষ্কারের বর্ণনা, পাশাপাশি এও স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, এই কাজগুলো যদি না করে, তাহলে পুরুষ্কার নয়, পাবে শাস্ত তা মনে ঢুকিয়ে দেয়া।
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : আপনি যথার্থই বলেছেন, ছোট বয়সে বাচ্ছাদের বেশি বেশি আজাবের ভয় দেখানো উচিত নয় কিন্তু প্রয়োগ কি আসলে সেরকম হচ্ছে?
ছোট্ট শিশুকে কি কোরআনের অর্থসহ পড়ানো হয়? নাকি সে তখন অর্থ অনুধাবন করার সামর্থ রাখে? রিডিং পড়ানো, মুখস্ত পড়ানো করানোর জন্য বড় সূরার চাইতে ছোট উপযোগী, তাই ছোট সূরা দিয়ে শুরু করে, কিন্তু যখন সে বুঝতে শিখে, অর্থসহ পড়তে পারে, তখন তাঁর পড়ায় ভারসাম্য আনা উচিত।
সাকা'র সাথে সম্পূর্ণ একমত। ধন্যবাদ।
তাই বুঝের বয়স হলে সর্বক্ষেত্রেই ক্বুরআনকে অনুসরন করাতে ও করতে হবে । তাহলে একজন ভাল কাজের পুরষ্কার ও মন্দ কাজের শাস্তির ব্যাপারে ছোটকাল থেকেই বেসিক ধারনা লাভ করবে যেটা তাকে আল্লাহর রহমতে সঠিক পথে থাকতে সাহায্য করবে ।
আমাদের সময়ে যদিও ইসলাম ধর্ম শিক্ষা নামে একটা সাবজেক্ট ছিল (৩য় শ্রেনী থেকে দশম শ্রেনী পর্যন্ত), এস.এস.সি তে পূর্ণ ১০০ মার্কের । সেখানে ইসলামের বেসিক জিনিসগুলো ছিল ।
তাছাড়া পাড়া ও মহল্লায় মক্তব ছিল যেখানে ক্বুরআন শিক্ষা দেওয়া হত ছোটদের ।
তখনকার পরিস্থিতি এমন ছিল যে শিশুদের বেসিক ধর্মীয় জিনিসগুলো ধরিয়ে দেওয়া যেত এবং সে রকম পারিবারিক পরিবেশও ছিল । উচ্ছৃঙ্খলতা ও বিশৃঙ্খলতা তখনও ছিল , তবে এখনকার কত এতটা মারাত্মক ছিল না ।
এখন এসব মক্তবগুলো হয়ে গেছে সাংষ্কৃতিক বা ক্রীড়া সংঘের ক্লাব ঘর আর শিক্ষা কার্যক্রম হতে ধর্মীয় শিক্ষা উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ।
যেহেতু ইসলামেই প্রকৃত শান্তি নিহিত সেহেতু ইসলাম শিক্ষার বাইরে যাবার ফল আমরা পাচ্ছি এখনকার অস্থির ব্যক্তিগত ,পারিবারিক ,সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে।
পৃথিবীর বাদ বাকি বিধর্মী দেশগুলোতে এসব পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি অনেক আগেই চলে গেছে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে প্রাধান্য দেবার সাথে সাথেই ।
১-শিশুরা যারা অর্থ বুঝেনা বা অর্থসহ তেলাওয়াত করেনা তাদেরকে ৩০তম পারা দিয়ে শুরু করাতে কোন সমস্যা নেই। বরং এটাই করা উচিৎ।
২- কুরআনে আল্লাহ তায়ালা যেখানেই আযাব/ভয়ের কথা বলেছেন তার সাথেই আবার পুরস্কারের কথাও বলেছেন। শুধু ভয় দেখিয়েই থেমে যাননি।
৩-বাচ্চারা বিশুদ্ধ তেলাওয়াত শিখার পরের ধাপে তাদের বয়সের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিষয় ভিত্তিক আয়াত অর্থসহ পড়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি শিশুদের জন্য লেখা কুরআনে বর্ণীত বিভিন্ন কিসসা-কাহিনীর বই তাদেরকে পড়ানো যেতে পারে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন