ছোবাহান হুজুরের ত্রিশ বছর

লিখেছেন লিখেছেন কানিজ ফাতিমা ১৯ জুন, ২০১৪, ০২:১৮:৩০ দুপুর

" আল্লার দুনিয়া, না দেখলে তার সৃষ্টির মহিমা বুঝতানা মিয়ারা, নাগরা ফল - পানি পড়তি না পড়তি মেঘ হই উরি যায়, সুবাহান আল্লাহ "- ছোবাহান হুজুরের দিকে চোখ গোল গোল করে থাকা কয়েকশ মানুষ নির্বাক হয়ে শোনে হুজুরের দুনিয়া দেখার কাহিনী। আল্লাহ হুজুরের উপর বড়ই মেহেরবান, এমন নেয়ামত এই গ্রামের আর কারো নসিবে জুট নাই।

দুখাইনগর গ্রামের মাদ্রাসার সেরা ছেলে ছোবাহান, মাদ্রাসা শেষ করতে না করতেই পাশের সুফিপুর গ্রামের বড় মসজিদের ইমামের চাকরী পেয়েছিল। পাবেই বা না কেন ? যেমন মেধাবী তেমন সৎ - ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায় তার প্রতিকৃত যেন। দশ গায়ের মানুষ ইসলামের জ্ঞান নিতে তার কাছেই ছোটে। তার চেয়ে ইসলামের নিয়ম নীতি দশ গায়ে আর কেউ বোঝেনা। কিন্তু ....

কিন্তু আবার কি ? চরিত্রে সৎ, আরবী লাইনের পাশের কাগজ - তার আবার কিন্তু কি ?

চলুন ফিরে দেখি গত ত্রিশ বছরে -

সেই বছর সুবাহান হুজুরের ঘরে এলো প্রথম পুত্র সন্তান। ভালো বউ পেয়েছেন হুজুর, লেখা পড়া বেশীদুর করে নাই কিন্তু মাথা পরিস্কার। তার ওপর ঘরও ভালো, শশুর-শাশুরী সবাই অমলদার , শুধু বড় শালাটা একটু অন্যরকম। মানুষ খারাপ না, তবে বেআদব। অন্যদের মত হুজুরের কথা হরফে হরফে পালন করে না। বিয়ের পরই হুজুর টের পেয়েছিলেন সে বিদেশে যাবার পায়তারা করছে। হুজুর অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এমন কাজ যেন সে ভুলেও না করে। হুজুর শুনেছেন ঐসব দেশে সব ক্রিস্টান , ইহুদী- নাছারা থাকে। "কী বিপদের কথা ? কাফের - বেইমানদের দেশে যাবা? যেদেশে আল্লা- রসুলের নাম নাই সে দেশে গেলে ঈমান থাকব ? যেদেশে মসজিদে আজান হয়না সেদেশ তো শয়তানের আস্তানা। শুনছি ঐসব দেশের বেহায়া বেপর্দা মেয়েলোক গিজ গিজ করে -নাউজুবিল্লাহ। এইসব দেশে যাওয়া হারাম। "

এত সাবধান করার পরও কাজ হয় নাই, হুজুরকে না জানিয়েই শালা পাড়ি দিয়েছে বিদেশে। হুজুরও কম যান না। "এত বড় আস্পর্ধা ? আল্লা- রাসুলের নির্দেশ অমান্য করা ?" সাফ সাফ স্ত্রীকে জানিয়ে দিলেন এমন ভাইয়ের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখা চলবে না। নুহ আ: নিজের ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন; আর সেতো কেবল ভাই।

স্ত্রী হালিমা একটু মিন মিন করে বলতে চেয়েছিল, " নুহ অ: এর ছেলেতো বেইমান ছেলো , আমার ভাই তো মুসলমান " ; সাহসে কুলায়নি। বুকটা চন চন করে ভাইয়ের জন্য হালিমার । কিন্তু মুখে কিছু বলে না;পাছে স্বামী নাখোশ হয়। ছোবাহান হুজুর বলেছে কোনো স্ত্রীর ওপর স্বামী নাখোশ হলে লাখে লাখে ফেরেশতা সেই স্ত্রীলোকের ওপর গজব দিতে থাকে, আর তার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে নালিশ করতে থাকে। এতে আল্লাহর ক্রোধ উদ্রেক হয়। যতক্ষণ না স্বামী খোশ হন ততক্ষণ আল্লাহও খোশ হন না। তাই ভাইয়ের কথা বলে আল্লাহকে নাখোশ করতে হালিমা চায় না , শুধু গোপনে অচল দিয়ে চোখ মোছে।

একদিন সোলায়মান হুজুরই তাকে বয়ান করেছিলেন "বিয়ের পর মাইয়া লোকের শাশুরীই হইলো মা। তার সেবায় যাতে কোনো ত্রুটি না হয়। শোনো, আয়েশার (রা) মা কাফের-মুশরিক ছিল, তার পরও আল্লার রাসুল বলেছেন তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেন্ন না করতে।....... ". আচ্ছা তাইলে ভাই বিদেশ গেল বইলাই তার সঙ্গে সম্পর্ক কেন রাখতে পারতাম না ?

"আস্তাগফিরুল্লা, আস্তাগফিরুল্লা - এইসব চিন্তা হইল শয়তানের ধোকা, অসওসা" - হালিমা মনকে ভাইয়ের চিন্তা থেকে সরিয়ে অন্যদিকে নেয়ার চেষ্টা করে। "হুজুরের কথা হইলো আল্লা- রসুলের কথা, যুক্তি চিন্তা এইসব জিনিস এইখানে খাটে না। মাথা খাটাইতে হইব খালি দুনিয়াবী কাজ কর্মে। হালিমা মনে মনে ভাবে - তাছাড়া মানুষটা খারাপ না , তয় খালি তার কথা না লইলে ধমকায় "আল্লা-রাসুলের চাইতে বেশী বোঝো ?" কোনটা যে আল্লা- রাসুলের কথা আর কোনটা যে হুজুরের নিজের বুঝের কথা ভাবতেই হালিমার চিন্তা খালি প্যাচ খায়।

পচিশ বছর পরের কথা -

ছুবাহান হুজুরের ছেলেটা মাসাল্লাহ ভালো মাথা পেয়েছে। পড়তে পড়তে দেশের সব পড়া শেষ করে ফেলেছে। দেশে আর কোনো পড়া নাই , তাই ছেলে নাকি এখন বিদেশে যাবে পড়তে। নিজের পয়সা দিয়ে পড়ানোর সমর্থ হুজুরের নাই, বিদেশীরাই নাকি ছেলের পড়ার খরচ দেবে। যে পয়সা দেবে তাতে ছেলে নাকি বাড়ীতেও মাসে মাসে টাকা পাঠাতে পারবে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর নেয়ামত যেন ফেরেশতারা আকাশ থেকে বৃষ্টির মত ঢালতেছে ।

হালিমার মন খচ খচ করে। " এই বিদেশের লাগি ভাই হারাইছি, এইবার বুঝি বুকের ধন হারাই "।হুজুর সান্তনা দেন, "অত ভাবিও না, আল্লার উপর তাওয়াক্কুল কর, ঈমান শক্ত কর। রাসুল আল্লাহ বলেছেন জ্ঞানের জন্য চীন পর্যন্ত যাও। লেখাপড়ার জন্য , ইসলামের দাওয়াতের জন্য বিদেশ যাওয়া সুন্নত।"

হালিমার মন মানে না, ঘন ঘন দীর্ঘশাস ছাড়ে আর অচল দিয়ে চোখ মোছে।

এভাবেই পাচ বছর কেটে যায়। এরমধ্যে ছেলে লেখাপড়া শেষ করে বিদেশে চাকরী পেয়েছে। এবার ছেলে বায়না ধরেছে বাবা মাকে নিজের কাছে কয়দিন এনে রাখবে ।

ছোবাহান হুজুর আর হালিমা প্রথমবারের মত বিদেশ দেখে, দেখে বিশাল পানির স্রোত নায়াগ্রা ফলস , দেখে স্রষ্টার বিচিত্র সৃষ্টি।

দেশে ফিরে দশ গ্রামের মানুষকে শোনায় সেসব কাহিনী, বলে "এজন্যই রাসুল সা বলেছেন বিদেশ ঘোরো, আল্লাহর মহিমা দেখো, এতে ঈমান মজবুত হয়। " বৃদ্ধা হালিমা দরজার আড়ালে বসে শোনে - তার চোখে ভেসে ওঠে বহুদিন না দেখা ভাইয়ের মুখের ছবি।

বিষয়: বিবিধ

১৪০৬ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

236511
১৯ জুন ২০১৪ দুপুর ০২:২৯
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
236531
১৯ জুন ২০১৪ দুপুর ০৩:৫২
মাটিরলাঠি লিখেছেন :
"নাগরা ফল - পানি পড়তি না পড়তি মেঘ হই উরি যায়," - পড়ার শুরুতে সত্যিই বুঝতে পারিনি এটা কি ধরনের ফ্রুট (ফল)? Angel
২৩ জুন ২০১৪ রাত ০৪:৩৬
184328
কানিজ ফাতিমা লিখেছেন : Winking)
২৪ জুন ২০১৪ রাত ০৮:৪৫
184903
মোস্তাফিজুর রহমান লিখেছেন : আমার্ও একই দশা!
236540
১৯ জুন ২০১৪ বিকাল ০৪:৩৫
গ্যাঞ্জাম খানের খোলা চিঠি লিখেছেন : ভালো লাগলো পিলাচ অনেক ধন্যবাদ
236596
১৯ জুন ২০১৪ রাত ০৯:২২
হতভাগা লিখেছেন : আর এজন্যই স্ত্রীরা কোথাও বেড়াতে যাবার সময় উতফুল্ল থাকে
236604
১৯ জুন ২০১৪ রাত ০৯:৪১
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
237006
২১ জুন ২০১৪ রাত ০১:০৬
আবু সাইফ লিখেছেন : উহ্হ.. যা একখান লিখেছেন!!
জাযাকিল্লাহ...


কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে লেখা/বলা, সেই 'ছোবাহান হুজুর'দের স্ববিরোধিতা কিম্বা 'হালিমা'দের 'ভাই-হারানোর কষ্ট' আজো কি কিছুমাত্র কমেছে??

এখনো তো ডানে-বাঁয়ে অসংখ্য হালিমাদের দেখি- 'ছোবাহান হুজুর'দের হুঁশ ফেরে ঠিকই, কিন্তু বড্ড দেরীতে!!
২৩ জুন ২০১৪ রাত ০৪:৩৬
184327
কানিজ ফাতিমা লিখেছেন : :Thinking
237018
২১ জুন ২০১৪ রাত ০১:৩৩
কানিজ ফাতিমা লিখেছেন : পাঠকদের উদ্দেশে -

এ গল্পটি পড়তে গেলে তিনটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে -

১. ছোবহান হুজুরএর ব্যক্তি চরিত্র ভালো, সমস্যা তার জ্ঞানে।
২. ত্রিশ বছর আগে তিনি যা হারাম বলেছেন , নিজের সন্তানের প্রয়োজনে পচিশ বছর পরে তিনি তাকে সুন্নাত বলেছেন - আর আজ নিজে যখন জানলেন তখন বলছেন ঈমান বৃদ্ধির উপায়। এবং তিনটি ক্ষেত্রেই তিনি ইসলামের ররেফারন্স টেনেছেন ( যদিও ভুলভাবে )

৩. তিনি নিজের মতামতকে "আল্লাহ -রাসুলের কথা " বলেন। তিনি "আলেমদের মতামত " আর "আল্লাহ রাসুলের কথা" এই দুটো ব্যাপারকে গুলিয়ে ফেলেছেন। মানুষের ভিন্ন মতকে তিনি "আল্লাহ রাসুলের সঙ্গে বিদ্রোহের " সঙ্গে তুলনা করছেন।
২৩ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৫২
184546
আবু সাইফ লিখেছেন : এ অংশটুকু ফুটনোট আকারে মূলের শেষে জুড়ে দিলেই বোধ হয উত্তম হতো..
237024
২১ জুন ২০১৪ রাত ০১:৫৯
ভিশু লিখেছেন : অত্যন্ত চমৎকার শিক্ষণীয় একটি কাহিনী! এত্ত সুন্দর করে লিখেন আপনি!...Day Dreaming খুব ভালো লাগ্লো! আর ৩০ জুন সোমবার সূরা আত্ব-ত্বাওবা: ৭১-৭২ আয়াতের উপর আপনার বিশেষ উপস্থাপনা শুনার অপেক্ষায় রইলাম! শুকরিয়া আপুজ্বি...Praying Happy Good Luck
237464
২২ জুন ২০১৪ দুপুর ১২:৪০
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : অসাধারণ শিক্ষণীয় গল্প।
২৩ জুন ২০১৪ রাত ০৪:৩৫
184326
কানিজ ফাতিমা লিখেছেন : Happy
১০
237768
২৩ জুন ২০১৪ সকাল ০৫:৪৯
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : এ ধরনের হুজুরদের সম্পর্কে একটা কথা প্রচলিত আছে 'আমরা যা বলি তোমরা তা কর, আমরা যা করি তোমরা তা করনা Happy Angel সোবহান হুজুরদের মত লোকেরা না জেনে অন্যের উপর ফতোয়া জারী করতে পছন্দ করেন। এভাবেই তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে ভাগ্যবিধাতা বনে যান যেখানে নিজের পরিবারই ইসলামের আলো থেকে অনেক দুরে থাকে। সমাজের কুসংস্কারগুলো দূর করার জন্য সোবহান হুজুরদের আগে অর্থসহ কোরান পড়া উচিত।

গল্পের মাধ্যমে সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। ভালো লাগলো। নিয়মিত লিখবেন Good Luck Rose Happy

১১
237790
২৩ জুন ২০১৪ সকাল ০৮:২৬
সরল কথা লিখেছেন : বাস্তবতার সরল প্রকাশ !

চমৎকার।
১২
238457
২৪ জুন ২০১৪ রাত ০৮:৩৯
প্রবাসী মজুমদার লিখেছেন : গল্পে ঠিক কথাটা তুলে ধরেছেন। নজরুল রবীন্দ্রণাত পড়লে কাফের হয়ে যাবো। এ বিশ্বাসযে আমাদেরকে কত ক্ষতি করেছে তা বলা বাহুল্য। তাই আমাদের বিশ্বাসের ভীতটাই মুলত ঠিক করতে হবে। ধন্যবাদ।
১৩
238462
২৪ জুন ২০১৪ রাত ০৮:৪৭
মোস্তাফিজুর রহমান লিখেছেন : সুন্দর লিখেছেন। ইংরেজী কাফেরদের ভাষা শিক্ষা করা হারাম। এই ফতোয়ার কারণে ভারতীয় মুসলমানরা কত পিছনে পড়েছে তা বুঝতে এখন আর কষ্ট হয়না। আল্লাহ আলেম সমাজকে যথা সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দান করুক, আমিন।
১৪
247206
২২ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:১৭
বুড়া মিয়া লিখেছেন : ভালো লাগলো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File