ইসলামী শিক্ষার প্রসার ও বেগম রোকেয়া
লিখেছেন লিখেছেন কানিজ ফাতিমা ০৪ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৯:৫৯:৪৩ সকাল
দুঃখ জনক হলেও সত্য, অনেকই বেগম রোকেয়ার চরিত্রকে ইসলাম বিদ্ধেষীরূপে অঙ্কিত করতে চান। যার ফলস্বরূপ অনেক ইসলামপন্থীও তার সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা পোষণ করেন। অথচ বেগম রোকেয়া তার লেখনী ও বক্তব্যে ইসলামী শিক্ষা প্রসারের জন্য বার বার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি যারা অর্থ না বুঝে কোরআন পড়েন তাদেরকে নারকেলের উপরের কঠিন অংশ লেহন করেন বলে উপমা দিয়েছেন-
“শৈশব হইতে আমাদিগকে কোরআন মুখস্থ করানো হয়, কিন্তু শতকরা নিরানব্বই জন তাহার একবর্ণেরও অর্থ বলিতে পারে না। যাঁহারা অর্থ শিখিয়াছেন, তাঁহারাও শোচনীয়রূপে ভ্রান্ত। ইসলামের মর্ম তাঁহাদের কাছে এক বর্ণও ধরা পড়ে নাই, ইহার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কি হইতে পারে?” তিনি বলতেন “নারিকেলের চমৎকার স্বাদ তাহার দুর্ভেদ্য আবরণের ভিতর আবদ্ধ। অন্ধ মানুষ সেই কঠিন আবরণ ভেদ করিবার চেষ্টা না করিয়া সারাজীবন শুধু ত্বকরে উপরিভাগটাই লেহন করিয়অ মরিল।” [রোকেয়া জীবনী, শামছুন নাহার পৃ. ১২০]
বেগম রোকেয়ার খুব নিকটস্থ এক ছাত্রী শামছুন নাহার তার রচিত ‘রোকেয়া জীবনীতে’ লিখেছেন, ‘উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে অশিক্ষা ও কুসংস্কারের ভিতর দিয়া আসিয়াছিল জাতির সবচেয়ে বড় অকল্যাণ । ইসলাম সত্যিকার শিক্ষা ভুলিয়া হৃতসর্বস্ব মুসলমান সেদিন হাবুডুবু খাইতেছিল কুসংস্কার আর গোঁড়ামি পাঁকে।’ বেগম রোকেয়াও নিজ লেখনীতে সব বিকৃতির মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন ধর্মহীন শিক্ষাকে, “এসব বিকৃত রুচির প্রধান কারণ বর্তমান ধর্মহীন শিক্ষা।” আর এ- জন্যই ইসলামের সত্যিকার শিক্ষার আলোকে হাতে নিয়ে সমাজকে আলোকময় করতে চেয়েছেন তিনি ।
ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তিনি বলেছেন “ এই বিংশ শতাব্দী কালে যৎকালে অন্যান্য জাতি নিজেদের প্রাচীন প্রথাকে নানা রকমে সংস্কৃত, সয়শোধিত ও সুমার্জিত করে আঁকড়ে ধরে আছেন,................... তৎকালে আমরা নিজেদের অতিসুন্দর ধর্ম, অতিসুন্দর সামাজিক আচার- প্রথা বিসর্জন দিয়ে এক অদ্ভুত জানোয়ার সাজাতে বসেছি।”
কোরআন শিক্ষা সম্পর্কে বেগম রোকেয়া বলেছেন, “ অন্যান্য সুসভ্য সম্প্রদায়ের এবং এই ভারতবর্ষেই অন্যান্য প্রদেশের মুসলমান মেয়েরা ডাক্তার, ব্যারিস্টার, কাউন্সিলার এবং গোল-টেবিল বৈঠকের সদস্য হচ্ছেন; আমাদের মেয়েরা কোন পাপে ঐসব সমৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত থাকবে? আদর্শ মোসলেম নারি গঠিত হবে, যাদের সন্তান সন্তুতি হবে হযরত ওমর ফারুক, হযরত ফাতেমা জোহরার মতো। এর জন্য কুরআন শরীফ শিক্ষার বহুল বিস্তার দরকার। কুরআন শরীফ অর্থাৎ তার উর্দু এবং বাংলা অনুবাদের বহুল প্রচার একান্ত আবশ্যক।”
তিনি আরও বলেছেন “ছেলেবেলায় আমি মার মুখে শুনতাম, কুরআন শরীফ ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করবে। সে কথা অতি সত্য। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, খুব বড় আকারের সুন্দর জেলদ বাঁধা কুরআনখানা আমার পিঠে ঢালের মতো করে বেঁধে নিতে হবে। বরং আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আমি এই বুঝি যে, কুরআন শরীফের সার্বজনীন শিক্ষা আমাদের নানা প্রকার কুসংস্কাররের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। কুরআন শরীফের বিধান অনুযায়ী ধর্ম-কর্ম আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অধ: পতন থেকে রক্ষা করবে।”
এক বক্তব্য তিনি বলেন, “ মুসলমান বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে কোরআন শিক্ষাদান করা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন। কোরআন শিক্ষা অর্থে শুধু টিয়া পাখীর মত আরবী শব্দ আবৃত্তি করা আমার উদ্দেশ্য নহে। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় কোরআনের অনুবাদ শিক্ষা দিতে হইবে। সম্ভবত: এ- জন্য গভর্নমেন্ট বাধ্যতাশুলক আইন পাশ না করিলে আমাদের সমাজ মেয়েদের কোরআন শিক্ষাও দিবে না। যদি কেহ ডাক্তার ডাকিয়া ব্যবস্থাপত্র লয়, কিন্তু তাহাতে লিখিত ঔষুধ- পথ্য ব্যবহার না করিয়া সে ব্যবস্থাপত্রখানাকে মাদুলী রূপে গলায় পরিয়া থাকে, আর দৈনিক তিনবার করিয়া পাঠ করে, তাহাতে কি সে উপকার পাইবে, আমরা পবিত্র কোরআন শরীফের লিখিত ব্যবস্থা অনুযায়ী কোন কার্য করি না, শুধু তাহা পাখির মত পাঠ করি’ আর কাপড়ের থলিতে [জয়ুদানে] অতি যত্নে উচ্চস্থানে রাখি।” [বঙ্গীয় নারী- শিক্ষা সমিতি, পৃ: ২৮২]
পরিশেষে তিনি বলেন, “আমার অমুসলমান ভগিনীগণ! আপনারা কেহ মনে করিবেন না যে, প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কোরআন শিক্ষা দিতে বলিয়া আমি গোড়াঁমীর পরিচয় দিলাম। তাহা নহে, আমি গোঁড়ামী হইতে বহুদূরে। প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থা কোরআন পাওয়া যায়। আমাদের ধর্ম ও সমাজ অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য কোরআন শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন।” [ব.না.শি.স. লোপৃ: ২৮২]
বেগম রোকেয়া মিসেস এ্যানি বেশান্তের ইসলাম শীর্ষক বতৃতাটি ‘নূর ইসলাম’ নামে অনুবাদ করেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, “প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি, আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির যাবতীয় কারণসমূহের মধ্যে প্রধান কারন হইতেছে ধর্ম । ধর্ম ব্যতিরেকে মানুষ অধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি কিংবা সভ্যতা লাভ করিতে পারেনা।” [ রোকেয়া রচনাবলী, পৃ: ৮২]
কোরআনের শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাবার তাগিদ তিনি কিভাবে উপলব্ধি করতেন তা তার ছাত্রী লেখিকা শামসুন নাহার- এর লেখা “রোকেয়া জীবনী” থেকে জানা যায়- ’কিন্তু সমাজের চোখে আঙ্গুর দিয়া ধর্মের সত্যকার শিক্ষার দিকে বারে বারে তাহার দৃষ্টি আকর্ষন করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। ইসলামের নির্দেশকে কোরআনের পাতায় আবদ্ধ না রাখিয়া বাস্তব জীবনে কাজে লাগাইবার জন্য তিনি পাগল হইয়াছিলেন।” [রোকেয়া জীবনী, শামসুন নাহার, পৃ: ১২১-১২২]
বিষয়: বিবিধ
২১০৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন