নয় বছরের ছেলেটি
লিখেছেন লিখেছেন কানিজ ফাতিমা ২২ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০২:২১:৪৬ রাত
নয় বছরের ছেলেটি -১
স্কুলের অনুষ্ঠানে গাওয়ার জন্য বাচ্চাদের গান প্রাকটিস করাচ্ছিলাম। হঠাত দরজায় টোকা। আমার ব্যস্ততা দেখে আমার EA (Educational Assistant) ই দরজা খুলল। অফিসের লোক - শুনলাম সে আমার ক্লাসের একটি ছেলেকে অফিসে নিতে এসেছে। এমনটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই আবার গানে মন দিলাম।
একটু পরে EA ফিরে এলো - চোখ লাল। "Can you believe it? They have taken R......" কিছুই মাথায় ঢুকলো না। ওরা করা? কারা নিয়েছে R .. কে? কোথায় নিয়েছে ?
-" চিলড্রেন এজেন্সী। ওরা ওকে অন্য স্কুলে নিয়ে গেছে।"
বুক ভেঙ্গে এক দীর্ঘ নিঃস্বাস বের হয়ে এলো। বাচ্চাদের স্কুল পাল্টানো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এটা সেরকম কোনো স্বাভাবিক ঘটনা না। বাচ্চাদের সামনে ইমোশন দেখানো খুব একটা ভালো কাজ না। তবুও দরদর করে আমার চোখ থেকে পানি পড়ছে , EA ও কাদছে।
EA কে ক্লাসে রেখে দৌড়ে গেলাম স্কুল কাউন্সেলরের কাছে। ওই ছেলেটার কেসটা নিয়ে আমরা টিমের মত কাজ করছিলাম। হালনাগাদ ফল পেতেও শুরু করেছি। দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকে গেলাম - What's happening with R...?
"ওর জন্য নতুন ফস্টার হোম খুঁজে পেয়েছে এজেন্সী - তাই তাকে অন্য স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে"- বলে ও কাদতে শুরু করলো। " Can you imagine- the agency said nobody wants him?"
বুকটা মোচড় দিচ্ছে - চোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম - I do. I don't mind keeping him with me for couple of months, if possible.
নয় বছরের ছেলেটি -২
স্কুল শুরু হবার দুই সপ্তাহ পরে অন্য স্কুল থেকে একটা নতুন ছেলে ট্রান্সফার হয়ে এলো আমার ক্লাসে। বয়স এখনো নয় পূর্ণ হয়নি। ফর্সা , লম্বা , স্বাস্থ্য ভালো, ভদ্র, লেখাপড়ায় ভালো - সবথেকে বড় কথা - চটপটে। যেকোনো মা এমন ছেলে জন্ম দিয়ে গর্ব করবে। আমিও ওকে আমর ক্লাসে পেয়ে খুশী। কিন্তু তিন চার সপ্তাহ যেতে না যেতেই সে পাল্টাতে শুরু করলো - কথা শুনতে চায়না , লেখা পড়ায় কোনো মনোযোগ নেই, ক্লাসে বিরক্ত করে। কারণ কি ? ওর ফাইল চেয়ে পাঠালাম। ফাইল নেই - যেটুকু তথ্য আছে তা হলো -
ওর মা-বাবা দুজনই মাদকাসক্ত। তাদের কাছে তাদের সন্তানেরা নিরাপদ নয় , তাই R ও তার ভাই বোনের দায়িত্ব নিয়েছে চাইল্ড এজেন্সি। এজেন্সী এদের জন্য ফস্টার হোম খুঁজে বেড়ায়। পার্মানেন্ট ফস্টার হোম পাওয়া খুব কঠিন - তাই তারা ক'দিন এর বাড়ী, ক'দিন ওর বাড়ী থাকে। আর এ কারণেই ঘন ঘন স্কুল বদলাতে হয় ওদের। ওর বয়স যখন ছয় তখন থেকে তার এই ভাসমান জীবনের শুরু । ভাবতেও কষ্ট হয় -মাত্র আট/নয় বছর বয়সে সে বাবা-মা , ভাই-বোন থেকে আলাদা। তার উপরে ঘন ঘন থাকার জায়গা বদল, স্কুল বদল - বন্ধু নাই , ভরসা করার মত চারপাশে কেউ নাই। অত ছোট্ট মনে আর কত সয়। এজন্যই ছেলেটা অন্য কারো সঙ্গে খেলতে চাইতো না, এমনকি গ্রুপ ওয়ার্কও করতে চাইতো না। আমার পেছন পেছন সব জায়গায় যেত। ক্লাসে যন্ত্রণা করলে জিগ্গেস করতাম "মাকে মনে পরছে?" চোখ লাল করে বলত "হ্যা।" বুঝতে পারতাম আমার বয়স ওর মায়ের কাছাকাছি - তাই এই পেছন পেছন ঘোরা।
দুই সপ্তাহ আগে একদিন ক্লাসে ঢুকে বলেছিল "Teacher, guess what? I am going to my mom this weekend...." আমি সত্যি খুশী হলাম। ছেলেটা অনেকদিন ধরে মাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছ। এরপরে প্রতিদিন আমাকে শুনতে হত ওর বকবক " We're going to stay in a hotel, with swimming pool.......How many days are left ?...still two more days...."
শুক্রবার সকালে ব্যগ গুছিয়ে নিয়ে এসেছে - স্কুল থকেই মায়ের কাছে চলে যাবে। ছুটির সময় যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন বললাম " Have a nice weekend R.. , don't forget to have lots of fun. I will hear everything on Monday". একান থেকে ওকান পর্যন্ত লম্বা একটা হাসি নিয়ে বের হয়ে গেল।
সোমবারে জিগ্গেস করলাম- কেমন মজা করলে মায়ের সঙ্গে? " মা নিতে আসেনি "- কি বলব বুঝতে পারলাম না। ফর্মাল কয়টি শব্দ উচ্চারণ করলাম"I am so sorry to hear that." নিজের কানেই শুকনো ,ফাকা আর ঝন-ঝণে লাগলো।
না, তার মা তাকে নিতে আসেনি ; তার বাবার সঙ্গেও তার থাকা হবে না হয়ত কখনই। এভাবে গত কয়েক মাসে ছোট্ট মনের আশা ভরা বুক বার বার ভেঙ্গেছে। বুকে বাধা আশা ভেঙ্গে ভেঙ্গে সে ধৈর্যের শেষ সীমায় চলে এসেছে। আমার আশংকা হয় এবার বুঝি আর পারবে না।
হায় মাদক ! তোমার কারণে এমন একটা ছেলেকে চাওয়ার কেউ নেই !! পৃথিবীতে তার নিজের বলে কিছু নেই !!! "Nobody wants him!!!"
বিষয়: বিবিধ
১২৭৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন