আমাদের মর্যাদা বোধ

লিখেছেন লিখেছেন কানিজ ফাতিমা ০৪ মে, ২০১৩, ১২:১৮:৫৬ রাত

ছোট বেলায় যখন দেশ নিয়ে কবিতা পড়তাম তখন মনে হত , 'আহা কতই না সুন্দর এই দেশ! আমি কত ভাগ্যবান যে এমন দেশে জন্ম গ্রহণ করেছি।' এরপর যখন ডেনমার্ক দেখলাম, কানাডার সামার (গ্রীষ্ম) দেখলাম আর পাশা পাশি বাংলাদেশে জমি, ডোবা, খাল-বিল এমনকি নদী ভরাট করে ওঠা কনক্রিটের খরখরা দৃশ্য মনে পড়ল তখন মনের মধ্যে প্রশ্ন এলো - 'আমাকে কেন অমন কবিতা মুখস্থ করানো হয়েছিল?' পরে কবিকে দোষ দিতে নাপেরে ধরে নিয়েছিলাম - হতে পারে কবি এসব দেশ দেখেননি বা কবির সময়ে আমাদের দেশ আসলেই সুন্দর ছিল। তারপর যখন একটু বড় হলাম, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দর্শন আর স্লোগানের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম তখন শুনলাম আমাদের নাকি হাজার বছরের গর্বের ইতিহাস। শুনে কিশোরী মনের আত্মমর্যাদাবোধ আকাশে গিয়ে ঠেকেছিল । কিন্তু ক'বছর পরে দেশ থেকে যখন সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে পূর্বে, পশ্চিমে এমনকি পাশের পরম বন্ধু দেশে গেলাম, দেখলাম এই পাসপোর্টের প্রতি সবার কত সন্দেহ আর বিরক্তি। একবার সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে আমার বিমান ছেড়ে দেবার সময় হয়ে গিয়েছিল তবুও আমার পাসপোর্ট ছাড়তে চায়নি এক কর্মকর্তা - অথচ আমি জাপানী মহিলা মন্ত্রনালয়ের আমন্ত্রণে এক সেমিনারে ও কর্মশালায় যোগ দেবার জন্য যাচ্ছিলাম ।

কর্মকর্তাটি সেই আমন্ত্রণ পত্রের (invitation letter) দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল ওটা আমি নিজেই লিখে নিয়েছি, আর জাপান ইমিগ্রেশন আমাকে নেহায়েত ভুল করে ভিসা দিয়েছে। সরকারী আমন্ত্রণ পত্র তাতে কি,সবুজ পাসপোর্টে মানেই সন্দেহ। হাজার বছরের গর্ব পূর্ব-পশ্চিমের প্রতিটা এয়ারপোর্টে এসে বার বার প্রশ্নের মুখোমুখি হয় ।

পর্ব-পশ্চিম কেন, নিজের দেশেও এই সবুজ পাসপোর্টের মর্যাদা লাল বা নেভী ব্লু পাসপোর্টের চেয়ে অনেক কম। লাল বা নেভী ব্লু পাসপোর্ট হাতে থাকলে ইমিগ্রেশন অফিসারের ভাষা আর চেহারা পাল্টে যায়। এইত এবার কানাডা আসার সময় আমারই দেশে আমার সবুজ পাসপোর্টের দিকে তাকিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসার বললো - কানাডার ভিসা কই ? আমি অবাক হলাম কারণ আমি পাসপোর্টের সাথে আমর PR কার্ডও তাকে দিয়েছি। বললাম, 'আমার ভিসা লাগেনা-আমি ওখানের পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট।' সম্ভবত বুঝলনা- জিগ্গেস করলো 'কানাডায় কার সাথে থাকেন?' তখন নয়টা চল্লিশ- আমার বোর্ডিং টাইম নয়টা পয়তাল্লিশ। একঘন্টা ধরে লাইনে দাড়িয়ে আছি ,এই রকম অদ্ভুত প্রশ্নের জন্য একেবারই প্রস্তুত নই। বিরক্ত হয়ে বললাম, 'husband'। 'নিকাহ নামা দেখান' - এবার ধৈর্যের পরীক্ষা - দাতে দাত চেপে বললাম - 'আমিতো নিকাহ নামা নিয়ে ঘুরে বেড়াই না , আমার স্বামী আছে কি নাই সেটা দেখা আপনার কাজ না। আমি নিজে কানাডার ইমিগ্রান্ট, PR card (permanent residence card)- এ আমার নাম আছে, কানাডা যেতে আমার স্বামীর দরকার নাই।' আমাকে খোচা দিয়ে উত্তর এলো - "ও, আপনাদের স্বামীর দরকার হয় না।" যতবার দেশে যাই বা আসি প্রতিবার নিজ দেশের এয়ারপোর্ট পার হওয়াটাকেই সবথেকে বেশী ভয় পাই - অহেতুক ঝামেলা করবে নাতো? লাগেজ চুরি হয়ে যাবে নাতো ? ... হাজার বছরের গর্ব কোথায় মিলিয়ে যায়। মনে মনে ভাবি কবে যে নেভিব্লু পাসপোর্ট টা হাতে পাব।

কানাডায় যখন কাপড় কিনতে গিয়ে দেখি 'মেড ইন বাংলাদেশ' তখন আবার অনেক নীচে চাপা পরা হাজার বছরের গর্বটা ফিরে আসে। পরিচিত কানাডিয়ানদের বলি " Look, made in Bangladesh." কিন্তু এখন মনে হয় আর বলতে পারব না। কারণ এখন বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনলেই ওরা দু:ক্ষ প্রকাশ করে জিজ্ঞাসা করে গার্মেন্টস ট্রাজেডির কথা। ওরা দু:ক্ষ প্রকাশ করে আর আমি লজ্জা পাই। বিশ্শ্বের কাছে এ কিভাবে পরিচিত হচ্ছি আমরা? এতগুলো মানুষ মরে গেল, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে না- চরম দুর্নীতি আর দায়ীত্বহীনতার কারণে। সারা পৃথিবী তা জানলো। আমাদের গায়ে সীল লেগে গেল মানুষের জীবনকে হেয় প্রতিপন্ন কারী জাতি হিসাবে ।

আর এরপরও যখন শুনি আমার দেশের মন্ত্রনালের মর্যাদাবোধের কারণে দুর্গতদের উদ্ধারের জন্য বাড়িয়ে দেয়া হাতকে আমরা না বলেছি, হাজার বছরের গর্ব নিয়ে আরো কিছু বেশী মানুষকে আমরা মৃত্যুর দিকে ঠেল দিয়েছি , তখন নিজেকে প্রশ্ন করি - গর্বের সংগা কি? মর্যাদা বোধ কাকে বলে? এটাকি শুধুই একটা রাজনৈতিক স্লোগান ?

বিষয়: রাজনীতি

১৭৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File