ক্লাশ থ্রির একটি ছড়ি

লিখেছেন লিখেছেন Hossain Al Irfan ১৮ জুন, ২০১৩, ০৭:৫২:১১ সন্ধ্যা

আমি ছড়ি। একটা প্রাইমারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর টেবিলের ওপর থাকি। এই শ্রেণীতে ক্লাশ নিতে আসা প্রায় সব শিক্ষক আমাকে দিয়ে ছাত্রছাত্রী পেটান।

আমি ছড়ি। আমার তো কোনো মন নেই। মন না থাকলে কি মায়া থাকে। মানুষের মন আছে। তাই মানুষের মায়া আছে। দরদ, ভালোবাসা, দুঃখ, হাসি-কান্না সব মানুষের জন্য। আমার তো এসব কিছুই নেই। কারণ আমার মন নেই।

এতদিন ধরে আমাকে দিয়ে কেবল পেটানো হয়েছে। এতটুকুন ছেলেমেয়েরা আমার মার খেয়েছে। আমার তো জন্মই হয়েছে মার দেয়ার জন্য। তাতে তো আমার দুঃখ হওয়ার কথা না। সুখ-দুঃখ আমি বুঝিও না। আমার কাজ কেবল আলসেমি করে, আরাম করে সটান থাক। আমি তাই করে গিয়েছি এতদিন। প্রায় প্রতিদিন পড়া না পারার অপরাধে কারো হাতের তালুতে, কারো পিঠের ওপর, কারো মাথার ওপরও বাড়ি দেয়া হয়েছে আমাকে দিয়ে। আমার কখনো কোনো কষ্ট হয়নি। খারাপ লাগেনি। কারণ, আমার কোনো মায়া-দয়া নেই। কারণ, আমার মন নেই। কিন্তু সেদিন আমি কাঁদলাম।

কেন কাঁদলাম!

সেদিন ক্লাশে এক নতুন ম্যাডাম এলেন ক্লাশ নিতে। ক্লাশে এসে হেড মিস তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেলেন। আর ম্যাডামকে বলে গেলেন, কেউ পড়া না পারলে পিটিয়ে তার চামড়া তুলে নেবেন। ছাত্রছাত্রীরা সবাই যথারীতি ভয়ে জড়োসড়ো ক্লাশ করতে লাগল। হঠাৎ ম্যাডাম পড়া জিজ্ঞেস করলেন হিরাকে। এক্কেবারে যাকে বলে, ‘পড়বি পড় মালির ঘাড়েই’। হিরা ক্লাশের সবচেয়ে অমনোযোগী ছাত্রী। আমার সবচেয়ে বেশি পরিচিত সে। যা হোক হিরা যথারীতি পড়া পারল না। অবাক কান্ড ম্যাডাম ওকে মারলেন না। তবে দাঁড় করিয়ে দিলেন বেঞ্চের ওপর। আর বললেন ‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়া মুখস্ত করো’।

আমার তো শরীর নিশপিশ করতে লাগল। উহ্ফ পেটাতে পারলাম না! এর মধ্যে আরও একজন পড়া পারলো না। ওমা! ম্যাডাম তাকেও কিছু বললেন না! আমি তো আফসোসে মরি, আহ্্ পেটাতে পারলাম না! এরপর আরো একজন। কিন্তু এবারও আমার আশা পূরণ হলো না। ম্যাডাম সবাইকে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগলো না। কারণ পিটিয়ে অভ্যস্ত আমি। আমার সারা শরীর চুলকাতে লাগলো।

এক সময় ম্যাডাম হীরাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী তোমার পড়া হয়েছে?’

হীরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো।

ম্যাডাম ডাক দিলেন, ‘এদিকে আসো’?

হীরা বেঞ্চ থেকে নেমে ম্যাডামের দিকে এগিয়ে গেলো। ম্যাডামের কাছে এসে তার সামনে দুই হাতের তালু পেতে দাঁড়ালো। তার চোখ বন্ধ। টেবিলের ওপর শুয়ে শুয়ে আমি সব দেখছিলাম। ভাবছিলাম, এখনি ম্যাডাম আমাকে তার হাতে তুলে নেবেন। তারপর শপাং, শপাং... আহ্্ ভাবতেই শান্তি!

কিন্তু হীরাকে হাত বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়াতে দেখে ম্যাডাম হীরার হাত দুটো নিজের দুই হাতের মধ্যে নিলেন। তারপর হীরা

কে টেনে নিলেন নিজের বুকের মধ্যে। বললেন, ‘তোমাকে হাত পাততে কে বলেছে মা? আমি তো তোমাকে এমনিই ডেকেছি। তোমাকে মারার জন্য ডাকিনি। শোনো মা, তুমি তো আমার মেয়ের মতো। আমার আপন মেয়েও যা তুমিও তাই। তোমাকে কি মারতে পারি!’

এরপর ম্যাডাম হীরা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘শোনো মা, তুমি যদি মন দিয়ে না পড়ো তবে অন্যরা তোমার চেয়ে এগিয়ে যাবে, তুমি পিছনে পড়ে থাকবে। কিছু শিখতে পারবে না। সবাই বলবে, হীরা কিছু পারে না। সবাই তোমাকে ছোট নজরে দেখবে। তুমি কি চাও সবাই তোমাকে ছোট নজরে দেখুক?’

হীরা কোনো কথা বললো না। কিন্তু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘ম্যাডাম, আমাকে কেউ ভালোবাসে না। বাড়িতে বাবা-মা গালগোল করে, আমাকেও মারে। বাড়িতে আমি পড়তে পারি না। স্কুলে ম্যাডামরা আমাকে মারে। কেউ আমাকে একটু আদর করে না। তাই আমার কিছু ভালো লাগে না। পড়তেও ভালো লাগে না। আমি জানি আমার কপালে কেবল মারই আছে। তাই আমি হাত পেতে দিয়েছি।’

হীরার কথা শুনে আমি তো ‘থ’। আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠলো। একটা হাহাকার নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলোÑ ‘আহারে’!

ম্যাডাম হীরাকে শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসব মা। কান্না করে না।’ ম্যাডাম নিজ হাতে হীরার চোখের পানি মুছে দিলেন।

আমি এ দৃশ্য দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। আমার নিরেট শক্ত শরীরে যে কোমল একটা মন থাকতে পারে আমি বুঝিনি। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। কিন্তু গোপনে। কেউ দেখেনি।

পরদিন ম্যাডামের ক্লাশে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম আমি, আমাকে অবাক করে দিয়ে সেদিন গড়গড় করে সব পড়া বলে দিল হীরা। সেদিন আমি বুঝলাম, এতদিন যে শিক্ষকেরা আমাকে দিয়ে পিটিয়ে পড়া আদায় করতে চেয়েছে তারা ব্যর্থ শিক্ষক। ম্যাডামই প্রকৃত শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের পিটিয়ে নয় ভালোবাসা দিয়ে পড়া শেখাতে হয়।

আমার অনুশোচনা হলো। মনে হলো, আমিও অপরাধ করেছি। আমার অপরাধের শাস্তি হওয়া দরকর। তাই, সেদিনই একটা ঘুন পোকাকে ডেকে আনলাম আমার শরীরে। কারণ, আমি হীরাকে দেখে এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, আমাকে ধংস করা খুব জরুরী। এতটুকু শিশুদের কোমল শরীরে আমার কঠোর আঘাতের চেয়ে কোমল ভালোবাসা বেশি জরুরী। তাই ঘুন পোকা যত তাড়াতাড়ি পারে আমাকে যেন ধংস করে ফেলে। যেন আমাকে ব্যবহার করে কেউ ক্লাশের শিশুদের নিষ্ঠুরভাবে পেটাতে না পারে।

বিষয়: বিবিধ

১৮৬৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File