জামেয়া ক্বাসিমুল উলুম দরগাহ'র ছাত্র 'শহীদ আমির আব্বাস'র আত্নার প্রতি নিবেদিত খোলা চিঠি...
লিখেছেন লিখেছেন misbah monjur ১৭ জুন, ২০১৩, ০৯:১০:৪৭ রাত
শত সহস্র স্বপ্ন নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে থাকে। হাজারো আশা নিয়ে বাঁচে। আকাশ চুম্বি কত শত কল্পনা- জল্পনা মানবাত্বার দুয়ারে বার বার কড়া নাড়ে। কত স্মৃতি, কত প্রীতি সঞ্চিত থাকে হৃদয় ক্যানভাসে। হয়ত তোমারও তা-ই ছিল।
কিন্তু এই পৃথিবীটা বড়ই পাষাণ। পৃথিবীর মানুষগুলো বড়ই বৈচিত্র্যময়। বড়ই রহস্যময়। কখন কী করে? কোথায় যায়? তা- বলাই মশকিল। কারন, সে মানুষ; তার মনের কোনো স্থায়িত্ব নেই। কখনো বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিবে বন্ধুর তরে; আবার কখনো নিজে বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হয়ে বন্ধুর জীবনটাও কেড়ে নিবে। তোমার বেলায়ও তা-ই হল। যাকে বন্ধু হিসেবে কাছে ডাকতে; পাশে রাখতে। সে-ই বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হল। তোমার জীবনটাকে কেড়ে নিল। যেই হাতের উপরে তুমি অভিন্ন হৃদয়ে, সুহৃদের ন্যায় ঘুমিয়েছিলে, সেই হাত দিয়ে তোমার গলা কেটে দিল। যাকে সবার চাইতে বেশি ভালবাসতে, সেই তোমার সাথে প্রতারণা করল; বিশ্বাসঘাতকতা করল।
তুমি তাকে বিশ্বাস করেছিলে এটা তোমার অপরাধ নয়; সততা। বন্ধুকে বিশ্বাস না করলে আর কাকে বা বিশ্বাস করবে? কিন্তু ও-তো বন্ধু ছিলনা; ও ছিল একটা সন্ত্রাস। ও তোমার পোশাক পরিধান করল, তুমি সমগোত্রীয়দের সংখ্যা বাড়ল ভেবে প্রফুল্য হয়েছিলে। ও তোমার সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে ছিল, তুমি নতুন বন্ধুর আগমন ভেবে আশ্রয় দিয়েছিলে। ও ছিল তোমার শত্রু। তোমার বিশ্বাসের শত্রু। তোমার নিঃশ্বাসের শত্রু। ও তোমার দেহকে ছিন্নবিন্ন করতে পারল; একটু কাঁপল না তার দেহ। ও তোমার গলায় ছুরি দিয়ে আঘাত করতে পারল; একটুও দরদ লাগল না তার মনে। তুমি তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে ছুরিটি ধরছিলে, তোমার হাতের আঙুল সে কেটে দিল; একটুও কাঁপল না তার হাত। তোমাকে ঘুমে রেখে সে তোমাকে খুন করার প্ল্যান করল; তুমি বুঝলে না। সে রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য আগ থেকেই প্রস্তুত ছিল; তুমি জানলে না। ও যে তোমাকে এত নির্মমভাবে হত্যা করবে; তুমি একবারও ভাবলে না। যে ছুরি দিয়ে রাত্রে ঘুমানোর আগে দু’জন মিলে আম খেয়েছিলে, সেই ছুরি দিয়েই যে তোমাকে কাতল করবে; তা কল্পনাও করলে না। বৎসরের শেষ দিন মাদরাসায় বন্ধুদের সাথে রাত কাটানোর ইচ্ছা করছিলে; কিন্তু জানতেনা এই ইচ্ছার পিছনে লেখা ছিল তোমার মরন। কী করে বা জানবে? সেই বয়সটাই কি বা তোমার ছিল? মাত্র ১৫ বছর বয়স। তাও নিজের জীবন কাটিয়ে দিলে হিফযখানাতে। ১৫ বছর বয়সে কতজনই বা হাফিয হয়েছে। এটা ছিল তোমার সৌভাগ্য। তোমার মাঝে ছিল চঞ্চলতা। ছিল মুখভরা হাসি। কেউ কোনো কিছু বললে হাসিমুখে উত্তর দিতে। সেই মুগ্ধ করা হাসি আর কারো মাঝে ছিল না; তোমার মাঝেই ছিল। বড্ড মিস করছি তোমার সেই মুগ্ধকরা হাসি। মাদরাসায় গেলে শত শিশুর মাঝে তোমাকেই খুঁজি। যখন হিফযখানা পাড়ি দিয়ে তিন তলায় আব্বার রুমে যাই, তখন আমার চলার গতি থেমে যায়। তোমাকে হারানোর আত্মগ্লানি আর অনুশোচনার এক মরমন্দুত হাহাকার যেন নিঃশব্দে মনের মধ্যে আঁচড়ে পড়ে। নিরবে নিবৃত্তে একাগ্রচিত্বে বসে কাঁদি। কী করে মানুষ মানুষকে এতো নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে! তা-ই ভাবি। দুহাত তুলে খোদার কাছে তোমার জন্য প্রার্থনা করি।
আমির আব্বাস! আমরা তোমাকে হারিয়ে একাকীত্ব অনুভব করছি। সেই দিন মাদরাসায় সবাই তোমার জন্য কাঁদছিল। ছাত্রদের কান্নায় মাদরাসার চারিপাশ বিষাদিত হয়েছিল। মাদরাসার শিক্ষকরা তোমার রূহের মাগফিরাত কামনা করতে গিয়ে অঘলদারায় কাঁদছিলেন। মুতামিম সাহেব হুজুর সর্বপ্রথম তোমায় শহীদ বলে আখ্যায়িত করছিলেন। তোমার কথা বলতে গিয়ে তাঁর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। অনেক চেষ্টা করছিলেন তাঁর কান্না থামাতে। চেষ্টা করছিলেন নিজেকে সংযত করতে; কিন্তু পারলেন না। শত-সহস্র মানুষের সামনে কেঁদে ওঠলেন। তাঁর কান্নার সাথে সাথে মসজিদের উপস্থিতিরাও কেঁদে ওঠল। কে- কাকে স্বান্তনা দিবে? কে কার অশ্রু মোছে দিবে? সবাই ছিল তোমার জন্য আকুল। তোমার জন্য ব্যাকুল। তাঁদের কান্নায় আকাশ বাতাস বারী হয়ে ওঠছিল। অবশেষে তোমার আব্বুর বক্তব্যে সবাই সম্মতি ফিরে পেল। তোমার আব্বুর মত ক’জনেরই বা এমন আব্বু আছে? বিপদের মাঝেও যার এত ধরয্য; যিনি এত শান্ত। সেই দিন তাঁর বক্তব্যের মাঝে ছিল সততা। ছিল ন্যায় পরায়নতা। তাঁর কথার মাঝে ছিল সান্ত্বনার বাণী। মাদরাসাকে দুষি বললেন না; যে দুষি, তাকেই দুষি বললেন। দুষিকে ধরার জন্য মাদরাসার সাহায্য চাইলেন। তাঁর ছেলের জন্য সবার কাছে প্রার্থনা চাইলেন। সন্তানকে নিয়ে গর্ব করলেন। নিজেকে শহীদের পিতা বলে আখ্যায়িত করলেন।
আমীর আব্বাস! আমরা তোমার লাশ নিয়ে মিছিল করিনি; লাশ কাঁধে নিয়ে প্রতিবাদ করিনি। আমরা তোমার জন্য প্রার্থনা করেছি। যতা সম্ভব শহীদের মর্যাদা পালন করার চেষ্টা করেছি। তোমাকে তোমার স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানোর জন্য চেষ্টা করেছি। আজ প্রায় এক বছর চলে গেল, তবুও মনে রয়ে গেলে তুমি। আমরা তোমাকে ভুলিনি। কী করে ভুলব? এত সহজেই কি ভুলা যায়?
নিঝুম রাতে, চোখের ঝলে, দু’হাত তুলে তোমার জন্য প্রার্থনা করি। আল্লাহ্ যেন তোমাকে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা দান করেন। তার সাথে তোমার আব্বুকে যেন নেক হায়াত দান করেন। সেই প্রার্থনা।
বিষয়: বিবিধ
১৮৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন