সূরা আসরের তাফসীর ও শিক্ষা পর্ব ২

লিখেছেন লিখেছেন এম আবদুল্লাহ ভূঁইয়া ৩০ আগস্ট, ২০১৩, ১১:১২:২৪ রাত

সূরা থেকে অর্জিত শিক্ষা ও মাসায়েলসমূহ :

১- এ সূরার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, চারটি বিষয় অর্জন করা আমাদের জন্য জরুরি :

এক. ইলম বা জ্ঞান অর্জন। ইলম ব্যতীত ঈমান স্থাপন সম্ভব নয়। ঈমানের জন্য কমপক্ষে তিনটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। (ক) আল্লাহ তাআলাকে জানতে হবে। (খ) তাঁর রাসূলকে জানতে হবে। (গ) তাঁর প্রেরিত দীন-ধর্মকে জানতে হবে। এগুলো জানার পরই তার ওপর ঈমান আনা সম্ভব। ইরশাদ হয়েছে:

فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ

'অতএব জেনে নাও যে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মুমিন নারী-পুরুষদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য।' (মুহাম্মাদ : ১৯)

আমরা দেখলাম, এ আয়াতে 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ' এর প্রতি ঈমান আনার পূর্বে জানতে বলেছেন অর্থাৎ ইলম অর্জন করতে বলেছেন। তারপর ইস্তেগফার তথা আমল করতে বলেছেন।

দুই. ইলম অনুযায়ী কাজ করা। তিনটি বিষয় -আল্লাহ, রাসূল ও দীন সম্পর্কে ইলম অর্জন করে আল্লাহর প্রতি ঈমান স্থাপন করার পর সেই ইলম বা জ্ঞান অনুযায়ী আমল করতে হবে।

তিন. অন্যকে এই ইলম ও আমলের দিকে আহবান করতে হবে বা দীনে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে হবে।

চার. ধৈর্য ধারন করা। ইলম, ঈমান, আমল ও দাওয়াত দিতে গিয়ে যে সকল বিপদ-মুসীবত, দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, তাতে ধৈর্য ধারণ করতে হবে ও অন্যকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে হবে। এছাড়া সকল প্রকার বিপদ মুসিবতে, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে ও অন্যকে ধৈর্য ধারণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

২- আল্লাহ তাআলা 'আল আসর' তথা সময়, হায়াত, যুগের শপথ করেছেন। এ শপথের মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে সময় ও জীবনের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। মানুষের আয়ু কত মূল্যবান তা অনুধাবন করতে বলেছেন। তেমনি 'আল আসর' এর কসম করে যা বলেছেন সেটারও গুরুত্ব বুঝিয়েছেন তিনি। আর তা হল; মানুষ ক্ষতিতে নিপতিত। মানুষ ধ্বংসের দিকে ধাবিত। তাই ক্ষতির পথ ছেড়ে তাকে লাভ ও কল্যাণের পথে আসতে হবে। যারা ক্ষতিগস্ত হচ্ছে তারা কিন্তু সময়টাকে বর্ণিত কাজগুলোতে লাগাচ্ছে না বলেই তারা ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।

৩- আল্লাহ তাআলা যুগের শপথ করেছেন। যুগে যুগে যা কিছু ঘটেছে সেগুলো ইতিহাস। তাতে রয়েছে মানুষের জন্য শিক্ষা ও নসিহত। যুগে যুগে অত্যাচারী শক্তিধর জাতির পতন ঘটেছে। নির্যাতিত দুর্বল জাতির উত্থান হয়েছে। এসবই মহান আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর সর্বময় ক্ষমতার প্রমাণ।

৪- মানুষ দুনিয়াতে আয়ু পার করে বার্ধক্যে উপনীত হয় বটে কিন্তু সে লাভবান হয় না। তবে যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে, মানুষকে সত্যের পথে আহবান করেছে, ধৈর্য ধারণ করেছে তারা এর ব্যতিক্রম। তারা বৃদ্ধ অক্ষম হয়ে গেলেও তাদের নামে সৎকর্ম যোগ হতে থাকে। যেমন আবু মুসা আশাআরী রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একাধিকবার বলতে শুনেছি-

إذا كان العبد يعمل عملا صالحا فشغله عنه مرض أو سفر كتب له كصالح ما كان يعمل وهو صحيح مقيم.

'কোন মানুষ যখন সৎকর্ম করতে থাকে, পরে তাকে রোগ-ব্যধি পেয়ে বসে অথবা সফর অবস্থায় থাকে, তখন তার কর্ম বিবরণীতে সে আমলগুলো লেখা হতে থাকে, যেগুলো সে সুস্থ ও গৃহে থাকাবস্থায় করে আসছিল।' (বুখারি, জিহাদ অধ্যায়)

৫- মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকভাবে হতে পারে : প্রথম. কুফরি করার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

'আর অবশ্যই তোমার কাছে এবং তোমার পূর্ববর্তীদের কাছে ওহি পাঠানো হয়েছে যে, তুমি শির্ক করলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হবেই। আর অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।' (যুমার : ৬৫)

দ্বিতীয়. মুমিন অবস্থায় সৎকর্ম কম হয়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ

'আর যাদের পাল্লা হালকা হবে তারাই নিজদের ক্ষতি করল।' (মুমিনূন : ১০৩)

তৃতীয়. সত্য তথা ইসলাম গ্রহণ না করে অন্য আদর্শ গ্রহণ করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

'আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।' (আলে ইমরান : ৮৫)

চতুর্থ. ধৈর্য ধারণ না করে হতাশ হয়ে পড়ার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَعْبُدُ اللَّهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انْقَلَبَ عَلَى وَجْهِهِ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةَ ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ

'মানুষের মধ্যে কতক এমন রয়েছে, যারা দ্বিধার সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি তার কোনো কল্যাণ হয় তবে সে তাতে প্রশান্ত হয়। আর যদি তার কোনো বিপর্যয় ঘটে, তাহলে সে তার আসল চেহারায় ফিরে যায়। সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি হল সুস্পষ্ট ক্ষতি।' (হজ : ১১)

৬- ঈমানের আভিধানিক অর্থ, সত্যায়ন করা, স্বীকার করা, মেনে নেয়া।

পারিভাষিক অর্থ, হাদিসে জিবরিলে বর্ণিত ঈমানের যে ছয়টি ভিত্তি আছে তার

সবগুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখা। একটু বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে বলা যায়, ঈমান হল : অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা, মুখ দিয়ে স্বীকার করা আর অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা। তাই শুধু বিশ্বাস দিয়ে কাজ হবে না, যদি না সে বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করা হয়।

৭- আমর বিল মারুফ ওয়ান নাহি আনিল মুনকার অর্থাৎ অন্যকে সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করার গুরুত্ব অনুধাবন করা যেতে পারে। সত্যের পথে মানুষকে আসার উপদেশ দেয়া মানে সৎকাজের আদেশ করা। এর জন্য প্রয়োজন হবে ধৈর্যের। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন লুকমান হাকিমের উপদেশ উল্লেখ করেছেন। সেখানেও এ বিষয়টি দেখা যায়। লুকমান তার ছেলেকে বলেছিলেন :

يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ

'হে আমার প্রিয় বৎস, সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎ কাজে নিষেধ কর এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধর। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ।' (লুকমান : ১৭)

৮- আমালে সালেহ বা সৎকর্মের মধ্যে হুকুকুল্লাহ (আল্লাহর অধিকার) ও হুকুকুল ইবাদ (মানুষের অধিকার) দুটোই অন্তর্ভুক্ত। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির গুরুত্ব দেয়ায় কাজ হবে না। তাওহিদে বিশ্বাস, ঈমানে কামেল, ইবাদত-বন্দেগি, ফরজ-ওয়াজিব ও সুন্নাত-মুস্তাহাব আমলগুলো যেমন সৎকর্ম তেমনি পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মী-সহযাত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ, তাদের অধিকার সংরক্ষণ করাও সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত। দেখুন কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের অধিকার বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অধিকার সংরক্ষণের কথাও বলেছেন :

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا

'তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সঙ্গে, নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে, ইয়াতিম, মিসকিন, নিকট আত্মীয়- প্রতিবেশী, অনাত্মীয়- প্রতিবেশী, পার্শবর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।' (নিসা : ৩৬)

৯- সবর বা ধৈর্য তিন প্রকার : (ক) আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্য ধারণ করা। তাঁর আদেশ নির্দেশগুলো মানতে গিয়ে অধৈর্য না হওয়া। এটাকে বলা হয় : الصبر على طاعة الله

(খ) আল্লাহর অবাধ্য না হওয়ার ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহ তাআলা যা কিছু হারাম করেছেন সেগুলোর ধারে কাছে না গিয়ে ধৈর্য অবলম্বন করা। এটাকে বলা হয় : الصبر عن معصية الله

(গ) উপস্থিত বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করা। এটাকে বলা হয় : الصبر على أقدار الله

১০- সূরা আল বালাদেও অন্যকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়ার নির্দেশ এসেছে, সেখানে এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। যেমন :

ثُمَّ كَانَ مِنَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ وَتَوَاصَوْا بِالْمَرْحَمَةِ ﴿17﴾ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ ﴿18﴾

'অতঃপর সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যারা ঈমান এনেছে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্য ধারণের, আর পরস্পরকে উপদেশ দেয় দয়া-অনুগ্রহের। তারাই সৌভাগ্যবান।'

এ আয়াতে মুমিনদের গুণাবলি উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, তারা ধৈর্য ধারণ আর পরস্পরকে দয়া-অনুগ্রহ করার উপদেশ দেয়।

তারা ডানদিকের দল। তাই একজন মুমিন যেমন নিজে ধৈর্য ধারণ করে ও অন্যকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়, তেমনি সে নিজে দয়া অনুগ্রহ করে ও অন্যকে দয়া অনুগ্রহ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

আল্লাহ আমাদেরকে সূরা আল আসরের শিক্ষাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য তাউফিক দান করুন।

১ম পর্ব http://www.bdtomorrow.net/blog/blogdetail/detail/2300/salamat/26203

http://www.quraneralo.com/tafseer-al-asr/

বিষয়: বিবিধ

১৫৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File