যে কারনে শাহবাগ আন্দোলন ব্যর্থ হবে!!

লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজ আল হেলাল ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০২:৪৬:৪৭ দুপুর

গত কয়েকদিন ধরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে একজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির ফাসিঁর দাবীতে শাহবাগে চলমান আন্দোলন সকল শ্রেনী পেশার মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে। আন্দোলনকে ঘিরে শুরুর দিকে ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও সে আগ্রহে ক্রমশঃ বিবেকবান মানুষের ভাটা পড়ার বিষয়টিও লক্ষ্যনীয় । আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য ও চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে নানা রকম অসঙ্গতি আর শাহবাগ চত্বরে ফ্যাসিবাদের লেলিহান শিখা সচেতন লোকের আগ্রহের কাটা ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতে বাধ্য করেছে। আদর্শ-লক্ষ্যহীন, বিচক্ষন নেতৃত্বহীন শাহবাগ আন্দোলন ক্রমেই বিভিন্ন জাতীয় দিবসে আয়োজিত শোভাযাত্রাযর ন্যায় পরিনত হয়েছে। অতঃপর পরিনত হয়েছে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়িতে।

১। আদর্শহীন আন্দোলন বিফলতা লাভে সফল হয়

যে কোন আন্দোলন কিংবা বিপ্লব সফল করতে হলে একটা নির্দিষ্ট আদর্শকে সামনে নিয়ে অগ্রসর হতে হয়। পৃথিবীতে সফলতা লাভকারী সকল বিপ্লবীদেরই আদর্শ এবং লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট। সেদিক দিয়ে শাহবাগ আন্দোলনকারীরা শাহবাগকে "তাহরীর স্কয়ার" ঘোষনা দিয়ে আন্দোলনের প্রারম্ভেই আদর্শচ্যুত হয়েছে। তাহরীর স্কয়ারের আন্দোলনকারীরা ছিল "সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা" আদর্শের অনুসারী। অন্যদিকে শাহবাগ আন্দোলনকারীদের আদর্শ পশ্চিমা ধাচের কথিত "ধর্মনিরপেক্ষতা"। নীতি এবং আদর্শের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হওয়ার পরও তাহরীর স্কয়ারের আন্দোলনকারীদের অনুকরনে কিছু একটা করার অপচেষ্টা সাধারন মানুষদের ধোকা দেওয়ার শামিল। তাতে শাহবাগীদের আদর্শিক দুর্বলতা কিংবা আদর্শহীনতা ফুটে উঠেছে মারাত্বকভাবে।

২। লক্ষ্যহীন আন্দোলন ব্যর্থ হতে বাধ্য

আন্দোলন কিংবা বিপ্লবের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট। তাহরীর স্কয়ারের আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য ছিল তিন যুগের অপশাসনের বিরুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে এনে সর্বসাধারনকে শান্তির সুবাতাসে মোহিত করা। তাই তারা অনেক রক্তের বিনিময়ে সফলও হয়েছেন। অন্যদিকে শাহবাগ আন্দোলনকারীরা শুরুতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক ব্যক্তির ফাসিঁর দাবী করলেও মাত্র বাহাত্তর ঘন্টার ব্যবধানে তিনশত যাট ডিগ্রী বাক নিয়ে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দল এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করার সেকেলে; এমনকি বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জনপ্রিয় দৈনিক আমার দেশসহ নির্দিষ্ট গনমাধ্যম বন্ধ করার হাস্যকর দাবী তুলে আন্দোলনের লক্ষ্যকে গোষ্ঠিগত স্বার্থে জলাঞ্জলি দিয়েছে। ফলে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন শাহবাগ আন্দোলন তরুন প্রজন্মকে কিছুটা উদ্দীপনামূলক বিনোদন ছাড়া মহৎ কিছু দিতে দারুনভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

৩। রাজনৈতিক রূপদান আন্দোলনের মুখে কালিমা লেপননেরই নামান্তর

সর্বসাধারনের স্বার্থজড়িত কোন আন্দোলন কিংবা বিপ্লবকে রাজনীতিকরন জাতির জন্য কোন সুখকর বার্তা বয়ে আনতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। তাহরীর স্কয়ারের আন্দোলনকারীরাও কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুসারী ছিলেন না। অথচ শাহবাগ আন্দোলনের প্রথমদিনে কয়েকজন চরিত্রহীন রাজনীতিবিদ বোতল আর জুতার স্বাদ আস্বাদন করলেও তিনদিনের ব্যবধানে শাহবাগ আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে সরকারী দলের আন্দোলন সংক্রান্ত মজাদার নাটকে পরিনত হয়েছে। শাহবাগের রঙ্গমঞ্চ থেকে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সস্তা বুলি আওড়ানো আর বাকশালের প্রেতাত্বাদের দলীয় শ্লোগান ছাড়া সাড়া জাগানো তেমন কিছুই করতে পারে নি।

৪। নীতিহীন লোকদের আন্দোলন দিতে পারে শুধু সাময়িক বিনোদন (?)

আন্দোলনে সফলতা লাভে সম্মিলিতভাবেই যেমনি নীতি-আদর্শের প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন একদল আদর্শবান মানুষ, চাই সে বাম হোক কিংবা ডান আদর্শের। নীতি-আদর্শহীন লোকেদের দিয়ে কোন পাড়ার আন্দোলনও সফল হয় না। ভাড়াটিয়া লোক অথবা মজাদার খেচুড়ি আর সাময়িক বিনোদনের সস্তা আবেদনে সাড়াদানকারীদের দ্বারা আর যাইই হোক, আন্দোলন হয় না।

৫। পুলিশ বেষ্টনীতে আন্দোলন হয় না, নাটকের রিহার্সাল হয়

মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোন আন্দোলনও শাসকগোষ্টী কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রছায়ায় হয়েছে বলে শোনা যায় নি। ছোট বড় সব আন্দোলনেরই প্রথম প্রতিপক্ষ থাকে শাসকগোষ্ঠী। শাহবাগ আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্যও তার থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। ন্যায় বিচার যেখানে গৌণ, সেখানেই শাসকদলের ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপারটাই মুখ্য। সংগতকারনেই ফাসিঁর দাবীটা ছিল সরকারের কাছে। তারপরও সরকারীদলের গুন্ডাদের কাছে আন্দোলনকারীদের অসহায় আত্বসমর্পণ শাহবাগ আন্দোলনকে একটি চাটুকারিতামূলক শোভাযাত্রায় পরিনত করেছে।

৭। জোরদার আন্দোলন হয় সুনির্দিষ্ট এবং বিচক্ষন নেতৃত্বের অধীনে

বৃহত্তর আন্দোলনতো দূরের কথা, নেতৃত্ব ছাড়া মফস্বলের কোন ছোট্ট মিছিলও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হতে পারে না। পৃথিবীর মানচিত্রের যে প্রান্তেই কোন আন্দোলন হয়েছে, সেটা হয়েছে সুনির্দিষ্ট নেতৃত্বের অধীনে, একক মঞ্চ থেকে। তাহরীর স্কয়ারের আন্দোলন একটিমাত্র মঞ্চ থেকেই পরিচালনা করা হয়েছিল। অথচ আটচল্লিশ ঘন্টা পার হতে না হতেই শাহবাগ আন্দোলন কয়েকভাগে বিভক্ত হয়েছে। আন্দোলনের সাড়া জাগানো বামনেত্রীকে পিটিয়ে হাসপাতালেও পাঠানো হয়েছে। শাহবাগসংলগ্ন রাজপথগুলো বিক্ষিপ্তভাবে অসংখ্য জনতার পদভারে মুখরিত হয়েছে বটে; তবে বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য রসদ যোগাতে ব্যর্থ হয়েছে চৌদ্দ আনা।

ইতিহাস সাক্ষী দেয় উপমহাদেশের সমস্ত সফল আন্দোলন হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে। বাংলার মাটিতে সাম্রাজ্যবাদের গোলামরা সাধারন মানুষের একরাশ ঘৃনা ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারে নি। শুধুমাত্র প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবীতে শাহবাগ আন্দোলন সংঘটিত হলে সচেতন মানুষের যে ধরনের সমর্থন কিংবা সহযোগীতা পাওয়া যেত; ফ্যাসিবাদের ভয়ংকর গর্জনে প্রবল প্রকম্পিত শাহবাগ চত্বর বিবেকবোধসম্পন্ন মনুষ্যগোষ্ঠীকে সে অবস্থান থেকে সরিয়ে জোরপূর্বক চিন্তার সাগরে নিমজ্জিত হতে বাধ্য করেছে। সেটার কারন হতে পারে আন্দোলনের সূচনাকারীদের সীমাহীন অযোগ্যতা, দুর্বলতা কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির কাজে নীতি-নৈতিকতার আত্ববিসর্জন।

বিষয়: বিবিধ

১৬৯৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File