তাঁদের তোমরা মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত

লিখেছেন লিখেছেন বিডি রকার ০৬ মার্চ, ২০১৩, ১০:২৩:২৫ রাত

বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে বাহিরের খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে ফাহিম। হু-হু করে ঠান্ডা বাতাস আসছে। তবে এসব কিছুর দিকে মনোযোগ নেই ফাহিমের। তার মাথায় শুধু এখন একটাই চিন্তা – আগামীকাল মাওলানা সাঈদীর রায় দিবে। কী হবে রায়? সাজানো এই ট্রাইবুনালে বিচারটি কি অবশেষে সফল হবে? তাঁর মত একজন মানুষকে কি ফাঁসিই দিয়ে দেবে আদালত!! পৃথিবী থেকে একজন মানুষকে পরিকল্পিতভাবে জুডিশিয়াল কিলিংএর মাধ্যমে হত্যা করা কি এতই সহজ।

তবে এসব প্রশ্নের উত্তরগুলো জানা তার। অনেকেই অবশ্য বলছে সাঈদীর রায় হবে ফাঁসি। তবে ফাহিমের মন কেন জানি বলছে ফাঁসি হবে না সাঈদীর। তাঁকে একটা চিন্তা খুব বেশি নাড়া দিচ্ছে আর সেটা হল যারা ট্রাইবুনালের বিচারক তারা নিশ্চই এতটা অবিচারক নয়। তারা নিশ্চই সাঈদী সাহেবকে বেকসুর খালাস দেবেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল, এই বিচারগুলোই তো আগের মামলাগুলোতে একজনকে ফাঁসি ও আরেকজনকে যাবজ্জীবনের রায় দিয়েছে। তাহলে উপরের নির্দেশে সাঈদীকেও ফাঁসির আদেশ দিতে তাদের নিশ্চই হাত কাঁপবে না। কিন্তু কেন জানি কিছুতেই এসব বিষয় মানতে ইচ্ছা করছে না ফাহিমের।

কাল যদি রায়ে সাঈদীর প্রতি বিন্দুমাত্র অবিচার করা হয় তাহলে তার এলাকার বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের থানার পক্ষ হতে বিক্ষোভ মিছিলের কথা আছে। কাল সে মিছিলে অবশ্যই যাবে ফাহিম। আগের অনেক মিছিলেই নানা অজুহাত দেখিয়ে সে অনুপস্থিত থেকেছে। কিন্তু আগামীকাল সে শুধু উপস্থিত থাকবে না সেই সাথে মিছিলের সবার সামনের দিকে থাকবে বলে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে ফাহিম। আগে অনেক অপরাধ করেছে কিন্তু আর নয়। কেননা তারই সাথের ভাইয়েরা আজ অকাতরে ইসলামের জন্য প্রাণ দিচ্ছে। আর সেখানে সে চুপ করে সব দেখবে এটা কখনোই হতে পারে না। মনে পড়লো তার সাঈদী সাহেবের ওয়াজের সেই কথাটি “ইঁদুরেরে মত পাঁচশ বছর বেঁচে থাকার চেয়ে সিংহের মত এক ঘন্টা বাঁচতে চাই”। আসলেই দেশে একজন আলেমকে জালিমরা বিনা দোষে শাস্তি দেবে আর ইসলামের সৈনিকরা চুপ করে বসে থাকবে, এটা কখনোই হতে পারে না। কিন্তু এসব ভাবতে গিয়ে হঠাত তার মা-বাবার কথা মনে পড়ল। ফাহিমের আব্বু ছেলেকে ইসলামী আন্দোলন করতে মোটেও বাধা দেয় না, নিজেও আন্দোলনের সাথে যুক্ত, কিন্তু ফাহিমের আম্মু মাঝে মাঝেই বাধা দেয় ফাহিমকে, বলে “বাবা একদিন না গেলে কিছু হবে না। এত মিছিল মিটিংএ যাওয়ার চেয়ে ভালোমত লেখাপড়া কর, সেটাও কাজে লাগবে”। কিন্তু এর জবাবে ফাহিম তার আম্মুকে বোঝাতে ব্যর্থ হয় যে, এই ভয়ংকর ক্রান্তিকালে ইঁদুরের মত ঘরের কোণে বসে লেখাপড়া করতে তার মন সায় দেয় না। তবে এসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফাহিম মনে মনে ঠিক করল, কালকে সে মিছিলে অবশ্যই যাবে এবং যদি তার আম্মু নিষেধ করে তবে অনুমতি ছাড়াই যাবে। প্রয়োজন হলে মায়ের কাছে একটা চিরকুট লিখে যাবে। হঠাত করে খেয়াল হল ফাহিমের, রাত অনেক হয়ে গিয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকালো – একটা পঁচিশ বাজে। ফাহিমরা তিন ভাই, কোন বোন নেই। সে সবার বড়। এবার ক্লাস টেনে উঠেছে সে। তার ছোট ভাই সহ সে একই রুমে থাকে। ছোট দুই ভাইই ঘুমিয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। এদের একজন ফাইভ ও সবার ছোটজন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। দুজনই খুব চঞ্চল, তবে ফাহিম তার ছোট দুই ভাইকেই প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। তারাও ফাহিমের খুবই ভক্ত। ঘুমানোর আগে বিছানাটা পরিস্কার করছে সে। আগামীকাল আবার রোযা রাখবে বলে ঠিক করেছে সে। হঠাত তার মনে হল এত রাতে ঘুমালে সকালে সেহেরি খাওয়ার জন্য তার উঠাটা হয়তো নাও হতে পারে। কী করবে ভাবছে সে। সে সময়ই মনে হল, যদি সে আজ রাতে আর না ঘুমিয়ে ফজর পর্যন্ত সজাগ থাকে, তাহলেই তো হয়। এমনিতেই সংগঠন থেকে বলা হলেও অনেকদিন ধরে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে না সে। আজ এই উসিলায় তাহাজ্জুদের নামাজটুকুও আদায় হয়ে যাবে। আর আল্লাহর কাছেও তো এর মাহাত্ম্য অনেক। চিন্তাটা সাথে সাথেই মনে ধরল ফাহিমের। অযু করে এসে তখনই জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেল সে। সিজদায় অনেকক্ষণ যাবত পড়ে থেকে সে যেই দুয়া করেছিল, সেই দুয়া যে আল্লাহ কবুল করে ফেলেছেন সেটা হয়তো ফাহিমও জানতো না।

তাহাজ্জুদের সালাত পড়ে আর কুরআন তেলাওয়াত করেই ফজর পর্যন্ত জেগে থাকলো ফাহিম। মাঝখানে কয়েকটা বিস্কুট ও পানি খেয়ে সেহেরি করলো সে। ফজরের আযান হওয়ার পর তার ছোট ভাইকে অনেক কষ্টে নামাজের জন্য জাগালো সে। দুজনেই ঘুমকাতুরে, সহজে উঠতে চায় না। ভাইদের দিয়ে জামাতে নামাজ পড়ার শেষে সে হঠাত করে খেয়াল করলো রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে তার চোখে। সে ঘুমিয়ে গেল তখন। ফাহিমের সে ঘুমটা ছিল শান্তির ঘুম। শান্তির সে ঘুমে স্বপ্নরাজ্যে হারিয়ে গেল সে। সে দেখলো পিরোজপুরের এক বিশাল মাঠে একজন দাঁড়িওয়ালা আলেম ওয়াজ করছেন। সেই সুরেলা, দরদী কন্ঠ তার খুবই পরিচিত। টিভিতে, ক্যাসেটে অনেকবার শুনেছে সে কন্ঠ। তখনই টের পেল সে, এ যে আমাদের সাঈদী সাহেব। মাউলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মুক্তি পেয়েছেন। আবার ফিরে এসেছেন ইসলামপ্রিয় তৌহীদী জনতার মাঝে। খুশিতে ভরে উঠলো তার মন। এরপর সে দেখলো, সে নিজে দৌড়ে গিয়ে সবাইকে সুখবর দিতে যাচ্ছে। কিন্তু একী! সে দৌড়াতে পারছে না, সে খেয়াল করলো তার সাদা গেঞ্জি রক্তে লাল হয়ে রয়েছে, সে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। এমনি সময়ে ঘুম ভেঙে গেল ফাহিমের। তার সবার ছোট ভাই আসিফ তাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকছে ঘুম থেকে উঠার জন্য।

“ভাইয়া উঠবে না? টিভিতে তো ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে যে সাঈদি সাহেবের রায় পড়া শুরু হয়েছে”।

-তাই নাকি? ধরমর করে বিছানা থেকে হাতমুখ ধুয়ে টিভি দেখার জন্য দৌড় দিল।

টিভি সেটের সামনে অনেকক্ষণ যাবত বসে আছে ফাহিম। রায় এখনো পড়া হচ্ছে। টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলেও ফাহিমের মনে তখন ঘুরপাক খাচ্ছে আগের রাতের স্মৃতি; সেই স্বপ্নের ব্যপারটি এখনো ঠিক বুঝতে পারছে না সে। সাঈদী সাহেব যে মুক্ত হয়েছেন এটা সে বুঝতে পারলেও স্বপ্নের পরের অংশটুকু এখনও দুর্বোধ্যই রয়ে গেল তার কাছে। তবে এরপরও তার মনে এখন কেমন জানি একটু খুশি খুশি লাগছে, কেননা সাঈদী সাহেব মুক্ত হবেন। এসব ভাবতে ভাবতেই সে রায়ের অপেক্ষায় থাকলো। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখ দুপুর ২টা ৫ মিনিট। ঘোষিত হল সাঈদী সাহেবের ফাঁসির আদেশ। রায়টা খবরে দেখার পর অনেকক্ষণ যাবত স্তব্ধ হয়ে থাকলো ফাহিম। তার হৃদয়ের এক ছোট্ট স্বপ্ন ভেঙেচুরে চুরমার হতে থাকলো। অন্তরে শুরু হয়ে গেল তীব্র রক্তক্ষরণ। রায়টি শোনার পর ফাহিম তার কানকে বিশ্বাস পারছিল না, চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে পারছিল না তার অন্তরকে বিশ্বাস করতে। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর সে একটু স্বাভাবিক হলো। বুঝতে পারল স্বপ্নের সেই পরবর্তী অংশ কুরআনের এই বুলবুলি সাঈদী সাহেবকে রক্ত দিয়েই মুক্ত করে আনতে হবে। করতে হবে আন্দোলন, ঝরাতে হবে রক্ত। দ্রুত তার ঘরে গিয়ে মায়ের কাছে একটি চিঠি লিখল সে। এরপর সাদা একটি গেঞ্জি আর নীল প্যান্ট পরে বাহিরে যাবার জন্য তৈরী হল। তার মনে আছে, তার অন্যান্য ভাইদের সাথে কোথায় একসাথে হতে হবে। ছোট দুই ভাইকে আদর করল আর মার চিঠিটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল “আমার বেশি দেরী হলে মায়ের কাছে দিবি”। এরপর মায়ের কাছে গেল সে। “মা আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি জরুরী কাজে। ফিরতে ইনশাআল্লাহ বেশি দেরী হবে না। দোয়া করো মা, আসসালামু আলাইকুম”, দ্রুত এই কথাগুলো বলে বাহিরের দিকে রওনা দিল ফাহিম। শুনবতে পেল মা পিছন থেকে ডাকছে। কিন্তু থামলো না ফাহিম, বুঝল এবার যদি সে থেমে পেছনের দিকে তাকায়, তবে আর কখনোই সে সামনের দিকে যেতে পারবে না। তাই এক দৌড়ে রাস্তা দিয়ে ছোটা শুরু করল সে। সে যখন দৌড়াচ্ছিল তখন তার খালি মনে পড়ে ছিল মায়ের কাছে বলা সেই শেষ কথপোকথনের কথা। কেন জানি তার মনে হচ্ছে মায়ের সাথে এই কথপোকথনই মায়ের সাথে বলা তার শেষ কথা। তবে এসব চিন্তাতে এখন আর পাত্তা দিতে চাইলো না সে। তার কেবল ইচ্ছা করছে সারা বাংলাদেশের, সারা বিশ্বের সব মুসলমানদের চিৎকার করে জানিয়ে দিতে দেখ হে নামধারী মুসলমানেরা দেখ এই মুসলমানদের দেশে একজন নিরপরাধ মুসলমান আলেমকে নাটক সাজিয়ে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে। জালিম সরকার মানুষের মুখ চেপে ধরে রেখে একের পর এক অন্যায় করেই যাচ্ছে। অনেক আরাম আয়েশ ও আল্লাহর সাথে নাফরমানী করছে। ঢের করেছ, এখন তওবা করে আল্লাহর পথে আস, ইসলামের ছায়াতলে এসে ইসলামের কাজ করো। কেননা এতেই রয়েছে দুনিয়া আখিরাত উভয় জীবনের মুক্তি।

এসব ভাবতে ভাবতেই লক্ষ্যস্থলে এসে পড়ল সে। মেইনরোডের সাথেই একটা গলির অল্প একটু ভেতরেই একটা মাঠ। এখানেই সবার একসাথে হওয়ার কথা। দেখল অনেকেই এসে পড়েছে, কিন্তু তাদের এই এলাকার থানা সভাপতি আব্দুল্লাহ ভাই আসেননি। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, একটু পরেই আরো কয়েকজন ভাইসহ হাজির হলেন আব্দুল্লাহ ভাই। সবাইকে নিয়ে একসাথে একটা পরিকল্পনা করলেন। ঠিক হল, সবাই মিছিল করবে না, কয়েকজন আলাদা থাকবে, তাদের কাজ হবে আশেপাশের অবস্থা সব ঠিক আছে নাকি সেটা লক্ষ্য রাখা। এছাড়াও পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের উপস্থিতি লক্ষ্য করলে আগেভাগেই মিছিলকারীদের তা জানিয়ে রাখা। ফাহিমকে এই সতর্ক করার কাজে রাখা হল।

বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়েছে। আশেপাশে আপাতত কোন পুলিশের গতিবিধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মিছিল মোটামুটি নির্বিঘ্নেই মালিবাগ রেলগেট থেকে শুরু হয়ে রামপুরা পর্যন্ত আসলো। মিছিলের শ্লোগানগুলো ছিল

প্রাণ গেলে আমার যাক, তবুও সাঈদী মুক্তি পাক............

অবৈধ ট্রাইবুনালের অবৈধ রায় মানি না, মানবো না.........

জেলের তালা ভাংবো, সাঈদীকে মুক্ত করবো.........

ইত্যাদি নানা শ্লোগানে এলাকার মানুষগুলোকে জানিয়ে দেয়া হল এই অবৈধ ও সাজানো ট্রাইবুনাল যে কতটুকু মিথ্যা ও অগ্রহণযোগ্য। সব কিছু ঠিকমতোই চলছিল। কিন্তু হাজীপাড়া পেট্রোল পাম্পের কাছাকাছি আসতেই শুরু হল বিপত্তি। এই এলাকাটির আশেপাশে পোশাকধারী ও সাদা পোশাকের অনেক পুলিশ আগেই উত পেতে ছিল। মিছিলটি তাই আয়ত্তে আসামাত্রই তারা দুদিক দিয়ে শুরু করলো গুলিবর্ষণ। এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল ফাহিম। এর আগেও অনেক মিছিল সে করেছে আর পুলিশকে সেখানে আক্রমণ করতে দেখেছে। আক্রমণের ক্ষেত্রে পুলিশ সবসময়ই আগে টিয়ারশেল মারত, এতে কাজ না হলে রাবার বুলেট ও শটগানের গুলি করতো। কিন্তু অবাক করা ব্যপার হল আজকের এই মিছিলে পুলিশ বিনা উস্কানীতে হঠাত করেই মিছিলকে ঘেরাও করে তাজা বুলেট নিক্ষেপ করতে লাগলো। ফাহিম বুঝতে পারল পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে আজকে অসংখ্য ভাইএর শাহাদাত বরণ করতে হবে। তখনই সে দেখলো আশেপাশের গলিগুলো দিয়ে অনেকেই নিরাপদে চলে যেতে পারলেও মিছিলের সামনে আব্দুল্লাহ ভাইসহ আরো কয়েকজন ভাই কোন সুবিধাজনক স্থানে যেতে পারেন নি। তারা নিরস্ত্র হওয়ার কারণে পুলিশের বুলেটের কাছে অসহায় হয়ে গিয়েছিল। সে বুঝতে পারলো এভাবে চলতে থাকলে তার প্রাণপ্রিয় আব্দুল্লাহ ভাইকে সহ অন্যান্য ভাইরা নির্মম পরিণতির স্বীকার হবেন। দ্রুত সে বুঝে উঠল কী করতে হবে। সে সহ আরো কয়েকজন ভাই কতগুলো ইটের টুকরো নিয়ে রাস্তায় প্রবেশ করলো। জোরে জোরে চিৎকার করে বলল আব্দুল্লাহ ভাই আপনি ভাইদের নিয়ে পাশের গলিতে দৌড় দিন। আপনারা ভালো পজিশন নিতে পারবেন। আমরা সে পর্যন্ত আপনাদের গার্ড দিচ্ছি। আব্দুল্লাহ ভাই বুঝলেন ফাহিম যা করছে তা খুবই ভয়ংকর। কারণ তারা কয়েকজন সামান্য ইটের টুকরো নিয়ে পুলিশের মুখোমুখি হবে। কিন্তু এখন যারা এখানে আটকে আছেন তাদের বাঁচানোর জন্য তার কোন উপায় নেই। তাই যেইভাবে বলা হল সেইভাবেই কাজ শুরু করলেন তিনি, আর মনে মনে ফাহিমের সাহস ও বুদ্ধির প্রশংসা করলেন আর সাথে অন্তর থেকে দোয়া করলেন তার জন্য।

এদিকে ফাহিম তার সাথের ভাইদের নিয়ে রাস্তায় উঠে আসলো। হাত দিয়ে ছোট ছোট ইটের টুকরোগুলো ছুঁড়ে মারতে লাগল পুলিশের দিকে। আর মাঝে মাঝেই সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান নিয়ে দেখতে লাগল আব্দুল্লাহ ভাইয়াদের অবস্থা। দেখলো আব্দুল্লাহ ভাই নিজে ময়দানে থেকে অন্যদেরকে গলির দিকে যেতে সাহায্য করছেন। ভালোই কভার দিচ্ছিল ফাহিমরা। ফাহিম ও অন্য কর্মীরা মূলত যেসব পুলিশ বেশি আক্রমণাত্মক তাদের দিকেই ঢিল ছুঁড়ে অন্য ভাইদেরকে পিছনে যেতে সাহায্য করছে। তুমুল লড়াই চলছে। তবে একে লড়াই বললে লড়াই শব্দটিরই অসম্মান করা হয়। কেননা এক পক্ষ সংখ্যায় অধিক নিরাপদ পোশাকে ঢাকা তাদের শরীরে ও হাতে ঝুলছে নানারকম আগ্নেয়াস্ত্র। অপরদিকে অন্যপক্ষ সংখ্যায় কম, সবচেয়ে বড় সম্পদ নিজ প্রাণকে তারা হাতে নিয়ে শুধুমাত্র ইটের টুকরো দিয়ে লড়াই করছে। এমন অবস্থা চলছিল বেশ কিছুক্ষণ। এর মধ্যে হঠাত করে ফাহিম লক্ষ্য করলো আব্দুল্লাহ ভাইকে বাগে পেয়ে এক পুলিশ তার দিকে বন্দুক তাক করছে। দেখেই বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ালো ফাহিম। হাতে কতগুলো পাথর নিয়ে ঐ পুলিশের যথাসম্ভব কাছে গেল সে। একটানা কতগুলো পাথর মারলো সেই পুলিশকে লক্ষ্য করে। নাহ, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি সেই নিশানা। পুলিশটা গুলি করার আগেই পাথরের আঘাতে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ফাহিম যখন সেই পুলিশকে ইট মারার জন্য সামনে এগিয়ে গিয়েছিল, ততক্ষণে সে অনেকটাই অরক্ষিত। তার শরীর তখন কয়েকজন পুলিশের রাইফেলের নাগালের মধ্যে। সেই পুলিশটিকে আঘাত করে আবার পজিশন নিচ্ছিল ফাহিম, কিন্তু তার আগেই রাইফেলের তিনটি বুলেট এসে আঘাত করলো ফাহিমের বুকে।

তবে ফাহিম বেশি কিছু অনুভব করে নি, তার মনে হয়েছিল কেউ যেন তাকে হালকা একটু ধাক্কা দিয়েছে। ভয় পায়নি ফাহিম, বুঝল – বেশি সময় নেই, তার আগেই যা কিছু করার করতে হবে। তাই সে আর পিছু হটল না। দ্রুত আরো কয়েকটি ইটের টুকরো হাতে নিয়ে আবারো তাকালো সামনের দিকে। দেখতে পেল, পুলিশগুলোর চোখে একরাশ বিস্ময় ও আতংক। পিছু হটতে লাগলো তারা। আহত এক সিংহের চাহনি আর হাতের সামান্য অস্ত্র দেখে পালানোর পথ খুঁজতে লাগলো তারা। এদিকে ফাহিম অনেক কষ্টে যখন একটা ইটের টুকরো ছুড়লো, তখন পিছন থেকে আরো অসংখ্য ইটের টুকরো এসে আঘাত করছে সেই পুলিশগুলোকে। পেছনে তাকিয়ে দেখলো তার সাথের অন্যান্য ভাইরা বীরের মত সামনে ছুটছে। হাতে তাদের সামান্য ইটের টুকরো, তবে চোখে তাদের মত এক ভয়ংকর আগুন আর দৃপ্ত শপথ। এর পরপরই মাটিতে ঢলে পড়লো ফাহিম। পূর্ণ হলো আগের রাতে করা তার সেই দোয়া। সে দোয়া করেছিল “আল্লাহ সাঈদীর ফাঁসির রায় হলে তা কার্যকর হওয়ার আগেই আমাকে শাহাদাতের সেই পেয়ালায় চুমুক দেয়ার সুযোগ দিও”। হলও তাই, আল্লাহ তার আরেকজন প্রিয় বান্দাকে নিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। কবুল করলেন তাঁর দোয়া।

ফাহিমের আম্মু ফারজানা হক অনেকক্ষণ যাবত বসে আছেন জায়নামাজে, তার আদরের মানিক ফাহিম গেছে সেই দুপুরবেলায়। দুপুরে কিছু না খেয়ে অনুমতি না নিয়ে বের হওয়ার শুরুতে তার কিছুটা রাগ হয়েছিল। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে, তার ছেলে যেজন্য বের হয়েছে সেটা অবশ্যই একটা ভাল কাজ। এতে যাওয়ায় এখন তিনি অনেক খুশি। তবে ফারজানার কিছুটা আফসোস হচ্ছে এইজন্য যে আগে অনেক মিছিল মিটিঙেই তার ছেলেকে যেতে দেন নি বলে। অনেকক্ষণ সিজদায় পড়ে ছেলের ভালোর জন্য দোয়া করছিলেন আল্লাহর কাছে। এমন সময় তার ছোট ছেলে আসিফের দাকে তার ধ্যান ভাংলো। হাতে তার একটা ভাঁজ করা কাগজ। “মা, ফাহিম ভাইয়া বলেছে তার আসতে দেরী হলে এই কাগজটি তোমাকে দিতে।” “দেখি কাগজটা” – এই বলে ছেলের হাত থেকে কাগজটা নিলেন তিনি। সাদা কাগজে গোটা গোটা হাতের লেখা। ছেলের হাতের লেখা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, এরপর চিঠিটা পরা শুরু করলেন,

আসসালামু আলাইকুম মা,

আমি নিশ্চিত তুমি বুঝতে পেরেছ আমি কোথায় যাচ্ছি। হ্যাঁ মা, আজ যে অন্যায় রায় হলো তার প্রতিবাদ করার জন্যই যাচ্ছি। জানো মা, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটাই আমার শেষ যাওয়া। কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখলাম সাঈদী সাহেব মুক্ত হয়েছেন, কিন্তু আমি রক্তে রঞ্জিত। আমার মট একটা সাধারণ ছাত্রের জীবন যাওয়ার পর যদি সাঈদী সাহেব মুক্ত হন, তবে তা-ই তো ভালো। তাই আমার ইচ্ছা আমার স্বপ্ন যেন সত্যি হয়। রাগ করলে মা? প্লিজ মা রাগ কোরো না, তোমার তো আরো দুটি ছেলে আছে। একজনকে না হয় আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করে দিলে। জানি, যতই এ কথা বলি, তুমি এটা সহ্য করতে পারবে না, হয়তো আমারও কিছু হবে না। কিন্তু এরপরও যদি কিছু হয়ে যায় মা, তাহলে রাগ কোরো না। দেখা তো একদিন হবেই। তখন শুধু আমার জন্য দোয়া করবে। আর আব্বু, নাঈম ও আসিফকে বলবে আমি তাদের প্রাণ দিয়ে ভালবাসতাম। মা, আমি জানি – তুমি যদি না চাও আর আমার জন্য দোয়া না করো তবে শাহাদাতের মর্যাদা হয়তো আমি পাব না। কিন্তু তুমি তো আমার ভালো চাও মা, তাহলে কেন আমার শাহাদাতের জন্য দোয়া করবে না?

ইতি - তোমার ফাহিম

চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো ফারজানা। এরপর আল্লাহর দরবারে তার দুহাত তুলে ছেলের শাহাদাতের জন্য দোয়া করলো।

সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ হয়তো পর্যবেক্ষণ করছিলেন সব। নতুবা যে মুহূর্তে ফারজানা তার সন্তানের জন্য হাত তুললো ঠিক সেই মুহূর্তে শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দিল ফাহিম।

কলিং বেল বাজলো ফাহিমদের বাসার। ছ্যাঁত করে উঠল ফারজানার মন; তার দোয়া কি কবুল হয়নি, তার সন্তানের আকুল ইচ্ছা কি পূরণ হয়নি? তবে কি ফিরে এসেছে তার অন্তরের টুকরো ফাহিম? এই ভাবতে ভাবতে দরজা খুললেন ফারজানা।

তবে দরজা খোলার পর পরই আত্মায় পানি ফিরে পেলেন ফাহিমের আম্মু। না, ফাহিম নয়, দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন ছেলে। তাদের একজন বলে উঠলো, “আন্টি একটু নিচে আসবেন?”

দাঁড়িয়ে রইলেন ফারজানা। আগে বলো আমার ফাহিম কি শহীদ হয়েছে নাকি হয়নি। আন্টি, ফাহিম আমাদের সবাইকে রেখে চলে গেছে। হায়েনারা তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। এই বলে ডুকরে কেঁদে উঠল ছেলেটি।

তবে এরপর যা ঘটল তা কল্পনা করে নি কেউ। ফারজানা কেঁদে উঠবার বদলে কিছুটা খুশিমনেই কাছে টেনে নিলেন ছেলেটিকে, বাবা তোমরা কুরআনের সৈনিক, তোমরা জানো না কুরআনে শহীদদের সম্পর্কে কি বলা আছে? “যারা আল্লাহর রাস্তায় প্রাণ দেবে তাদের তোমরা মৃত বোলো না, বরং তারা জীবিত” – দৃপ্ত কন্ঠে বলে উঠলেন কথাগুলো।

সেই সাথে আল্লাহ তাআলা কবুল করলেন তাঁর দুই প্রিয় বান্দার দোয়া।

**২৮শে অক্টোবর ও ২৮শে ফেব্রুয়ারির সেই সকল শহীদদের প্রতি উৎসর্গ করা হলো, যারা মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে ইসলামের রাস্তায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন।

বিষয়: বিবিধ

১৪৩২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File