শিবির একটি আতঙ্কের নাম!!! –কিন্তু কাদের জন্য???

লিখেছেন লিখেছেন বিডি রকার ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৩:৩২:৪৪ দুপুর

শিবির!! হ্যাঁ, আমাদের এলাকায় নাকি ইদানিং শিবিরের অপতৎপরতা বেড়ে গেছে। তারা নাকি মসজিদ, মাঠ যেখানেই কমবয়সী পোলাপান পাচ্ছে, তাদের ধরে ধরে শিবিরে ঢোকাচ্ছে। বেশ কয়েকদিন যাবত এরকমই একটা গুজব শুনছিলাম। শুরুতে ব্যপারটাকে এতটা পাত্তা দেই নি। কিন্তু একদিন মাগরিবের নামায শেষে আমাদের এলাকার তাবলীগের আমীর নুরুল ভাই আমাকে আর আমার বন্ধু মাসুদকে ডেকে নিয়ে গেলেন মসজিদের এক কোণায়। ওনার চোখে মুখে কিছুটা চিন্তার ছাপ। এরপরই আমাদের অনেকটা উপদেশের সুরেই বললেন, “শোনো রগকাটা শিবির এখন আমাদের এলাকাতেও হানা দিছে। তারা এখন মসজিদকে টার্গেট করছে। ঐখান থেকে তারা কমবয়সী ছেলেদের লোভ দেখিয়ে শিবিরে ঢুকাইতেছে আর মাথা ওয়াশ কইরা বোমাবাজি শিখাইতেছে।” শুনে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, তাই নাকি নুরুল ভাই? তাইলে এখন কী করবো?” নুরুল ভাই বললেন, “তোমরা তাইলে এই কয়েকদিন মসজিদে আইসো না। গেলেও অন্য কোন মসজিদে যাবা। আর রাস্তাঘাটে একটু সাবধানে চলাফেরা করবা।”

নুরুল ভাইএর সাথে কথোপকথনের পরে আমরা দুইজন আসলেই বেশ ভয় পেয়ে গেলাম।

এরপর বেশ কয়েকদিন এই ভয়ে আর মসজিদে যাই নাই। মাঠেও খেলাধুলা বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু কেবল শিবিরের ভয়ে বাসায় বসে থাকতে কেমন যেন লাগছিল। এর মধ্যে একদিন আমার বাসায় এসে হাজির আমার বন্ধু মাসুদ। বললো, “কীরে! এখনো মসজিদে যাস না!!” আমি বললাম, “না দোস্ত, মনে নাই নুরুল ভাই কী বলেছিল?!”

মাসুদ বললো, “তবে আমি কিন্তু গতকালও মাগরিব আর এশার নামায পড়তে গেছিলাম মসজিদে। কিছুই কিন্তু হয় নি।” আমি একটু অবাক হলাম, “তাই নাকি? শিবিরের ক্যাডাররা এসে তোকে ধরে নাই??”। সে বললো, “আরে নাহ; আসলে নুরুল ভাই আমাদের একটু বেশি ভয় দেখায় দিছে। আসলে শিবির-টিবির কিছু নাই। আর তুইই বল, এতোগুলা মানুষের সামনে কেউ শিবিরের কথা বললে তার টেংরি ভেঙ্গে হাতে ধরায় দেয়া হবে না!!!”

তার এসব কথা শুনে আমার টনক নড়ল। ভাবলাম কাল থেকে আবার মসজিদে যাওয়া শুরু করবো। আর ঠিক করলাম পকেটে সবসময় মোবাইল রাখা, আসলেই যদি শিবিরের খপ্পড়ে পড়ি, তাহলে সাথে সাথে সবাইকে ফোন দিয়ে আমার বিপদের কথা জানিয়ে দিব। আর সর্বোপরি হাতে তো আল্লাহ শক্তি কম দেয় নাই। আমার গায়ে তারা হাত দিলে পিটিয়ে তাদের নাক থ্যাবড়া বানায় দিব।

তো যাই হোক, এরপর থেকে আমি আবার নিয়মিত মসজিদে যাওয়া শুরু করলাম। আর শিবিরের থেকে আত্মরক্ষার জন্য নানাজনের কাছ থেকে নানান টিপস নিলাম। কেউ বললো, শিবির দেখলে নাকি চেনা যায়; এদের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি থাকে আর চেহারার মধ্যে কসাই কসাই ভাব থাকে। এদের পকেটে সবসময় ধারালো ছোড়া থাকে। এগুলো দিয়েই তারা নাকি মানুষের পায়ের রগ সুনিপুণভাবে কেটে দেয়।

এভাবে গেল বেশ কয়েকদিন। সব কিছু চলছিল ভালো মতোই। কিন্তু একদিন ঘটলো দুর্ঘটনা। বর্ষাকাল, সারাদিন তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। সুয়ারেজ ব্যবস্থা মোটামুটি ভাল থাকায় রাস্তায় পানি জমে থাকে নি, কিন্তু পুরো রাস্তা কাঁদায় প্যাঁচপ্যাঁচে হয়ে গেছে। এমনই অবস্থায় মাগরিবের নামায পড়তে মসজিদে এসেছি। নামায যথারীতি শেষ হলো। দু’রাকাত সুন্নত পড়লাম। জুতা রেখেছিলাম মসজিদের পিছনের করিডোরে। জুতার বাক্সের কাছে আসলাম জুতা নেবার জন্য। কিন্তু এসে যা দেখলাম তাতে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। একটু আগে ঠিক এখানটাতেই আমার কালো রঙের স্পঞ্জের জুতাটা রেখেছিলাম; কিন্তু এখন তা নেই!! কিছুক্ষণ আশেপাশে খুঁজলাম। কিন্তু বুঝলাম এই খোঁজা বৃথা। কোনো এক বদের হাড্ডি মসজিদের মধ্য থেকে আমার জুতা নিয়ে গেছে। আরে ভাই, চুরি করা তোর পেশা, তুই চুরি করবি ভালো কথা, কিন্তু মসজিদ থেকে কেন। আর মসজিদ থেকে চুরি করলেও বেছে বেছে তুই আজকের দিনটাতেই চুরি করলি!! এখন এই কাঁদা মাড়িয়ে এতদূর বাসায় কিভাবে যাই!!!

এই সাত-পাঁচ ভাবতেই ভাবতেই মসজিদের গেটের পাশে মনমড়া হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম আর নিজ ভাগ্যকে দোষারোপ করছিলাম। নুরুল ভাইএর সাথে দেখা হল, উনাকে জানালাম জুতা হারানোর ঘটনা। উনি আমাকে আরোও ভালমতো খোঁজার পরামর্শ দিয়ে ব্যস্তভাবে চলে গেলেন। তারপর দেখা হল কয়েকজন বন্ধুর সাথে; তারা আমার এ অসহায় অবস্থা দেখে বেশ মজাই পেল মনে হল। একজন হাসতে হাসতে উপদেশ দিল প্যান্ট হাঁটুর উপর তুলে একটা দৌড় দিতে বাসার দিকে। মড়ার উপর খাড়ার ঘা, পকেটে মোবাইলটাও নেই; বাসায় রেখে এসেছি। এমন অবস্থায় আমি হাসবো, না কাঁদবো বুঝতে না পেরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। গেটের বাইরে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কান্না পেতে লাগলো। জুতা হারানোর কারনে যত না দুঃখ তার চেয়ে বেশি দুঃখ লাগল আমার এই বিপদে সবাই কেমন গা বাঁচিয়ে চলে গেল।

এমন সময়ে “এই যে ভাইয়া” ডাক শুনে তাকালাম। দেখলাম শান্তশিষ্ট চেহারার এক ছেলে। দেখে মনে হয় ভার্সিটিতে পড়ে। উনি জিজ্ঞাসা করলেন “নামায তো অনেক আগেই শেষ হয়েছে, এখনো দাঁড়িয়ে আছ যে!!” আমি উত্তর দিলাম, “না মানে আমার জুতাজোড়া হারিয়ে গেছে, এখন কী করবো বুঝতে পারছি না।” তখন ঐ ভাইয়াটা একটু দুঃখ প্রকাশ করলেন, তারপর বললেন, “আচ্ছা, তুমি একটু এখানেই দাঁড়াও, আমার বাসা এই কাছেই। আমি এখুনি তোমার জন্য একজোড়া জুতা নিয়ে আসছি।” এই বলে ভাইয়াটা চলে গেলেন; আর একটু পরেই হাতে করে এক জোড়া স্যান্ডেল নিয়ে আসলেন। বললেন, “এখন এগুলো পরে আপাতত বাসায় যাও, পরে ফেরত দিলেই চলবে।”

আমার চোখে আরেক দফা পানি আসলো, এবার কিন্তু দুঃখে নয়, আনন্দে। আমি ঐ ভাইয়াটাকে কী বলে ধন্যবাদ দিব বুঝতে পারছিলাম না। আনন্দের আতিশয্যে আমি শুধু “থ্যাঙ্ক য়ু” বলে এক দৌড়ে বাসায় চলে আসলাম। এমনকি ভাইয়ার নামটাও জিজ্ঞাসা করা হয় নি।

যা হোক এ ঘটনার পরদিনই সেই ভাইয়ার সাথে আবার আমার দেখা হল মসজিদে। উনার জুতা উনাকে ফেরত দিলাম। এরপর ভাইয়ার পরিচয় জানলাম। উনার নাম “সাব্বির আহমেদ”। ঢাকা ভার্সিটিতে দর্শন বিভাগে পড়েন। অসাধারণ একজন মানুষ। খুব অল্প কয়েকদিনেই উনার সাথে আমার এক গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। উনার চাল-চলনে, আচরণে, কথাবার্তায় দিন যতই যেত ততই অবাক হতাম আমি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল উনি আমাকে সবসময় কুরআন ও হাদীস পড়তে বলতেন। আমার আব্বা-আম্মা এমনিতে হুযুর হুযুর, আর আমিও অনেকবার তাবলীগে গিয়েছি ও কাজ করেছি। কিন্তু কখনোই কেউ আমাকে কুরআন-হাদীস বুঝে বুঝে পড়তে বলে নি, এমনকি গুরুত্বও বুঝায় নি। আমি তাই ধীরে ধীরে কুরআন ও হাদীস পাঠ শুরু করি। একদিন সাব্বির ভাইয়া আমাকে কুরআনের কয়েকটি আয়াত ও কয়েকটা নির্দিষ্ট হাদীস পাঠ করতে বললেন। সেই সাথে বললেন এসব থেকে আমি কী শিখলাম তা তিনি জিজ্ঞাসা করবেন। ইসলামে দাওয়াত ও সংগঠনের গুরুত্ব নিয়ে ছিল এই আয়াত ও হাদিসগুলো। আমি বুঝতে পারছিলাম সাব্বির ভাই আমাকে নতুন কোন বিষয় শিক্ষা দিতে চাইছেন, আর তিনি এটাও চাচ্ছিলেন যেন আমি নিজ থেকে এসব জিনিস শিখি।

একদিন আমার হাতে সাব্বির ভাই ছোট ছোট কয়েকটি বই ধরিয়ে দিলেন, বললেন সেগুলো পড়তে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এসব বইএর কয়েকটি বই এমন ব্যক্তিদের লেখা যারা এখন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক। আমি সাব্বির ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কীরে ভাই আপনি আমাকে এসব যুদ্ধাপরাধীদের লেখা বই দিচ্ছেন!!”

এই কথা শুনে সাব্বির ভাই মৃদু হাসলেন। বললেন, “তুমি যুদ্ধাপরাধীদের লেখা বই দেখে অবাক হয়েছ?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, হলাম।” তিনি বললেন, “আচ্ছা তুমি এজন্য অবাক হতে পারলে না যে এসব বড় বড় যুদ্ধাপরাধীরা ইসলামী বই লেখলো কেমনে? আর যদি লেখেই তাহলে একটু পড়ি তো!! দেখি তো তারা কী লিখলো!!”

-আমি চুপ। উনি আবারো বললেন, বুশ, ক্লিন্টন, ওবামা উনারা কেউই তো খুব ভালো লোক না। উনাদের লেখা বই যদি মানুষ পড়তে পারে, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের লেখা বই পড়লে দোষ কী?! আমি তোমার জায়গায় থাকলে তো আরো অধিক উৎসাহী হয়ে এসব বই পড়তাম!! কারণ মিডিয়া তে তো খালি এনাদের বিরুদ্ধাচরণই শুনি। ইনাদের কথা তো আর জানতে পারি না, তাই না?

আমি লা-জওয়াব হয়ে গেলাম। অগত্যা সেসব বই পড়ার জন্য বাসায় নিয়ে এলাম। পড়লামও। আর যতই সেগুলো পড়লাম ততই অবাক হলাম যে এদের মত এদের মত খারাপ লোকেরা এত জ্ঞানগর্ভ ইসলামিক ও গঠনমূলক বই কীভাবে লিখলো?? সাধারণ ভালো মানুষও তো এত সুন্দর করে লিখতে পারার কথা না!!

ইতোমধ্যে আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগলো সাব্বির ভাইকে। সে সন্দেহ মোটেই কোন বাজে সন্দেহ না। বরঞ্চ মানুষটার ভিতরে লুকিয়ে থাকা আরো ভালো মনুষ্যত্ব লুকিয়ে থাকার সন্দেহ।

অবশেষে সেই সন্দেহের পরিসমাপ্তি ঘটলো একদিন। সাব্বির ভাই আমাকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের দাওয়াত দিলেন। সাব্বির ভাই যে আমার দেখা সবচেয়ে ভালো যুবক ও কাছের মানুষ এতে আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না তবে শিবির নিয়ে আমার প্রবল আপত্তি। আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না সাব্বির ভাইয়া শিবির করেন। আমি আশ্চর্য হয়ে সাব্বির ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ভাই আপনি শিবির করেন??!! মানে আপনিও বোমা ফাটান, রগ কাটেন, জঙ্গীবাদী করেন??” তখন উনার জবাব, “আমাকে দেখে তোমার কি তা-ই মনে হয়?” আমি সত্যি কথা বললাম, “মোটেও না। বরং তার উল্টা মনে হয়।” উনি বললেন, “তাহলে আমি যে সংগঠন করি তা যদি এতোই খারাপ হয়, তাহলে আমি ভালো থাকি কী করে?” সাব্বির ভাইএর মুখে মুচকি হাসি। আমিঃ “না, মানে--- তাহলে কি শিবির ভালো? তাহলে শিবির সম্পর্কে যে এতকিছু শুনি??!! মানুষজনের মাঝে শিবির নিয়ে যে এত আতঙ্ক!!” আমি বললাম।

“শোনো, শিবির মোটেও কোনো জঙ্গীবাদী সংগঠন না। বরং আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল(স) প্রদর্শিতউপায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করাই শিবিরের লক্ষ্য। কিন্তু যারা ইসলামবিরোধী ও ক্ষমতালোভী তাদের কাছে এটি একটি আতঙ্কেরই নাম। কেননা ইসলাম প্রতিষ্ঠা হলে তাদের সব জারিজুরি খতম হয়ে যাবে। তাই তারা চায় মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে সেই আতঙ্ক মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে, যাতে কেউ শিবির না করে।”

এরপরের ঘটনা স্বাভাবিক, কালক্রমে শিবির আতঙ্কে ভোগা এক স্কুলছাত্র নিজেও শিবিরে যোগদান করে। সে এখন জানে, শিবির আসলেই এক আতঙ্কের নাম, তবে সাধারণ মানুষ ও মুসলমানের জন্য নয়, বরং ইসলামবিরোধী ও ক্ষমতালিপ্সু কুচক্রীদের জন্য।

বিষয়: বিবিধ

১৪৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File