* জারিন *
লিখেছেন লিখেছেন বিডি রকার ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১১:৫৪:০৫ রাত
জানি না মানুষ জীবনে বাল্যকালেই প্রেমে পড়ে নাকি ? তবে আমি পড়েছিলাম ....
খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার এই যে , যে বয়সে আমি প্রেমে পড়েছিলাম তখন হয়তো আমি ঠিকমত জানতামও না প্রেম কি !
কেননা আমি তখন মাত্র ক্লাস টু তে পড়ি । আর জারিন তো আরও ছোট ছিল । আমার চেয়ে এক ক্লাস নিচে ক্লাস ওয়ানে পড়ত সে ।
জারিনের মা আমার আম্মুর বান্ধবী হওয়াতে প্রায়ই আসতেন আমাদের বাসায় । প্রতিদিন দেখতাম আন্টির সাথে একটা পরীর মত মিষ্টি মেয়ে টুকটুক করে হেঁটে আসে । কালো মাঝারি আকারের চুলগুলোকে দুটো উঁচু বেণী করে বাঁধা ।
আমার কোনও বোন ছিল না । তাই ঘরে বাহিরে ক্লাসে যেকোনো মেয়েকে দেখলেই খুব আগ্রহ ভরে দেখতাম । মনে মনে কল্পনা করতাম আমার ছোটবোন হিসেবে – এরপর মানসপটে দৃশ্যকল্প সাজাতাম ।
বাস্তবের আচরণের সাথে যখন ইচ্ছের মিল হত না তখন সেই মেয়েকে বাদ দিতাম । ভাবতাম যাকগে – এরকম মেয়ে আমার বোন হিসেবে না থাকলেই ভালো । সে অধিক কথা বলবে – আমার পড়ার ডিস্টার্ব করবে । টিভি দেখতে গেলে ঝগড়া লাগাবে ।
সম্ভবত জারিনই একমাত্র মেয়ে যাকে দেখা মাত্র আমি সেই হিসেবেই ফেলতে পারলাম না । কেন যেন তাকে বোন হিসেবে কল্পনা করাটা আমার পক্ষে সভব হয়ে উঠেনি !
হাহ হা । আপনারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমার ছোটবেলার স্বভাবকে অনেকটুকুই আঁচ করে ফেলেছেন ?
- ঠিকই ধরেছেন । বয়স হিসেবে আমার মানসিক সেই সাথে শারীরিক গ্রোথ একটু দ্রুতই হয়েছিল বৈকি !
তা নাহলে , আপনি কি কখনও শুনেছেন ক্লাস ওয়ানের ছেলে অবসরে শুয়ে শুয়ে বাবা হওয়ার স্বপ্ন দেখত , যেই বাবার হাত ধরে থাকবে একটা সোনালি চুলো দেবশিশু ! ক্লাস টুতে থাকতে হুমায়ূন আহমেদের রীতিমত ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম । যে বয়সে আমার সহপাঠীরা ছোটদের কার্টুন দেখে শিশুসুলভ গল্প এমনকি মারামারি পর্যন্ত করত – তখন আমি ইংলিশ সিনেমার জটিল কাহিনীগুলো নিয়ে আলোচনা করার কাউকে না পেয়ে তীব্র অস্বস্তিতে ভুগতাম !
সবসময় ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসলেও অতিরিক্ত লম্বা হবার কারণে আমার মাথাটা সহজেই নজরে পড়ত টিচারদের ।
এই ছিলাম ছোটবেলার আমি ! বাচ্চা বয়সেই এক অদৃশ্য বার্ধক্য এসে ভর করেছিল আমার উপর ।
সেই আমি’র জন্য বাল্যবয়সেই এক অসম্ভব সুন্দর মেয়েকে পছন্দ করে ফেলাটা স্বাভাবিকই বটে ....
*****
জারিনের সাথে আমার পরিচয়ের শুরুটা এভাবেই ...
আমাদের বাসায় এসে আন্টি আর আম্মু তীব্র খোশগল্পে মেতে উঠতেন । অপরদিকে আমি আর জারিন আমাদের মত সময় কাটাতাম ।
কখনও ব্লক দিয়ে খেলতাম । পিচ্ছি মেয়ে জারিন এতকিছু বানাতে পারত না । তাই আমিই নানারকম গাড়ি বাড়ি বানিয়ে তাকে চমকে দিতাম । বন্ধুদের কাছ থেকে শেখা কয়েনের ম্যাজিক দেখাতাম আর জারিন তা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখত ।
মাঝে মাঝে ছাদে আমার ফুলবাগানে নিয়ে যেতাম । একেকটা ফুল দেখাতাম আর জারিন শিক্ষার্থীর মত শুনত। কখনও প্রশ্ন করত , আমিও শিক্ষকের মত তাকে বুঝিয়ে দিতাম । এরকম ঘুরাঘুরির সময়েই বুঝতে পারলাম , আমার সাদা গোলাপের কালেকশনটা তার অনেক ভালো লেগেছে , কেননা ঘুরে ফিরে সে ঐ জায়গাটাতেই এসে দাঁড়িয়ে যেত – গন্ধ শুঁকত । গালের সাথে ফুলের পাপড়ি ঘষত ।
একদিন তাই এক তোড়া সাদা গোলাপের ফুল সাজিয়ে তাকে গিফট দিলাম । একরাশ বিস্ময় নিয়ে যখন সে আমাকে প্রশ্ন করল , ‘ তুমি কিভাবে বুঝলে সাদা গোলাপ আমার ভালো লেগেছে ?? ’ – তখন আমি কোনও কথা বলিনি । কেবল বুকভরা তৃপ্তি নিয়ে একগাল হাসলাম ।
****
ছোটকালের এই পবিত্র সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল যেমন আকস্মিক , তেমনি এর সমাপ্তিটাও ছিল অতর্কিত !
এভাবে যখন আমার আর জারিনের ভালোবাসা শুরু হয়েছিল - তখন হঠাত করে আম্মুর সেই বান্ধবীর আসা বন্ধ হয়ে যায় ।
একই সময়ে আমারও ইস্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয় । সারা বছর পড়াশুনা করতাম না । কেবল পরীক্ষার সময় আসলেই চোখ মুখ বুজে পড়তাম – এই ছিল আমার নীতি । তাই প্রবল ইচ্ছে থাকলেও জারিনের খোঁজ নেওয়া সেই মুহূর্তে আর হয়ে উঠেনি ।
পরীক্ষা যথারীতি শুরু হল , কিন্তু এরপর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেই পরীক্ষা শেষ হতে হতে অনেকদিন পেড়িয়ে গেল ।
অবশেষে সেই পরীক্ষার বোঝা মাথা থেকে নামল । দেরি না করে সাথে সাথেই জারিনের খোঁজ নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলাম । কিন্তু হায় – ক্লাস টু তে পড়া সেই ছেলে অল্প বয়সেই মুখোমুখি হয়ে গেল চরম বাস্তবতার ।
আম্মুকে জিজ্ঞাসা করার সাথেই সাথেই ব্যস্ততার অজুহাতে এড়িয়ে গেলেন । অনেক কষ্টে ফোন নাম্বার জোগাড় করে যখন ফোন দিলাম তখন ফোনের ডেড টোনটি ছাড়া আর কিছু শুনার সৌভাগ্য হয়নি ।
যে ডায়েরীতে আন্টির বাসার নম্বর লেখা ছিল – সে ডায়েরী কোনোক্রমেই খুঁজে পেলাম না । হতাশ মনে যখন আমি পাগল প্রায় , তখন আবার শুরু হল আম্মুর চোখ রাঙ্গানি ! একদিন ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , ‘ আমার সাথে জারিনদের এতো কি ? ’ । তখন লজ্জা আর অভিমানে সেই যে চুপ হয়ে গিয়েছিলাম তারপর অনেকদিন কেটে গেল .....
****
কোনও এক শীতকালে আবার সে আন্টি আমাদের বাসায় আসলেন । কিন্তু পার্থক্য এই যে , সাথে কোনও পরীর মত মেয়ে ছিল না ।
তবুও বুকে আবার আশার সঞ্চার হল । হারানো প্রিয়জনকে ফিরে পাবার এক সূক্ষ্ম সম্ভাবনা থেকে দৌড়ে গেলাম যেখানটায় আম্মু আর আন্টি কথা বলছিলেন ।
অনেকক্ষণ ধরে সেখানে স্তব্ধ মূর্তির মত দাঁড়িয়ে কি শুনেছিলাম জানি না , শুধু বুঝেছিলাম আমার জানপাখি জারিন আর নেই !
হঠাত টাইফয়েড হওয়ার পর প্রায় ১ মাসের মত হাসপাতালে ছিল । ডাক্তাররা যখন বললেন রোগী আশংকামুক্ত - তার ৩ দিন পরেই কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই মারা যায় সে !
--
শৈশবের সুখসৃতিগুলোর ইতি আমার সেইদিনই ঘটে । তিন মাসের মত অসুস্থ ছিলাম এরপর । অনেক দৌড়াদৌড়ির পর শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হলেও মানসিকভাবে আমি এখনও সুস্থ নই ।
দেশ থেকে আজ শত মাইল দূরে বসেও যখনই আমার সেই ছোট্ট প্রেয়সীর কথা মনে হয় – বুকটা ডুকরে কেঁদে উঠে । আজও সাদা গোলাপ দেখলেই বুকটা ‘ কি নেই কি নেই’ বলে হাহাকার করে ।
.
.
দেশে আম্মু বিয়ের জন্য পাত্রী দেখে , আর দুদিন পরপর ফোন দেয় । আমি ধরি না – অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পরে ধরলেও কথা বলিনা । আম্মু একনাগাড়ে মেয়ের বিবরণ বলে যান – কিন্তু আমি শুনি না ।
বন্ধুবান্ধবেরা মাঝে মাঝে বিয়ের ব্যাপার নিয়ে কথা উঠলে খোঁটা দেয় , আর আমার ক্রন্দনরত অন্তরটা তখন বোবা হয়ে থাকে ।
জানিনা কোনও মেয়েকে বউ বানিয়ে ঘরে তুলা সম্ভব হবে কিনা । তবে এতটুকু জানি যার সাথে আমার মনের বিয়ে হয়ে গেছে তাকে আমি কখনই হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারব না ।
--
লেখকঃ বিডি রকার ( রাকিব )
বিষয়: বিয়ের গল্প
৩৭১৪ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন