একজন অনাগত..........

লিখেছেন লিখেছেন বিডি রকার ০৭ এপ্রিল, ২০১৩, ০৯:০৯:০০ রাত

মায়ের নাম ঘোষণা করা হয়েছে -শারমিন আফসানা । মা চেয়ার থেকে উঠছে , টের পাচ্ছি আমি । নিশ্চয়ই এখন দাড়িয়ে কিছুক্ষণ বক্তৃতা দেবে । মায়ের সুমধুর গলা আমার খুবই পরিচিত । বিশেষ করে মা যখন তার বক্তৃতার মাঝে মাঝে কোরআন ও হাদিসের বাণী পাঠ করে তার শিক্ষা দেয় , তখন আমার যে কি ভাল লাগে ! কিন্তু সমস্যা হল আমি তো কাউকে কিছু বলতে পারি না। কেউ আমার কথা বুঝে না । কেবল আমার মাই আমাকে বুঝে , আমাকে আদর করে ।

মা তার বক্তৃতা শুরু করেছে । দাড়িয়ে করছে না , সবার অনুরোধে বসেই করছে । আমাকে যে সৃষ্টি করেছেন , সেই আল্লাহর লীলা কত অদ্ভুত ! তাই না । কী সুন্দর আমি আমার মায়ের পেটের ভিতর বসে দিব্যি মায়ের সব কথা মা কি সুন্দরভাবে সবাইকে ইসলামের কথা শোনাচ্ছে । মা সবসময়ই সহজ সরলভাবে মাধুরতার সাথে কথা বলে । মা যখন কথা বলে , তখন আমার শত খিদে লাগলেও আমি চুপ করে থাকি , কান পেতে মায়ের সব কথা শুনি । মা এখন মহিলাদের একটি ইসলামি সংগঠনের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন । মহিলাদের পর্দার বিষয়ে এক জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা রাখছেন । অবশ্য অনেক বিষয়ই আমি ঠিকভাবে বুঝছি না । তারপরেও যা বুঝেছি তা হল প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের জন্য পর্দা করা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় ক্ষেত্রের জন্যই জরুরি ।

ওহ হো , আমি তো কেবল আমার মায়ের কথাই বলছি ,আমার বাবার কথা কেবলই ভুলে যাচ্ছি । আসলে আমি তো সব সময় মায়ের সাথে থাকি , মায়ের মাঝেই আমার বসবাস ; তাই মায়ের মত ঘনিষ্ঠ আমার আর কেউ নাই । তবে আমার বাবাও আমার অনেক প্রিয় । কিন্তু সমস্যা হল , তিনি সারাদিন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন , কেবল রাতের সময়টুকু ছাড়া তার সাহচর্য আমি কমই পাই । তবে যেটুকু সময় থাকেন ,তখন তিনি আমাকে বাহির থেকেই অনেক আদর করেন ,আমার সাথে কথাও বলার চেষ্টা করেন । কিন্তু এখানেও সমস্যা , আমি তো মুখ ফুটে তার কথার জবাব দিতে পারি না । অবশ্য তারপরেও আমার কাছে বাবার কথা বলার ব্যপারটি অনেক মজা লাগে । আমার তখন মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীতে আসার আগেই সবকিছু এত সুন্দর , তাহলে পৃথিবীটা বুঝি আরও অনেক সুন্দর ।

আমার বাবাও ইসলামি দল করেন । তিনি মাঝেমধ্যেই আমার মার সাথে ইসলামের বিভিন্ন শিক্ষা ও নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন । তবে বেশ কিছুদিন যাবত বাবা-মা উভয়ের কথাবার্তাতেই তাদের বেশ চিন্তিত মনে হল । আমাদের দেশ ও ইসলাম নিয়ে তারা এখন অনেক আলোচনা করেন । ইশ , আমাদের দেশটার নাম যেন কি ? ও হ্যাঁ , মনে পড়েছে – বাংলাদেশ । বাংলাদেশের অবস্থা নাকি মোটেই ভাল না । এখন যারা এদেশের ক্ষমতায়, তারা নাকি খুবই খারাপ-ইসলামের শত্রু । তারা নাকি ইসলামকে ধ্বংস করে দিতে চায় ।এতে নাকি তাদের অনেক লাভ । অবশ্য কি লাভ –আমি ছোট হওয়ায় সেগুলো এত ভাল বুঝি না । এই কারণেই যারা এখন ইসলামের কথা বলে , তাদেরকে নাকি সরকার মেরে ফেলছে , গ্রেফতার করছে , অত্যাচার করছে । এসব কিছুর ফলে মা-বাবা দুজনেই দুজনকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিলেন । তাদের চিন্তা দেখে আমিও বেশ চিন্তিত হয়ে পরেছিলাম , কিন্তু পরমুহূর্তেই আমার মনে হল , আমার মা তো সবসময়ই আমার সাথে আছেন – আমার আবার ভয় কি ?

*****

ঘুমিয়ে পরেছিলাম আমি । কিন্তু বেশ হট্টগোলের শব্দে ঘুমটা আমার আর হল না। অনেক চেঁচামেচিও শোনা যাচ্ছে । কি হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা , কারন বাহিরে কি হচ্ছে তা দেখার অনুমতি এখনও আমাকে দেওয়া হয় নি । তাই কান পেতে কিছুক্ষণ বাহিরের কথা বার্তা শোনার চেষ্টা করলাম । শুনে যা বুঝলাম তা ভয়ংকর – আমার মায়ের অনুষ্ঠানটি চলাকালিন সময়ে পুলিশ এসে হানা দেয় । তারা নাকি এখানে উপস্থিত সকল মহিলাকে গ্রেফতার করবে , কারন তারা নাকি এখানে গোপনে জঙ্গি মিটিং করছে । আসলে আমি তো জানি এটা কত বড় মিথ্যা কথা । এর আগে আমি কখনো পুলিশ দেখিনি । তবে বাবা-মায়ের কথাবার্তায় যা জানতাম তাহলো পুলিশ হল খারাপ সরকারের নিজস্ব বাহিনী , সরকার এদের দ্বারা বিভিন্ন অপকর্ম করায় । যা হোক , আমি ভেবেছিলাম সবাইকে ধরলেও আমার মাকে তারা হয়তো ধরবে না । কেননা তিনি অন্তঃসত্ত্বা । কিন্তু আমি চরম অবাক হলাম যখন বুখলাম সেই পুলিশেরা আমার মাকেও ধরে নিয়ে যাচ্ছে । কি তাজ্জব ব্যপার ! তারা কি জানে না আমার মায়ের ভিতরে আরেকটি প্রানের অস্তিত্ব আছে । যার জন্য আমার মাকে অধিক কষ্ট সহ্য করতে হয় ,যার জন্য আমার মার অধিক বিস্রাম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যের প্রয়োজন হয় , যার জন্য আমার মার প্রতি নিতে হয় অধিক যত্ন । মা তো এখন শুধু একা নন , তার সাথে তো একটি অনাগত শিশুর ভবিষ্যতও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত । আমার চিৎকার করে এগুলো বলতে ইচ্ছা করছিল , কিন্তু কি করব আমার তো সেই ক্ষমতা নেই ।

কিছুক্ষণ পর টের পেলাম মাকে তারা সিঁড়ি দিয়ে নামাচ্ছে। তাকে খারাপ পুলিশগুলো দ্রুত কদম ফেলতে বাধ্য করছে । এর ফলে আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে । বুঝতে পারছি মারও নিঃশ্বাস নিতে খব কষ্ট হচ্ছে । এরপর নিচে নামানোর পর তাকে তারা একটি গাড়িতে উঠিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যেতে লাগলো । এতকিছুর পরও দেখলাম মা মোটেও ভয় পাচ্ছে না , বরং দৃঢ় প্রত্যয়ে বসে আছে । আর খানিকক্ষন পর পর তার পেটে হাত বুলিয়ে আমাকে মা যেন আমাকে বুঝাতে চাইলেন, “ বাবামনি আমার কোন ভয় পেও না ; আমি যতক্ষন বেচে আছি ততক্ষন তোমার কিছুই হবে না । ’’

মায়ের সান্ত্বনা বুঝতে পারলাম আমি । খুব ইচ্ছে করছিল বাবাকে ডেকে বলি , “ বাবা , দেখে যাও খারাপ লোকেরা তোমার স্বপ্নের সুন্দরী রানীকে তোমার রাজপুত্র সহ তুলে নিয়ে যাচ্ছে । আমাদের এসে দেখে যাও বাবা ।’’

জানি তা সম্ভব না । তবে এরপরও আমার বিশ্বাস , বাবা নিশ্চয়ই খবর পাবেন এবং আমাদের এসে উদ্ধার করবেন । এই সুখচিন্তায় বিভোর হয়ে আবার ঘুমের ঘোরে ঢলে পরলাম আমি ।

*****

মা কি কাদছে ? আসলে পেটের ভিতরে থেকে আমি যদিও কিছু দেখতে পারি না , তবে সবকিছুই খুব স্পষ্ট শুনতে পাই । আর শব্দ শুনে মনে মনে আমি সেই দৃশ্য কল্পনা করি । কিন্তু এই মুহূর্তে আমি বাহিরের শব্দ এতটা ভাল করে শুনতে পারছি না । তাই বুঝতে কষ্ট হচ্ছে আসলে বাহিরে কি হচ্ছে । আরেকটু ভাল করে শোনার চেষ্টা করলাম । হ্যাঁ , মা আসলেই খুব আস্তে আস্তে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদছে ।

মা এখন জেলের একটি অতি ছোট কামরায় বন্দি । মা যে রুমে বন্দি সেখানে মা ছাড়া আর কোন কয়েদি নেই । কেবল বাহিরে একজন মহিলা পুলিশ গার্ড দিচ্ছে । আমি যখন বুঝলাম , মা তার নিজের জন্য কাঁদছে না , কাঁদছে আমার জন্য –তখন আমারও খুব কান্না পেতে লাগল । আমি ভাবতে লাগলাম কয়েকদিন পর আমি যেই মানুশের এই পৃথিবীতে আসব সেই মানুষরা কি আসলেই এত খারাপ ! তারা কি বিনা অপরাধে কমবয়সী পর্দানশিন একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে এভাবেই জেলে আটকে রাখতে পারে । তারা প্রায় ১২ ঘণ্টার মত আমার মাকে অভুক্ত রেখেছে , যেখানে প্রতি ৬ ঘণ্টায় তাকে কিছু না কিছু খেতে হয় । অবশ্য এখন পর্যন্ত আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না । আমি এখনও স্বার্থপরের মত আমার অভুক্ত মায়ের শরীর থেকে খাবার ও পুষ্টি গ্রহন করছি । যদিও সেগুলো খাওয়ার এদিকে শুনতে পাচ্ছি ,মাকে নাকে আদালতে নেওয়া হবে । সেখানে হয় তাকে ছেরে দেওয়া হবে নতুবা তাকে নতুন করে কষ্ট দেওয়া হবে । তবে আমি নিশ্চিত , আদালতে বিচারকরা নিশ্চয়ই আমার মাকে বিনা শর্তে মুক্তি দিয়ে দিবেন । কারন তারা নিশ্চয়ই পুলিশের মত এতো নিষ্ঠুর আর খারাপ না ।

*****

মাকে এখন অপরাধিদের গাড়িতে করে আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে নাকি বাবার সাথে দেখা হতে পারে । এটা জানার পরে আমার একটু নির্ভার লাগছে । কারন বাবা নিশ্চয়ই আমাকে আর মাকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করবেন ।

অবশেষে অনেক ঝামেলার পরে আদালত কক্ষে ঢুকানো হয়েছে মাকে । শুধু মাকে নয় , মায়ের সাথে ঢুকানো হয়েছে একই সাথে আটককৃত অন্য সকল মহিলাদেরকে । তাদের সবাইকে একসাথে কাঠগরায় দাড় করান হয়েছে । অনেকক্ষণ যাবত বিচারকার্য চলল । আমি শিউড়ে উঠলাম , যখন শুনলাম পুলিশ অন্য সকল মহিলাদের সাথে আমার মাকেও রিমান্ডে নিতে চাচ্ছে । রিমান্ড কি জিনিস আমি আগে জানতাম না । কিন্তু এখন জানলাম এখানে নাকি অপরাধীদের মুখ থেকে কথা বের করারা জন্য ভয়ংকর নির্যাতন করা হয় । কিন্তু আমার মা সহ অন্য যে সকল মহিলারা এখন আদালতে উপস্থিত তারা কেউই তো অপরাধি নয় ।তাহলে তাদেরকে কেন রিমান্ডে নেওয়া হবে ? আমি ভেবেছিলাম বিচারক এসকল অভিযোগ ও আবদার আমলে না নিয়ে তাদের সবাইকে ছেড়ে দিবেন । কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিচারক রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করলেন । এই রায় ঘোষণা হওয়ার পর পরই শুনলাম আদালত কক্ষে অনেক হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে । উপস্থিতদের অনেকেই আদালতের এই রায়ে ক্ষিপ্ত । বিশেষ করে আমার মাকেও যখন রিমান্ডে নেওয়ার রায় দেওয়া হল তখন আদালত পুরো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হল ।

কিন্তু না অনেকগুলো পুলিশ আমাদেরকে কড়া নিরাপত্তার মাঝে গাড়িতে উঠাতে লাগলো ।আমার কেবল বাবার কথা মনে হচ্ছে । এমন সময় শুনলাম বাবার গলা । মাকে ডাকছেন তিনি । মাও বাবার ডাক শুনে জলদি সেদিকে ছুটে গেলেন , পুলিশগুলো সেই মুহূর্তে কিছুটা দয়া দেখাল । আমার মাকে বাঁধা দিল না । বাবা মাকে জরিয়ে ধরলেন । অনেকদিন পর বাবার উষ্ণ পরশ টের পাচ্ছি আমি । অবাক ব্যাপার বাবা কাদছেন ! এর আগে আমি কখনই বাবাকে কাঁদতে দেখিনি । এই মুহূর্তে বাবা কাদছেন , বরঞ্চ মা উলটো বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন । বলছেন , “ কিছুই হবে না । তুমি কেবল আমাদের জন্য দোয়া করো ।” বাবার চোখে দেখলাম ক্রোধের আগুন । শুনলাম বাবা চিৎকার করে বলছেন , “আল্লাহর কসম, যদি তোমার কিংবা বাবুর কিছু হয় , তাহলে আমি এর সাথে জড়িতদের যেভাবেই হোক যথাযথ শাস্তি দিয়ে তবেই মরব ।” এদিকে বাবা যখন কথা বলছিল তখন মহিলা পুলিশগুলো মাকে টেনে-হিচরে গাড়িতে নিয়ে ঢুকাল । আমি এতক্ষন মাকে কাঁদতে দেখিনি , কিন্তু গাড়িতে উঠার কিছুক্ষণ পর টের পেলাম মা ডুকরে ডুকরে কাদছেন । আমার খুব ইচ্ছে করছিল মায়ের মাথায় হাত রেখে বলি , মা তোমার এই ছেলেকে যে কষ্ট করে তুমি ধারণ করছ , যেভাবে জালিমদের হাতে কষ্ট ভোগ করছ ; তোমার এই ছেলে বড় হয়ে তার উপযুক্ত বিধান না করে তোমার সামনে আসবে না ।

*****

একটা ভরাট কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি । গলার স্বরটা মারাত্মক ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে । দ্রুত সজাগ হয়ে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করলাম । মাকে এখন একটা অন্ধকার রুমে রাখা হয়েছে । শক্ত লোহার একটা চেয়ারে মা বসে আছে । তার সামনে একটা টেবিল , টেবিলের ওপাশে বসে আছে ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে গলার সেই লোকটা । গলা শুনে লোকটার কুৎসিত চেহারাও কল্পনা করতে পারছি ।

লোকটা একটা খুপরির মত ছোট অন্ধকার রুমে মাকে একা বসিয়ে কি করতে চাচ্ছে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না । অনেকক্ষণ যাবত মাকে খুব নিম্ন ধরণের ভাষায় তার পরিবার-সংগঠন ইত্তাদি সম্পরকে জিজ্ঞাসা করছে লোকটা। তবে মা সেসব প্রশ্নের উত্তর খুবই স্বাভাবিক ভাষায় দিয়ে যাচ্ছে । অল্প কথা বলার চেষ্টা করছে মা । বুঝতে পারলাম এটাই হল রিমান্ড । তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি রিমান্ডে । বিক্ষিপ্ত প্রশ্ন করেই সময় ক্ষেপণ করছে লোকটা ।

ঠিক এমন সময়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল লোকটা । লোকটা মাকে বলল তার নেকাব খুলতে । আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না । পুলিশটা আমার মাকে তার নেকাব খুলতে বলছে !!

মায়ের মুখের কথা আটকে গেছে এই বীভৎস প্রশ্ন শুনে । হৃদপিণ্ডের কাঁপুনিটা অনেক বেড়ে যাচ্ছে – অনুভব সাথে সাথে আমারও খুব খারাপ লাগা শুরু হল ।

-পুলিশটা এবার বেশ জোরেশোরেই বলল , “ ঐ জামাতের মাইয়া , চোখ বড় বড় কইরা রাখছস কেন ? তোর উপরেরে চাদরটা সরা । তোরে দেইখাতো বেশ সুন্দরীই মনে হইতাসে । এই উল্লুকের মত কাপরটা দ্রুত খোল । এমন সুন্দর যৌবনময় চেহারা অনেকদিন যাবত দেখি না । তোর এমন খাসা চেহারা কালা কাপরে ঢাইকা রাখার জিনিস না । এমন রূপ দেখার অধিকার সক্কলের আছে । তুই বোরকা পরবি আর শুধু তোর জামাইরে তোর রূপ দেখাবি , তা হইবে না । আমাদের সকলেরই তো কিছু উপভোগ করবার মন চায় , নাকি । হাহ হাহ ......” এক বিদঘুটে হাসি দিল পুলিশের লোকটা । কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে আমার । ছোট কানগুলো ঝাঁ ঝাঁ করছে। মায়ের মুখ থেকে পানি সরে গেছে । দোয়া পড়ছে- টের পাচ্ছি আমি । খানিকবাদে আবার চেঁচিয়ে উঠল পুলিশের নরপশুটা – ঐ মাইয়া , কি বলি কানে শুনস না , ভাবছস তোর রূপ দেইখা আমি তোরে মাফ কইরা দিব । তুই মনে করছস , তুই সন্তানসম্ভবা দেইখা তোরে আমি এমনি এমনি ছাইরা দিমু । তোর বাচ্চার বাপের নাম ভুলাইয়া দিমু আমি , তুই যদি হেহ হে , এরপর তো এই ডিজিটাল যুগে তোর কি হইবে জানা কথা । আমার মুখ আর খারাপ করবি না কইলাম । পরে কিন্তু মুখের লগে হাতও চালামু ।

মায়ের কান্নার শব্দ ও কাঁপুনিতে আমার দেহও কাপছে । “ হে আল্লাহ , এই নরপশুদের হাত থেকে আমাকে আর আমার এই অবুঝ মাসুম শিশুটিকে রক্ষা করো । আমাকে হয় এদের হাত থেকে নাজাত দাও ,নতুবা এই অনাগত শিশুটি সহ শাহাদাত লাভের তাওফিক দাও ইয়া মাবুদ । যে দেশের জন্য , যে দীনের জন্য আমার মত নারীদেরকেও এখনও যে সকল মুসলিমেরা আজ ঘুমিয়ে , তুমি তাদের জাগিয়ে দাও । ’’ উচ্চস্বরে এভাবেই দোয়া পড়তে লাগলো মা । মা যখন এই দোয়া করছিল তখন সেই নরাধম পশুটা বারবার চিৎকার-গর্জন-হুঙ্কার দিয়ে মাকে বাঁধা দিতে লাগল কিন্তু শয়তানটি যত জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলো মাও তত জোরে জোরে দোয়া পড়তে লাগল । কিন্তু এ কেন জানি আমার মনে হচ্ছে মা সম্ভবত অচেতন হয়ে যাবে । এদিকে পুলিশটা তখনও পাগলের মত চিৎকার করছে । মা সংজ্ঞা হারানোর বেশ কিছুক্ষন পরে সে টের পেল যে মা অচেতন হয়ে গিয়েছে । এই অবস্থায় ব্যাটা পুলিশ খানিকটা ভয় পেয়ে গেল । মা যে হঠাত করে এমন অচেতন হয়ে যাবে তা মনে হয় সে চিন্তা করে নি । দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেল সে ।

মা অচেতন হয়ে যাওয়ায় আমারও দুর্বল লাগছে । তবে এই ভেবে ভাল লাগছে যে অন্তত পুলিশটা আমার মার কোন ক্ষতি করতে পারল না ।

*****

এরপর মাকে রিমান্ডে নিয়ে আর নির্যাতন করা হয় নি । তবে তার চেয়েও আশ্চর্যজনক ও ভয়ংকর ব্যাপার হল মাকে তারা একটির পর একটি মিথ্যা মামলা দিয়ে অনেকদিন জেলে আটকে রেখেছে । আজ অনেকদিন হল আমাকে পেটে ধারণ করে মা কারাগারের নির্জন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি । শুনেছি আমার বাবাকেও নাকি গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে । এদিকে জেলের মধ্যে মায়ের খাওয়া-দাওয়া সহ সকল ক্ষেত্রেই পোহাতে হচ্ছে অসম্ভব দুর্গতি । কষ্টের পর কষ্ট সামলাতে সামলাতে মার অনুভুতি এখন অনেকটাই ভোঁতা হয়ে গেছে। ঐ তো সেদিন আমার নানুমনি মাকে দেখতে জেলখানায় এসেছিলেন। তখন মার অবস্থা দেখে আমার নানুমনি অনেক কেঁদেছিলেন কিন্তু আমার মাকে দেখেছিলাম ঠায় দাড়িয়ে থাকতে ।

আমার অবস্থাও এখন খুব খারাপ । তবে মা এটা পুরোপুরি জানেন না । তিনি শুধু জানেন তার খাওয়া, বিশ্রামের অনিয়ম ও কষ্টের কারনে আমার স্বাস্থ্য খুব ভাল না । প্রকৃতঅর্থে আমার সাস্থের অবস্থা তার চেয়েও ভয়ংকর । কেবল আমিই তা টের পাচ্ছি । আমার এখন আগের মত শক্তি নেই , খুব বেশি খেতেও পারি না । সম্ভবত আমার নাড়ির সংযোগস্থলে কোন সমস্যা হয়েছে । তবে আমার কেন জানি এতে কোন ভয় লাগছে না । খালি একটা কথাই মনে হয় , কারাগারের এই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যেখানে জলজ্যান্ত মানুষেরই খারাপ অবস্থা , সেখানে আমি তো একজন অনাগত শিশু ।

*****

আজ সকালে আমি জানতে পারলাম আগামিকাল পৃথিবীতে আসব আমি । মাকে আজ চেকআপের সময় একথাই জানিয়েছেন ডাক্তাররা । কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছে আমি দুনিয়ায় আসতে পারব তো , নাকি তার আগেই আবার আমাকে বেহেশতে চলে যেতে হবে । এদিকে আমার মাকে দেখছি সকাল থেকেই আমার জন্য কাঁদছে । সম্ভবত আমার অবস্থা যে ভাল না , একথা তাকে জানিয়েছে ডাক্তাররা । মার এই করুন অবস্থা দেখে আমারও খুব কষ্ট হতে লাগলো । আমি খালি ভাবছি , পৃথিবীতে আসার আগেই আমাকে কত কঠিন বাস্তবতার শিকার হতে হচ্ছে !!

নাহ , আমাকে এখনি রণে ক্ষান্ত দেওয়া চলবে না । আমাকে পৃথিবীতে আসতেই হবে । অন্তত আমার মাকে যে কষ্ট দেওয়া হয়েছে তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হলেও আমাকে আসতেই হবে । যে সপ্ন নিয়ে মা এত কষ্ট ভোগ করেছেন তা অবশ্যই পুরন করতে হবে । এই অল্প দিনেই মায়ের কাছ থেকে যে বিপুল পরিমাণ ঋণ করেছি তার কিছুটা হলেও শোধ করতেই হবে । করতেই হবে...............

বিষয়: Contest_mother

১৫১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File