শুঁটকীয় ইতিহাসের হাত ধরে আসা যে সফলতা দেখে আমি বিস্মিত নই

লিখেছেন লিখেছেন কর্তা ২৪ জানুয়ারি, ২০১৩, ০১:২২:৩৪ দুপুর

আমাদের দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের দিকে তাকানোর প্রথম মাধ্যম আমাদের কাছে যেটি ছিল সেটি হল পাঠ্যপুস্তক। সেখানে অহরহ লেখা থাকতো “এ জাতি অন্যায়ের সাথে কোনদিন আপোষ করে নি” টাইপের কথাবার্তা, আমারও তা ই বিশ্বাস। আমার বড় চাচা শুটকির তরকারি খান না, একদিন তিনি গ্রাম থেকে হঠাৎ করেই আমাদের ঢাকার বাসায় এসে উঠলেন। সেকালে মোবাইল ছিল না, ফোন ছিল তবে আমাদের বাসায় ছিল না। তাই গ্রাম গঞ্জ থেকে আত্মীয় স্বজন এলে সারপ্রাইজ পেতাম। তাতে যে আনন্দ সে আনন্দ এখন কদাচিৎই মিলে। যাই হোক, চাচা এলেন হঠাৎ করে, বাসায় তেমন ভালো মানের তরকারি রান্না করা হয়নি। আম্মু লইট্টা মাছের শুটকি দিয়ে তরকারী রান্না করেছেন। আম্মু জানেন যে চাচা শুঁটকী খান না। তার পরেও গত্যন্তর না দেখে আম্মু শুঁটকী গন্ধ কিছুটা লাঘব করার জন্য তরকারিতে কিছু আমসত্ত্ব দিয়ে আবার গরম করে চাচাকে খেতে দিলেন। চাচা ভাত খেলেন, ভাত খেয়ে আম্মুকে ডেকে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বললেন “ভাবী! মাছের তরকারীটা বেশ মজা হয়েছে, ঢাকায় এমন টাটকা মাছ কই পেলেন!” আম্মু মুচকি হেসে বললেন “ভাই সাহেব! এতই যেহেতু মজা হয়েছে সেহেতু কোত্থেকে মাছ এলো তা না জানা থাকাই ভালো”। আম্মুর এই তেছড়া কথা বড় চাচা বুঝলেন না। কয়েকদিন পরে চাচা আবার সেই সুস্বাদু মাছের তরকারির কথা তুললে বড় আপু গোমর ফাঁস করে দিলেন। তখনতো বড় চাচার মাথায় হাত “তোর মা আমাকে এ কি খাওয়ালো!”

দেশের এই নাজুক মুহূর্তে আমারও মাথায় হাত উঠেছে, জাতিশুদ্ধ এতদিন আমরা কি তাহলে টাটকা মাছ মনে করে শুঁটকী খেয়েছি? না কথাটা এভাবে বলা চলে না, বরং বলতে হয়, এতদিন কি শুঁটকী রেঁধে আমাদেরকে কি তাহলে এতদিন মাছ বলে খাওয়ানো হয়েছে? তবে আমি এখন আর সন্দিহান নই, আমি নিশ্চিত যে একাজটিই করা হয়েছে আমাদের ক্ষেত্রে। সরকার বদলের সাথে সাথে পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসেরও বদল হয়েছে। সবাই ইতিহাসের দিক বদল করে কোনবার স্বামীকে উচ্চাসনে তুলেছেন আবার কোনবার পিতাকে উচ্চাসনে বসিয়েছেন। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে ইতিহাসের সিংহাসনেও নায়কের বদল হয়েছে কিন্তু ইতিহাসের খলনায়কের চেয়ারে কোন পরিবর্তন আসেনি। তৎকালীন ক্ষমতাধর জেলা প্রশাসক, টি এন ও, গ্রাম্য মোড়ল, মেম্বার, চেয়ারম্যান সহ চিন পন্থি বাম তথা চিনাবাদামদের খলনায়কের চেয়ার অলংকরণের কথা পাঠ্যপুস্তকের পাতায় কোনদিনই স্থান পায় নি। এই জেলা প্রশাসক, টি এন ও, গ্রাম্য মোড়ল, মেম্বার, ও চেয়ারম্যানরা তৎকালীন বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন কিনা তাও আমাদের জানানো হয়নি। এরা সবাই কি তৎকালীন নবীন দল জামায়াত ইসলামির সদস্য ছিলেন সেটাও কেউ বলেন না, যদি তারা জামায়াতের সদস্যই হয়ে থাকতেন তাহলে একটি নবীন দলের পক্ষে কিভাবে এতো জেলা প্রশাসক, টি এন ও, গ্রাম্য মোড়ল ও মেম্বার থাকে তার ব্যাখ্যা পরিষ্কার নয়। আর যে দলের পক্ষে এতো এতো জেলা প্রশাসক, টি এন ও, গ্রাম্য মোড়ল, মেম্বার থাকে তাদের কিভাবে নির্বাচনে ভরাডুবি হয় সেটাও কেউ বলেন না। এদিকে চিনাবাদামদের কথা, যেই ইনুরা শেখ মুজিবুর রহমানকে অযোগ্য দাবী করেও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হন, শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজানোর উচ্চাখাংখ্যা পোষণ কারীরা কিভাবে নির্দোষ বনে যান তাও জাতির কাছে ক্লিয়ার না। সর্বজনস্বীকৃত রাজাকারের সাথে কেমনে শেখ মুজিবের সাথে আত্মীয়তা হয় তাও কেউ জানে না। এইভাবে প্রশ্নের শেষ হবে না, অজানা থেকে যাবে অজস্র প্রশ্নোত্তর কিন্তু শুধু অন্ধ জাতীয়তা প্রেমের উপর ভিত্তি করে আকাশ ফুড়ে নামিয়ে আনা কিছু অভিযোগকে চল্লিশ বছর ধরে প্রচার করে জনগণের মাঝে অকাট্য সত্য হিসেবে প্রমাণ করা হয়ে যাবে। তার পর শুঁটকী হবে টাটকা মাছ। এই না হলে বাঙ্গালী জাতি!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্ম, ছাত্রত্ব, মুক্তিযুদ্ধপুর্ব, মুক্তিযুদ্ধকালীন, মুক্তিযুদ্ধ উত্তর কর্মকাণ্ড, এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তী অনেক কর্মকাণ্ডের বপারে বিপুল প্রশ্ন আছে। এই সব প্রশ্ন হালাল হয়ে গেছে “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” বলে, অথচ তিনি আসলেই স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কতটুকু ইচ্ছুক ছিলেন তা নিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন দিক অন্য ইঙ্গিতও যে করে তা কিন্তু এড়ানো যায় না। কিন্তু সমস্যা হল, আদর্শগত বিরোধীদের লেখা প্রবন্ধ, ইতিহাস, পত্রিকার খবর, প্রতিবেদন, পেপার কাটিং, ও ডকুমেন্টারি জামায়াত নেতাদেরকে যুদ্ধাপরাধ প্রমাণের জন্য “নির্ভরযোগ্য দলিল প্রমাণ” হয়ে যায় কিন্তু সেগুলো বায়াসড ভাবাটাই হারাম হয়ে যায়। চোর-বাটপার কে সাক্ষী হিসেবে আনা, বিপক্ষের সাক্ষীকে গুম করা, বিচারপতির স্কাইপ কেলেঙ্কারি, ও অন্যান্য বিতর্কিত এটর্নি ও প্রসিকিউটর সম্বলিত আদ্যোপান্ত বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল বিলকুল “দুধে ধোয়া তুলসী পাতা” হয়ে যায়। এগুলো একটাও অন্যায় নয় শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করাটাই সমস্ত দুনিয়ার একমাত্র দোষ যার কারণে হত্যা ধর্ষণ ও লুটের সকল দায়ভার ঐ জামায়াত নেতাদেরই ঘাড়ে চাপবে। অথচ স্বাধীনতার পরে দেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়া, দেশের আইন ও সংবিধানকে সম্মানের সাথে মেনে নেয়া ও দেশকে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টায় শামিল হওয়ার পরেও যেকোনো মূল্যে তাঁদেরকেই অপবাদ দেয়ার মাধ্যমেই কেবল স্বদেশপ্রেম উদ্বেলিত হয়ে পড়বে। মিথ্যুককে সাক্ষী বানিয়ে হোক, অন্যের দ্বারা রায় লিখিয়ে হোক, সংবাদকর্মীদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে হোক, ইতিহাসকে বিকৃত করে হোক এগুলো কখনও অন্যায় ও অবিচার হবে না। এমন ভাবে অন্যায়ের শক্ত আখড়ায় দেশ পরিণত হওয়ার পরেও যে জাতি এখনও অন্যদের বুদ্ধিতে চিন্তা করে তাঁরাই শুধুমাত্র ভাষার কারণে একদিন রাস্তায় নেমেছিল বলে আমার বিশ্বাস হতে চায় না। এতো এতো অন্যায়ের পরেও যখন মানুষ নিজের বুদ্ধি বিবেক না খাটিয়ে বসে থাকে তারা অবশ্যই অন্যায়ের সাথে আপোষ করছে। আগে হয়তো করেনি, এখন করছে।

এই আপোষের একমাত্র কারণ হচ্ছে, আমাদের পাঠ্যপুস্তকে লিখিত ইতিহাস, নাটক-সিনেমাতে চিত্রিত ইতিহাস ও টিভি প্রোগ্রামে আলোচিত ইতিহাসের পরতে পরতে শুঁটকীর উৎকট গন্ধ বিরাজ করছে। সেই উৎকট গন্ধগুলোকে “অন্ধ স্বদেশপ্রেম” ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির বাহানা দিয়ে চরম আবেগাপ্লুত আবেশের সংমিশ্রণে টাটকা মাছের স্বাদ দেয়া হয়েছে। সে জন্য নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে যখন আলেম উলামাদেরকে নির্যাতন করা হয় তখন কেউ কথা বলে না অপরদিকে একটি বেশ্যা বা লালুচের জীবন রক্ষার্থে রাস্তায় নেমে পড়ে সুশিলবাবুদের দল।

মোট কথা বাংলার মাটিতে নাস্তিক-সেকুলার জোট সফলকাম হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ ওরা আমাদের মুসলিম যুবকদের কে পর্দানশিন নারীদের ঘৃণিত করতে ও রঙ্গিন পর্দার বেশ্যাদের ভালবাসতে শেখাতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের মন ও মগজে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত সাহাবিদের (রা) নাম মুছে দিয়ে চিত্রনায়ক-নায়িকা ও গায়কদের নাম স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। আজান শুনে মসজিদে ছোটা সমাজকে সিনেমার পর্দায় আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে। শালীন পোশাকের মা-বোনদেরকে অর্ধ নগ্ন করতে সক্ষম হয়েছে। ইজ্জত ও আব্রু রক্ষকরে চলা যুবতীদেরকে যৌবন ফেরীকরে চলা শিখিয়েছে। ফজরের পরে কুরান তিলাওয়াতে অভ্যস্ত পরিবারগুলোর হাতে হারমোনিয়াম তুলে দিতে সক্ষম হয়েছে। গ্রামবাংলার মক্তবে ছুটে চলা শিশুকিশোরদের পথ ব্রাকের স্কুলের দিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। ইসলামি বই পুস্তক গুলোকে জঙ্গি বই হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। এভাবে ইসলাম ও নৈতিক সকল দিককে ঘুরিয়ে দিয়ে অনৈতিকতার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে গোটা নব-প্রজন্মকে তাদের নিজেদের মতোই নাস্তিক-সেকুলার বানিয়ে ফেলেছে। তাদের এই সফলতার সবচেয়ে চমকপ্রদ দিকটি হল যে এই দিকভ্রান্ত নব-প্রজন্ম নিজেরাই অবগত নয় যে তারা আদতে নাস্তিক-সেকুলার বনে গিয়েছে। একেবারে টাটকা মাছের আদলে শুঁটকী মাছের মতন।

আলিম উলামাদের উপর নির্যাতন, ইসলামের উপর উপর্যুপরি আঘাতসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অন্যায় জুলুমের পরেও কেন এদেশের জনগণ নির্বিকার এ কথা ভেবে অনেকেই অত্যাশ্চর্য হয়ে যান। আমি মোটাই বিস্মিত হই না। আমি বরং আশান্বিত হই এই ভেবে যে এই অন্ধদের দেখেই আলোর পথ খুঁজে পাবে গুটিকয় যুবক, এই দুর্দিনে সাচ্চা ইমানের অধিকারীদের ভিড়ে মুখ লুকিয়ে থাকা দ্বিধান্বিতরা একে একে ঝরে যাবে। অতঃপর আমরা হাতে পাবো এমন এক কাফেলা যারা সত্যের পথে হবে নির্ভীক। এই কাফেলা তো সেই কাফেলা যার পথ-চলা শুরু হয়েছে সেই বদরের প্রান্তর থেকে যা আজ অবধি চলছে...চলবে।

বিষয়: বিবিধ

১১৮০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File