মাওলানা এ কে আযাদের ফাঁসির রায় এবং কিছু কথা
লিখেছেন লিখেছেন কর্তা ২২ জানুয়ারি, ২০১৩, ০২:৫৪:০০ দুপুর
মাওলানা আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির রায় যে ঘোষিত হবে তা আদালতের মাননীয় বিচারপতি বিচারের রায় লিখার আগেই সকলের জানা ছিলো। যারা যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে আছেন তারা যে কোনও মূল্যে যুদ্ধাপরাধের অপরাধে আটক ব্যক্তিদের ফাঁসি চান। এক্ষেত্রে তাদের নীতি হচ্ছে “দি এন্ড জাষ্টিফাইজ দ্যা মিনস” অর্থাৎ অবিচার করে হোক, বিতর্কিত পন্থায় হোক, পক্ষপাতিত্ব করে হোক, পদোন্নতির লোভে হোক, আদর্শিক দ্বন্দ্ব প্রসূত ক্ষোভ থেক হোক, রাজনৈতিক ক্ষোভ থেকে হোক এদের ফাঁসি হলেই সাতখুন মাফ। অন্যায়, অবিচার, মিথ্যা, অযৌক্তিকতা, লিগ্যাল এথিকস থেকে শুরু করে ষোল আনা লঙ্ঘিত করেও এদের ফাঁসি হলে ষোল আনাই বেকসুর মাফ করে দিতে তারা প্রস্তুত। এদিকে যারা মনে করেন না যে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ একজন যুদ্ধাপরাধী তারা সরকার, মিডিয়া, ও আদালতের একেকটি প্রকাশ্য ও স্পষ্ট অসংগতিকে প্রশ্রয় এবং সেগুলোকেই সত্য ও ন্যায় বলে প্রতিষ্ঠিত করার যে প্রয়াস চালিয়ে গেছেন তা দেখে আগে থেকেই জেনে নিয়েছেন যে রায়টা মাওলানা আযাদের বিপক্ষেই যাবে। এবং তারা এও নিশ্চিত ছিলেন যে রায়টা ফাঁশির আদেশ হয়েই আসবে।
মাওলানা আবুল কালাম আযাদ নিঃসন্দেহে একজন স্বনাম ধন্য আলিম ছিলেন। তাঁর সুখ্যাতি দু হাজার দশ সালের আগ পর্যন্ত কোন অংশেই ম্রিয়মাণ ছিল না। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের তোড়জোড় শুরু হতেই তাঁর নাম উঠে এলো। আযাদ সাহেব তাঁর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের ব্যপারে খুব একটা উচ্চবাচ্যও করেন নি। করলেও মিডিয়ার ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাবের কারণে সেটা যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়েই এসেছে। কথার টোন, প্রেক্ষিত, শব্দ চয়ন ও প্রাসঙ্গিকতাকে হালকা এদিক সেদিক করলেই একটি চরম মার্জিত বাক্যকে কদাকার দেখানো সম্ভব। আজ পর্যন্ত মিডিয়া এ কাজটি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নিখুঁত ভাবে করে আসতে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে মাওলানাকে সরকার পলাতক দাবী করছে, আদালতের চোখেও তিনি ফেরারি আসামী। আদালত ও সরকারের চোখে ফেরারি আসামীর ধারনাটা একদিকে যেমন রহস্যজনক সেই সাথে হাস্যকরও বটে। আদালত ও সরকার এই উভয় কৃত্রিম ব্যক্তি স্বত্বার চোখে অনেক ফেরারি আসামীই ইদানীং সদর্পে বুক ফুলিয়ে দেশের মাটিতে বিচরণ করছে। তাই তারা যখন মাওলানা কে পলাতক বলছেন তখন আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছেন তা বোধগম্য নয়। একথা বলার কারণ হচ্ছে সরকার যখন মাওলানাকে পলাতক ঠাওরাচ্ছেন তখন সাধারণ জনগণের কেউ কেউ মনে করেন মাওলানাকে গুম করা হয়েছে আবার কেউ কেউ এটাও বলছেন যে সরকারই তাঁকে অন্যত্র সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
মাওলানা যদি নিজের কোথাও সরে যান তাহলে সেটাকে আমি তাঁর জন্য উত্তম হিজরত হিসেবেই ধরে নিবো এবং কায়মনোবাক্যে চাইবো আল্লাহ যেন সে হিজরত কবুল করেন। আর যদি তাঁকে গুম করে ফেলা হয় তাহলে বাংলার ইসলামী বুদ্ধিজীবীদের ইতিহাসে তিনিই হবেন প্রথম সারির ইসলামিক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রথম যাকে জুলুমের সর্বোচ্চ পর্যায়গুলো অতিক্রম করতে হচ্ছে, এদিকে গুমের পর যদি তাঁকে মেরে ফেলা হয় তাহলেও তিনিই ইসলামী বুদ্ধিজীবীদের ইতিহাসে প্রথম শহীদ হবেন। সে ক্ষেত্রে আল্লামা আবুল কালাম আযাদ সত্যিই একটি মাইলফলকের নাম, ইতিহাসের নাম। আর যদি তিনি সরকারের আঁতাতেই সরে যান তাহলে উনার মুখ থেকে কোন বক্তব্য শোনার আগে আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না। এটা হল ইসলামের প্রসারে বাংলার জমিনে তাঁর যে অবদান তার প্রতি আমার সম্মানের নজরানা।
মাওলানার ফাঁসির রায়ের প্রতিক্রিয়ায় পুরো জাতি তিনটি বিন্দুতে অবস্থান করছে, একটি অংশ এ রায় কে মেনে নেয়নি, আরেকটি অংশ এ রায় কে স্বাগত জানিয়েছে এবং আরেকটি অংশ মতামতহীন নিশ্চুপ রয়েছে (এ অংশটিই মূলত সংখ্যায় বেশী)। এ সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ বুঝাতে চাইছেন যে মাওলানার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হওয়াতে পুরো দেশ উল্লসিত, আবার কেউ কেউ বুঝাতে চাইছেন জাতি এ রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। এই পারস্পরিক ধস্তাধস্তিতে ইতিহাস, ঐতিহ্য তথা উপমহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাসে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, পাশাপাশি ইসলামের আদর্শিক ও মৌলিক জ্ঞানে অজ্ঞ কিন্তু যোশ ও আবেগে উন্মাতাল জনগণ গাধার মতো একবার এই পক্ষের মতামত বিশ্বাস করবে আরেকবার ঐ পক্ষের মতামত বিশ্বাস করবে। এভাবেই নিজেদেরকে “নিরপেক্ষ” বা “অরাজনৈতিক” দাবী কারি গর্ধব গুলো মূলত রাজনৈতিক পশুগুলোকে বেড়া হয়ে ক্ষেত খাওয়ার সুযোগ করে দেয়। অথচ এরা নিজেরাই জানে না জাতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কেউই মূলত নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক থাকতে পারে না। বরং তাঁদের অকারণ নিষ্ক্রিয়তাই দেশ ও ঐতিহ্যের বিপক্ষে কাল হয়ে দাঁড়ায়।
মাওলানা আযাদের যুদ্ধাপরাধের যে বিচার হল সেখানে মূলত সরকার খালি মাঠে গোল দিয়েছে, রেফারী আদালত সে গোল গুলো জাস্ট টুকে রেখে শূন্যের বিপরীতে কয়েক ডজন গোল দেখিয়ে সরকার পক্ষকে জিতিয়ে দিয়েছে। এটা আমরা সাধারণ জনগণ যেমন আঁচ করতে পেরেছিলাম তেমনি মাওলানা ও তাঁর পরিবারও নিশ্চই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই নির্বাক তাকিয়ে থাকা ছাড়া তারা আর কিছুই করেন নি। রাজনৈতিক দলমতে অন্ধ, আদর্শিক বিশ্বাসে অন্ধ, ইতিহাসের উৎসগত গ্রহণযোগ্যতার জ্ঞানে অজ্ঞ ও ইসলামী জ্ঞানে অজ্ঞ এই চার শ্রেণীর লোকেরাই বাংলাদেশে চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচারকে স্বাগত জানিয়েছে। যেহেতু পুরো মিডিয়া ও রাষ্ট্র যন্ত্র এদের মোটিভেশনের দায় দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে সেহেতু সরল মনা জনগণেরও একটা বড় অংশ এই রায় শুনে চুপ করে আছে।
এমনিতেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও নাটক সহ পুরো বিনোদন জগতে দাঁড়ি-টুপি পরিহিতদের কে সর্বদাই নেতিবাচক করে তুলে ধরা হয়, এবং রাজাকার চরিত্রটিকে হুজুর ও ইসলামিক অবয়বে সাজানো হয়। তাই এ দেশে হুজুর সম্প্রদায়ের কারো কিছু হলে জনগণের গায়ে খুব একটা লাগে না। মাওলানা আযাদের ক্ষেত্রেও সেটা লাগছে না, আল্লামা সাঈদীর ফাঁসি হলেও হয়তো কারও কিচ্ছু যাবে আসবে না। কিন্তু এ পরিস্থিতির বিপরীতে এদেশে ইসলাম সচেতনদেরও কিছু যায় আসে না। আমরা এসেছি, দেখেছি এবং সংগ্রামের পথে পথ চলেছি, আমরণ চলতে থাকবো। কে কিভাবে আমাদেরকে চিত্রায়ন করলো, কে কি ভাবলো আর কে আমাদের থোড়াই কেয়ার করে তাতে আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না। আমাদেরকে যেটা বুঝতে হবে সেটা হল, কেন আল্লামা সাঈদী, নিজামী, গোলাম আযম এবং মাওলানা আযাদ তাদের প্রথম টার্গেটে পরিণত হলেন?
আল্লামা সাঈদী তাঁর সহজ সরল ভাষায় ও সুললিত কণ্ঠে বাংলার মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলার নিম্নবিত্ত পর্যন্ত আপামর জনতার কাছে ইসলামের বিপ্লবী চেতনা কে তুলে ধরছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতো ঝানু সাহিত্যিক যেখানে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন “সহজ করে বলতে আমায় কহো যে, সহজ করে যায় না বলা সহজে” সেখানে আল্লামা সাঈদী ইসলামের বৈপ্লবিক দিকটার মতো কঠিন একটি বিষয়কে অত্যন্ত সহজ করে জনতার কানে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। এদিকে আল্লামা আবুল কালাম আযাদ তাঁর যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপস্থাপনার মাধ্যমে দেশের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী মহলের কাছে ইসলামের বৈপ্লবিক ও দৈনন্দিন শিক্ষাকে প্রচার করতে সফল হয়েছিলেন। আর মাওলানা নিজামী ও অধ্যাপক গোলাম আযম ইসলামের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলের ক্ষেত্রে দ্বীনের প্রায়োগিক দিক গুলোর সাথে বাস্তবিক সামঞ্জস্যতার আলোকে একটি সাহসী ও নির্ভীক কর্মী সম্বলিত কাফেলার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। দ্বীন ইসলামের এই ত্রিমুখী সফল প্রচেষ্টার যৌগিক ফল আমাদের জন্য আশানরুপ ছিল কিনা সেটা পরের বিতর্ক কিন্তু এই ত্রিমুখী প্রক্রিয়াটা যে সময়ে ব্যবধানে ঠেকে ঠেকে অনেক পরিণত হতে যাচ্ছিলো তা কিন্তু স্পষ্টতই আমরা বুঝতে পারছিলাম। আর এটা ক্রমাগতভাবে চলতে থাকলে সেক্যুলার ও নাস্তিক ঘরানার লোকদের স্বার্থের জন্য অপ্রতিরোধ্য বাধা হয়ে দাঁড়াতো বলেই আজ তারা বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছেতাই করে ফাঁসির মঞ্চে বরেণ্য ইসলামি নেতাদেরকে ঠেলে পাঠাচ্ছে।
সেজন্য আমাদের করনীয় হবে এক আযাদের অন্তর্ধানের আগেই লক্ষ আযাদের তৈরি করা, এক সাঈদীর কারান্তরীনের বিপরীতে লক্ষ্য সাঈদী তৈরি করা। তারা কেন যুদ্ধাপরাধী নন, এবং কেন এই বিচার অগ্রহণযোগ্য এই বিতর্কের যেমন ছেড়ে দেয়া চলবে না তেমনি এই বিতর্কে বেশী সময় নষ্ট করাও চলবেনা। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে মস্তক বিকিয়ে দেয়া এসকল মানুষকে কখনই বোঝানো যাবে না, দেশে গোয়েবলসীয় হলুদ সাংবাদিকতার স্পষ্ট সয়লাব দেখেও যারা সংবাদ পত্রের কথার উপর বিশ্বাস করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিধ্যান্ত নেয়, দেশের প্রায় সকল সংবাদপত্র সেকুলার এ বাম দের দ্বারা পরিচালিত জেনেও যারা তাদের কথা শুনে ইসলাম পন্থিদের ব্যপারে সিধ্যান্ত নেয় তাদের চিন্তাশক্তি একটি গৃহপালিত পশুর চেয়ে কিছুমাত্র বেশী হতে পারে না। এরা এখন যেমন স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দিয়েছে তেমনি আমরা যখন বিপরীতে স্রোত তুলতে সক্ষম হবো তখনও এরা সেই স্রোতে গা ভাসবে। তাই এদের নিয়ে চিন্তিত না হয়ে এখন আমাদের উচিত হল নিজেকে এবং নিজের অধীনস্থদেরকে একেকটা সাঈদী ও আবুল কালাম আযাদ হিসেবে গড়ে তোলা।
বিষয়: বিবিধ
১২৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন