বিএনপি জামায়াত ঐক্য: আদর্শিক না রাজনৈতিক

লিখেছেন লিখেছেন কামরুল আলম ০৫ জুন, ২০১৩, ১০:২১:৪২ সকাল



বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে দু’টি ধারায় বিভক্ত। একটি স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এর নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট বা ‘মহাজোট’।

যারা সাধারণত নিজেদের সবসময় ‘স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদ’ এ জোটের মৌলিক রাজনৈতিক আদর্শ। আওয়ামীলীগ ছাড়া এ জোটের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল হচ্ছে ‘বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি’।

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন এ দলটি অবশ্য অনেকটাই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির আদলে গড়া। মৌলিক চিন্তা চেতনা ও রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে অত্যন্ত সহজেই অনুমান করা যায় দলটি একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ‘আওয়ামী’ জোটে শরীক হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ দলের নীতিমালা ও কার্যক্রম বিএনপির সাথেই অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ, আওয়ামীলীগের সাথে নয়। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশা আল্লাহ। ভোটের রাজনীতির কথা বিবেচনায় আনলে এই ‘জাতীয় পার্টি’ ছাড়া ১৪ দল বা আওয়ামীলীগের সাথে আর একটি দলও নেই যাদের সহযোগিতায় আওয়ামীলীগ তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারে। মূলতঃ এই নির্বাচনী প্রয়োজনেই ‘স্বৈরাচার’ খ্যাত এরশাদের জাতীয় পার্টিকে আওয়ামীলীগ তাদের জোটে ঠাঁই দিয়েছে। তাইতো ‘বামপন্থী’ ছোটখাটো রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মোর্চায় জাতীয় পার্টিকে অনেকটাই বেমানান মনে হয়।

অন্যদিকে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে ৭৫ পরবর্তী দুঃসময়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট যাদের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘সর্ব শক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’।

বিএনপি ছাড়া এ জোটের প্রধান শরীক হচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশের ‘ইসলামী’ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ সংগঠন হচ্ছে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘বিতর্কিত’ ভূমিকা ছাড়া অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে জামায়াতের একটি ইতিবাচক অবস্থান। ভোটের রাজনৈতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই ‘জামায়াত’ ছাড়া উল্লেখ করার মতো আর একটি দলও বিএনপির সাথে নেই যাদের সহযোগিতায় তারা তাদের নির্বাচনী বৈতরণী সহজেই পার হতে পারে। মৌলিক আদর্শ ও বিশ্বাসের দিক থেকে বিএনপি ও জামায়াতের কিছুটা মিল থাকলেও বাস্তবে উভয় দলের মধ্যে রয়েছে ‘আকাশ-পাতাল’ পার্থক্য। কারণ জামায়াতে ইসলামী মূলতঃ একটি ধর্মীয় সংগঠন যার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে ‘দ্বীন কায়েমের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো’।

অপরদিকে বিএনপি সম্পূর্ণরূপে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল যাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে বস্তুতপক্ষে ‘আওয়ামীলীগের’ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যেরও তেমন কোন পার্থক্য নেই। যে কারণে অনেকেই বলে থাকেন ‘আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’ মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠ! সুতরাং নির্বাচনী প্রয়োজন ছাড়া ‘রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে বহুল পরিচিত এই জামায়াতের সাথে বিএনপির সখ্যতার অন্য কোন কারণ থাকতে পারে না। বাস্তবে নেই ও, যা আমাদের পরবর্তী আলোচনায় প্রমাণিত হবে আশা করি।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের রাজনীতি যে দু’টি ধারায় বিভক্ত তা মূলত ‘আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টি’ এবং ‘বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী’ এই চারটি দলের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া বা ক্ষমতার মসনদে উত্তীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। দেশ, জাতি তথা জনগণের কল্যাণ এখানে মূখ্য বিষয় নয়। এখানে আরেকটি বিষয় অত্যন্ত পরিস্কার হয়ে যায় যে, আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে ‘নির্বাচনী’ ঐক্য ছাড়া মৌলিক আদর্শ বা নীতিমালার কোন মিল না থাকলেও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে কিছুটা হলেও আদর্শিক মিল রয়েছে। এই আদর্শিক মিলের একটি মনস্তাত্তিক বিশ্লেষণই আমার আজকের নিবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়। এ বিষয়টি পর্যালোচনার সুবিধার্তে প্রথমে উভয় দলের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে আলোচনা করা জরুরি।

বিএনপির রাজনৈতিক দর্শন

আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের কয়েকজন বীর সিপাহসালারদের অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন বিএনপি বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ইতিহাস তাঁকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছে যদিও সে ঘোষণা তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকেই দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে যে কয়টি রাজনৈতিক দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) সক্রিয় ছিল তার মধ্যে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং কতিপয় বামপন্থী রাজনৈতিক দলই উল্লেখযোগ্য। যা তৎকালীন সময়ে জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতিফল ঘটাতে পারেনি বা তা ঘটানোর মতো তাদের রাজনৈতিক অবস্থানও ছিল না। সে সময় ‘বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ’ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ব্যাপক সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং প্রকৃতপক্ষে এ ভূ খন্ডে (বাংলাদেশে) তাদের কোন শক্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও ছিল না। সময়ের অনিবার্য বাস্তবতায় ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বের মানচিত্রে যখন স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ এর অভ্যূদ্বয় ঘটে তখন সেই নবজাতক দেশটিকে যে ধরণের পিতৃস্নেহে লালন পালন করার প্রয়োজন ছিল তার অধিকাংশই পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ‘জাতির পিতা’ খ্যাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর অবশ্য অনেক যৌক্তিক কারণ ছিল। এর মধ্যে প্রধান কারণ ছিল আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। একদিকে বাংলাদেশের মুসলিম জনসাধারণের সাথে তাদের মতাদর্শ ভিত্তিক ব্যবধান অন্যদিকে তাদের প্রবল স্বৈরাচারী মনোভাবের ফলে সাধারণ জনগণের সাথে তৈরি হয়েছিল তাদের যোজন যোজন দূরত্ব। ‘এক নেতা এক দেশ- বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ’ এই স্লোগানটির মতো যদি সত্যি সত্যি সেদিন জাতির সেই ক্রান্তিকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল রাজনৈতিক প্রতিকূলতা প্রতিহত করতে পারতেন বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সাথে তাহলে হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হয়ে যেত। কিন্তু তিনি তা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই আমরা রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে জানতে পারি। এরই প্রেক্ষিতে ওই সময় ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ জাসদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বলে জানা যায়। তৎকালীন সময়ে আওয়ামীলীগের প্রতিপক্ষ বলতে জাসদ ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বই কল্পনা করা যেত না। এমতাবস্থায় দেশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে স্বৈরতান্ত্রিক পন্থাকেই গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর রক্ষী বাহিনীর জ্বালায় অতিষ্ঠ মানুষকে তিনি মুক্তির কোন সঠিক রাস্তাই দেখাতে পারেননি ক্ষমতার মসনদে বসে। এমনকি কথিত আছে তিনি এই অবস্থা আঁচ করতে পেরে এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ‘আমার ডানেও চোর, বামেও চোর, সামনেও চোর এবং পেছনেও চোর’।

ভাবতে অবাক লাগে ইতিহাসের এই অমর পুরুষ যার ডাকে লক্ষ জনতা মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং দেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠাও করেছিল সেই নেতাই কেমন করে সেদিন এমন দিকশূন্য হয়ে গিয়েছিলেন! তাঁর কাছে দেশ ও জাতির যে চাওয়া-পাওয়া ছিল তা তিনি দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’ এই উক্তিটির ব্যবহারিক ব্যাখ্যা ছিল সেদিনের সেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তাই তো সেদিন ছড়াকার আবু সালেহ উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা/ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা!/ যার পিছনে জানটা দিলাম যার পিছনে রক্ত/ সেই রক্তের বদল দেখ বাঁচাই কেমন শক্ত!/ ….বাঁচতে চেয়ে খুন হয়েছি বুলেট শুধুই খেলাম/ উঠতে এবং বসতে ঠুকি দাদার পায়ে সেলাম!/ ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা/ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার আজব স্বাধীনতা!’

সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্রকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দেশের সকল অরাজক পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্যেই সেদিন অনিবার্যভাবে প্রয়োজন ছিল একজন বিকল্প নেতার, প্রয়োজন ছিল একটি বিকল্প রাজনৈতিক দলের। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট পরবর্তী প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের অনিবার্য বাস্তবতায় সেদিন দেশ ও জাতির হাল ধরেছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সিপাহসালার মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান । তাঁরই উদ্যোগে এবং তাঁরই নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ যা পরবর্তীতে সংক্ষেপে ‘বিএনপি’ নামে বহুল পরিচিতি অর্জন করতে সক্ষম হয়। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে অন্যতম ছিল ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’, ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ এবং ‘সর্ব শক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’।

তিনি ৭২ এর সংবিধান সংশোধন করে সংবিধানের শুরুতেই সংযোজন করেছিলেন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’।

এ ছাড়া ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দের বিপরীতে তিনি সংযোজন করেছিলেন ‘সর্ব শক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’।

অনেকের ধারণা সে সময় তিনি সংবিধানে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ শব্দটিও যোগ করতে চেয়েছিলেন, তবে বিশেষ কোন কারণে তা সংযোজন করেননি। তিনি ‘বিএনপি’ নামক দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বটে কিন্তু তাঁর দলে জনবল এসেছিল মূলতঃ আওয়ামীলীগ, জাসদ, মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য বামপন্থী দল থেকে। তাই তাঁর একক চিন্তা চেতনায় তখন আর তেমন কিছুই করার ছিল না। পরবর্তীতে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন থেকে ‘ইসলামী ভাবধারা’ কিছুটা কমে গিয়েছিল এবং অদ্যাবধি বিএনপির সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই সে চিন্তা চেতনাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন না বলেই মনে হয়। যে কারণে কেবল মাত্র নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ‘ইসলামী’ কোন আচার-আচরণ বিএনপির মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। জাতীয় নির্বাচনে তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান হচ্ছে- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ/ ধানের শীষে বিসমিল্লাহ’।

আমাদের দেশের সরল মনের ধর্মপ্রাণ মানুষ এরকম চটকদার স্লোগানের রহস্য উদ্ধার করতে না পারারই কথা। তাই তারা নির্বাচনের সময় আল্লাহর নাম নিয়েই ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে সীল মেরে থাকেন। উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে দেশ ও জাতির কল্যাণ তথা দেশের উন্নয়ন। তাই বিএনপি মানুক বা নাই মানুক তাদের রাজনৈতিক দর্শনে ইসলামের ছোঁয়া রয়েছে সেটা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। প্রকৃত অর্থে বর্তমানে বিএনপির জনপ্রিয়তার মূল চাবিকাঠিই হচ্ছে ‘ইসলাম’।

এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামী সংগঠন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে এখনও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি সামগ্রিকভাবে ইসলামী আদর্শকে লালন করেও। অথচ বাম-ডানের সংমিশ্রনে গঠিত একটি মধ্যমপন্থী দল বিএনপি জনগণের আস্থা ও ভালবাসার কারখানায় পরিণত হতে পেরেছে ‘ইসলাম’ এর সামান্য একটু ছোঁয়াতেই।

জামায়াতের রাজনৈতিক দর্শন

দল হিসেবে বিএনপির চেয়ে অনেক পুরনো এবং একটি মৌলিক আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হলেও জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বিএনপির সহযোগী দল হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। বলার অপেক্ষা রাখে না ইসলামী চিন্তা চেতনা ভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী হলো সবচেয়ে সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী। মাওলানা মওদুদী (রহ.) প্রতিষ্ঠিত এ দলটি মূলত অবিভক্ত ভারতে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে দেশ ভাগের সাথে সাথে দলটিও ভাগ হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নামে এ দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে দলটি। প্রথম থেকে অবশ্য দলটির নাম ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’, বা ‘জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান’ এর অনুরূপ ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী সম্প্রতি দলীয় নামে সংশোধনী এনেছে তারা। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে রয়েছেন বেশ কিছু প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ ইসলামী ব্যক্তিত্ব যাদের মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী দেশের আইন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো তথা একটি আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা । অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে এ দলের মৌলিক পার্থক্য হলো দলটির অভ্যন্তরে তেমন কোন কোন্দল লক্ষ্য করা যায় না। দলীয় শীর্ষ পদ থেকে অধ্যাপক গোলাম আযমের অবসর গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক রীতি নীতি পালনের এক অনন্য নজির স্থাপন করতে পেরেছে দলটি। জামায়াতের রয়েছে সুশৃঙ্খল ছাত্র ফ্রন্ট ‘ইসলামী ছাত্রশিবির’ যাকে তাদের সাংগঠনিক পরিভাষায় ‘একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি দলটি মহিলা শাখা ও ‘ছাত্রী ফ্রন্ট’ গঠনের মাধ্যমে নারীদের মধ্যেও তৈরি করতে পেরেছে একটি অন্যরকম ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তা ধারা। জামায়াতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো সাধারণত এ দলের কোন নেতা বা কর্মীকে দলত্যাগ করে অন্য দলে যেতে দেখা যায় না। দলীয় পদ-পদবী বা দায়িত্ব বন্টনের বেলায় ইসলামী রীতি নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং ব্যক্তির পদের প্রতি লোভহীনতাকে তার যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি বলে গণ্য করা হয়। এ দলে যেমন রয়েছেন মাদ্রাসা শিক্ষিত আলেম ওলামা তেমনি কলেজ বিশ্ববিদ্যায় পড়ুয়া উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের অবস্থানও দলটিতে ব্যাপক। দলীয় কর্মীদের ক্যাডার (স্তর) ভিত্তিক প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা হয় বিধায় দলটির সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান বেশ মজবুত। জামায়াতে ইসলামীর এত এত গুণাবলী থাকা সত্তেও তাদের অসুবিধা হচ্ছে, ১৯৭১ সালে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান করেছিল। ‘পাকিস্তানী সৈনিকদের গণহত্যা ও নারী ধর্ষণে সহযোগীর ভূমিকা’ পালনের অভিযোগে দলটি অভিযুক্ত এবং দলীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সম্প্রতি মৃত্যুদন্ডের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। কোন কোন মহল দলটির সাথে জঙ্গিবাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও অভিযোগ করে থাকেন।

বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য মূলত রাজনৈতিক

আমাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য প্রসঙ্গে। বিএনপি এবং জামায়াতের রাজনৈতিক দর্শন বা দলীয় আদর্শ পর্যালোচনায় এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। আদর্শিকভাবে জামায়াত একটি ইসলামী দল হলেও বিএনপি সম্পূর্ণরূপে এর ব্যতিক্রম। বিএনপি একটি মধ্যমপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল যাদের মূল উদ্দেশ্য রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করা। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থা কোন্ মতাদর্শের ভিত্তিতে চলবে এ জাতীয় কোন দিক নির্দেশনা দলটিতে নেই। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্যই হচ্ছে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা। আদর্শিকভাবে বিএনপি জামায়াতের বিরোধী নয় এ অর্থে। কারণ বিএনপি দলগতভাবে ইসলাম বিরোধী নয় এবং তারা নিজেদেরকে ‘ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী’ বলে দাবি করে। অর্থাৎ বিএনপির আদর্শ ইসলাম না হলেও ইসলামী ভাবধারাকে তারা অপছন্দও করে না। আর এ কারণেই বিএনপির সাথে জামায়াতের রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছে যার মূল ভিত্তি হচ্ছে আদর্শিক। কারণ আদর্শগতভাবে দ্বন্দ্ব থাকলে রাজনৈতিক বা নির্বাচনী মোর্চা এত সহজে গড়ে উঠতো না। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসনে জয় লাভ করলে তাদেরকে নিঃশর্ত সমর্থন জানায় জামায়াতে ইসলামী। কারণ সরকার গঠনের জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল ১৫১টি আসন আর জামায়াত উক্ত নির্বাচনে ১৮টি আসনে জয়লাভ করেছিল। উল্লেখ্য যে উক্ত নির্বাচনটি ছিল স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বাংলাদেশে এ ধরনের সরকার ছিল এটাই প্রথম। নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি, আওয়ামীলীগ ৮৮টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি এবং জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসন লাভ করেছিল। অন্যান্য দলের মধ্যে বাকশাল ও সিপিবি ৫টি করে এবং গণতন্ত্রী পাটি, ওয়ার্কাস পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, এনডিপি, জাসদ (সিরাজ) ও ন্যাপ (মোজাফফর) ১টি করে আসন লাভ করে। সঙ্গত কারণেই সরকার গঠনের জন্য বিএনপিকে আওয়ামীলীগ, জাপা অথবা জামায়াতের সাথে কোয়ালিশন করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে নি:শর্ত সমর্থন জানিয়ে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সাথে একটি রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আদর্শিকভাবে পুরোপুরি মিল না থাকায় জামায়াত সে সময় সরকারের অংশীদারিত্ব গ্রহণ করেনি। ফলে দলটি সংসদে ও রাজপথে অন্যতম বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। পরবর্তীতে বিএনপি সরকার কর্তৃক জামায়াতের আমির প্রফেসর গোলাম আযমকে গ্রেফতারসহ রাজনৈতিক দমন পীড়নের ফলে দল দুটোর মধ্যে ব্যাপক দূরত্ব তৈরি হয়। এক পর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে আওয়ামীলীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর একযোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন আ’লীগ, জাপা ও জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা। শুরু হয় সহিংস আন্দোলন। যে বিএনপিকে নি:শর্ত সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী সেই বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে টেনে হিঁচড়ে নামানোর জন্য আ’লীগ ও জাপার সাথে সমান তালে আন্দোলন চালিয়ে যায় তারা। রাজনৈতিক শত্রু-মিত্র নিয়ে তেমন একটা ভাবনা ছিল না তখন তাদের মনে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল নির্দলীয় সরকারের অধীনে ৯১ সালে ১৮টি আসন যখন পেয়েছে তখন ৯৬ সালে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিলে ১৫১টি আসন পাওয়া তাদের জন্য খুবই সহজ। আর তাই তো পরবর্তীতে ৯৬ সালের ১২ই জুনের নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে মাত্র ৩টি আসনে বিজয়ী হয় জামায়াতে ইসলামী। পক্ষান্তরে সর্বদলীয় আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত দল বিএনপি উক্ত নির্বাচনে ১১৬টি আসনে জয়লাভ করে সংসদে সর্ববৃহৎ বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। আওয়ামীলীগ উক্ত নির্বাচনে ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে জাতীয় পার্টি ও জাসদ (রব)- কে নিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ গঠন করে। জামায়াতে ইসলামী বুঝতে পারে তাদের রাজনৈতিক চালে কত বড় ভুল হয়েছিল। এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের একটি বড় অংশ বরাবরই আওয়ামী বিরোধী এবং তাদের ভোট বিএনপি ও জামায়াতের জন্যই বরাদ্ধ থাকে। কিন্তু আওয়ামীলীগের সাথে যৌথভাবে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে ভোটাররা ভাল চোখে দেখেনি। তারা তাই ব্যালটের মাধ্যমে জামায়াতকে প্রত্যাখ্যান করেছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা থাকলে ৯৬ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ এর বিজয়ী হওয়া প্রায় অসম্ভবই ছিল!

পরবর্তীতে সময়ের স্রোতধারায় বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য পুন:স্থাপিত হয় এবং চারদলীয় জোট গঠন করা হয়। নামে চারদলীয় জোট হলেও মূলত: এ জোটকে বিএনপি-জামায়াত জোট বলে চিহ্নিত করা হয়। নির্বাচনেও জামায়াত তাদের নিজস্ব প্রতীকে এবং অন্য দুটি দল জাতীয় পার্টি (নাফি) ও ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপির প্রতীক নিয়ে অংশ গ্রহণ করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে জোট গঠনের ফলে বিএনপি এককভাবে ১৯৩টি জামায়াত ১৭টি, চারদলীয় জোটভূক্ত জাপা (নাফি) ৪টি এবং ইসলামী ঐক্যজোট ২টি আসন লাভ করে। ফলে সংসদে চারদলীয় জোটের মোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২১৬টি যা দুই তৃতীয়াংশের অধিক। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রীসভায় জামায়াতে ইসলামীর ২ জনকে মন্ত্রীত্ব দিয়ে সরকারে অংশীদার করা হয়। তবে অপর দুটি দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে কাউকে মন্ত্রীত্ব দেওয়া হয়নি। ১৯৯১ সালে যে জামায়াতে ইসলামী আদর্শিক কারণে সরকারে অংশ নেওয়া থেকে বিরত ছিল মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে তাদের চিন্তা চেতনায় কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য মন্ত্রীত্ব নেওয়ার ফলে দলের কট্টরপন্থী সমর্থকদের বিরূপ সমালোচনায় পড়ে দলটি।

বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারাগারে। বলা যায় ফাঁসির দড়ি এখন তাদের জন্য প্রস্তুত প্রায়। এরকম অবস্থায় বিএনপির সাথে জামায়াতের রাজনৈতিক ঐক্য আরো সুদৃঢ় হতে দেখা যায়। আল্লামা সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে জামায়াতের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বিএনপির অনেক সমর্থকও প্রাণ হারান। শুধু তাই নয় জামায়াতের ডাকা দুই দিনের হরতালের সাথে আরো একদিনের হরতাল যোগ করে সে সময় বিএনপি নিজেদেরকে জামায়াতের সমর্থক হিসেবে আবারো জানান দেয়। অত:পর ১৮ দলের ব্যানারে সরকার বিরোধী আন্দোলন অদ্যাবধি চলছেই।

সুতরাং একথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বিএনপি ও জামায়াত ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করলে আওয়ামীলীগের পক্ষে বিজয়ী হওয়া কঠিন। আর বিএনপি ও জামায়াত পৃথক পৃথকভাবে নির্বাচন করলে আওয়ামীলীগের বিজয় প্রায় সুনিশ্চিত। এমতাবস্থায় বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চাইলে জামায়াতের সাথে ঐক্য করতেই হবে। অন্যদিকে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় দেখতে না চাইলে জামায়াতে ইসলামীরও বিএনপির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া আপাতত আর কোন রাজনৈতিক পথ উন্মুক্ত নেই।

লেখক: সম্পাদক-সোনার সিলেট ডটকম ও প্রধান নির্বাহী-হামহাম ড্রিংকিং ওয়াটার।

বিষয়: বিবিধ

১৩৫৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File