ঈদের আগের দিন আমার জেল গেটে গ্রেফতার হওয়া

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ আবু তাহের ১৭ জুলাই, ২০১৫, ১২:১০:২১ দুপুর

২০১৩ সাল। যদি আগামীকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর হয় তাহলে ঠিক আজকের এই দিনে আমি জেল গেট থেকে রিএরেস্ট হই।

আমি যেই ওয়ার্ডে ছিলাম সেই ওয়ার্ডে সকাল বেলা জেলখানার একজন কয়েদী এসে বললেন- ভাই আপনার তো সকল কাগজ পত্র ওকে, আপনি আজ সকালেই বের হতে পারবেন। কিন্তু বিষয়টা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, কারন গত রাত পর্যন্ত আমি জানি যে হাইকোর্ট থেকে আমার জামিনের কাগজ-পত্র আসেনি এরপরও কৌতুহল বশত জেল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলাম। তারা বললেন যে সত্যিই আমার জামিনের সকল কাগজ এসেছে। আমাকে বের হওয়ার জন্য দ্রুত প্রস্তুতি নিতেও বললেন। আমি ওয়ার্ডে গিয়ে ব্যাগ গোছালাম। সকলের সাথে সাক্ষাত করারও সময় সুযোগ হলো না। দ্রুত জেল গেটে আসলাম। তাদের অফিসে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকতে হলো। ইতোমেধ্যে আমার বড় ভাই সহ জামায়াত-শিবিরের অনেক ভাই জেলগেটে এসে আমার বের হওয়ার অপেক্ষা করছেন। এ্রই মধ্যে একজন কয়েদী এসে আমাকে জানালেন যে, ভাই জেল গেটের বাহিরে তো অনেক পুলিশ আর একটা পুলিশের গাড়িও দেখা যাচ্ছে। আমার আর বুঝতে বাকি থাকলো না যে কি ঘটতে যাচ্ছে। এর মধ্যে গেটের বাহিরে অবস্থানরত আমাদের ভাইদেরকে সরে যেতে বলা হলো। আমি ভিতরেই অপেক্ষা করছিলাম। কয়েকজন বিডিআর এসে বললেন আপাতত বের না হওয়ার জন্য তাই বের হতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু জেল পুলিশ এসে বললেন এভাবে অপেক্ষা করে লাভ হবে না, আপনি যতক্ষন বের হবেন না তারা ততক্ষণ এখনেই অপেক্ষা করবে। শেষে জেলার আমাকে ডাকলেন। শান্তনা দিলেন এই বলে যে, আমাদের করার কিছুই ছিলো না। আপনার বের হওয়ার বিষয়টা আমাদেরকে জানাতেই হলো কারন প্রশাসন আগেই এটা বলে রেখেছিল যে আপনি বের হওয়ার সময়ে যেন আমরা তাদেরকে জানাই, এটা আমাদের দায়িত্ব! আপনি যান হয়তো তারা থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে আপনাকে ছেড়ে দিবে।

কি আর করার। যখন দেখলাম করার আর কিছুই নেই তখন জেল থেকে বের হলাম আর জেলের কয়েদীরা অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।

গেটেই পুলিশ অপেক্ষা করছিল। আমি বের হওয়ার সাথে সাথে তারা আমার সাথে হাটছিল আর নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা করছিল। শেষে অফিসার গোছের সিভিল পোশাকের পুলিশটি আমাকে তাদের গাড়িতে উঠতে বললেন। আমাদের ভাইয়েরা অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সদর থানায় পৌঁছে গেলাম। আমাকে নিয়ে ওসির কাছে হাজির করালো। ওসি আমাকে দেখে কেন জানি হাসছিলেন। এর আগে তার সাথে আমার কখনো দেখা কথা হয়নি। তিনি হেসে হেসে বললেন যে, আপনাকে আরও কয়েকটা দিন জেলে থাকতে হবে। বললাম, আমার নামে তো কোন মামলা নাই। তিনি বললেন, একটা মামলা দেওয়া হবে। আমি বললাম জেলায় যত মামলা ছিল সবগুলোতেই তো আমাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তিনি বললেন, না আরও একটা মামলা আছে। কলীগঞ্জ থেকে অনেক আগেই মামলা নিয়ে তারা রওয়ানা হয়ে গেছে। তারা আসলেই আপনাকে কোর্টে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো, আপনার যেন কষ্ট না হয় সেই ব্যবস্থাই করা হবে। অবস্থাটা এমন যে, মামলা নিয়ে যেন আমার সাথে তার চুক্তি হচ্ছে!

কিছুক্ষনের মধ্যেই মামলা সমেত তারা আমাকে নিয়ে কোর্টে পৌঁছে গেল। কোর্টের পুলিশরা আগে থেকেই আমাকে চিনতো। তারা আমাকে দেখে খুশি হতে পারলো না। কেউ কেউ তো সরকারের উপর অনেক রাগও হলেন। তারা আমার সাথে অনেক উত্তম আচরণ করলেন। তাদের আচরণে আমি এটা ভুলেই গেলাম যে তারা আমাকে গ্রেফতার করেছে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। তারা দ্রুত কোর্টের কাজ শেষ করে আমাকে জেলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি যখন জেল গেটে পৌঁছলাম তখনও ইফতারের সময় হয়নি, যদিও তখন লকাপ হয়ে গেছে।

আমাকে আমদানীতেই থাকতে দওেয়া হলো। অনেক আপত্তির পরেও আমদানীর মেট আমাকে তাঁর বেডটা ছেড়ে দিলেন। অনেকেই এসে খোজ-খবর নিয়ে গেলেন…। তাদের আচরনে আমি যারপর নাই খুশি হয়েছিলাম। অন্তর থেকে তাদের জন্য দোয়া এসেছিল।

রাতে যখন শুতে গেলাম তখন শুধু মনে হলো আমার মায়ের কথা, যিনি সহ্য করতে পারবেন না বলে একদিনের জন্য আমাকে জেলে দেখতে আসেন নি। অনেক আশা নিয়ে ছিলেন দীর্ঘদিন পরে হলেও তাঁর ছেলেকে তিনি দেখতে পারবেন। কিন্তু না তা আর হলো না। তাঁর চোখের পানি না শুকিয়ে বরং আরও বেশি করে ঝড়তে লাগলো। আগামীকাল ঈদ। নিশ্চিতভাবেই ঈদের খুশি আমার মাকে স্পর্শ করতে পারবে না। বরং দুঃখটাকেই আরও বাড়িয়ে দিবে।

বিয়ের মাত্র ষোল দিনের মাথায় আমি গ্রেফতার হই। নববধুর সাথে আমার প্রথম ঈদটাও করা হবে না! এভাবে কত ভাই কত বোন যে হৃদয়ে পাথর চাপা দিয়ে দিন যাপন করছেন তার কয়টির হিসাবই বা আমাদের কাছে আছে। যেই ভাইয়েরা জেলখানায় আছে তাদের পরিবারে অন্ততঃ এতটুকু শান্তনা আছে যে, তাদের সন্তান একদিন না একদিন তাদের কাছে ফিরে আসবে, কিন্তু যাদের সন্তানকে তথাকথিত ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে তাদের পরিবার তো কখনই আর কোন ঈদে তাদেরকে কাছে পাবেন না। তাঁদের বেদনা যে কত গভীর সেটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বুঝবে বলে মনে হয় না।

শেষে আল্লাহর কাছে শুধু এই দোয়াই করি, তিনি যেন সবাইকে দুনিয়া ও আখিরাতে এসবের উত্তম প্রতিদান প্রদান করেন।

বিষয়: বিবিধ

১২১৭ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

330381
১৭ জুলাই ২০১৫ বিকাল ০৫:৫২
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো । চিবির ধরা সওয়াব আছে
২২ জুলাই ২০১৫ রাত ০৯:৫৯
273414
মোঃ আবু তাহের লিখেছেন : হ
330386
১৭ জুলাই ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:০৯
মোঃআয়নাল হক লিখেছেন : আপনার কথা গুলো পড়ে মনে বড় কষ্ট লাহলো
২২ জুলাই ২০১৫ রাত ০৯:৫৯
273415
মোঃ আবু তাহের লিখেছেন : দোয়া করবেন ভাই।
330402
১৭ জুলাই ২০১৫ রাত ০৮:২০
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : কত ভাই কে এভাবে কষ্ট পেতে হচ্ছে এই জালিম সরকার এর জন্য।
২২ জুলাই ২০১৫ রাত ১০:০০
273416
মোঃ আবু তাহের লিখেছেন : তার হিসাব কয়জনই বা রাখে!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File