ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদ আব্দুল মালেক-১
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ আবু তাহের ১০ আগস্ট, ২০১৪, ০৫:৫৮:৪৪ বিকাল
ভূমিকা
ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে বাংলাদেশে যে কয়েকজন ণজন্মা পুরুষ ছিলেন শহীদ আব্দুল মালেক তাঁদের মধ্যে অন্যতম। একজন তুখোর মেধাবী ছাত্র হয়েও যিনি লোকচুর অন্তরালেই থাকতে পছন্দ করতেন। আব্দুল মালেকের প্রত্যেকটি কাজই ছিল দ্বীনের উদ্দেশ্যে। জানার আগ্রহ ছিল তাঁর অনেক বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আব্দুল মালেক খুব কম সময়ের মধ্যেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। তাঁর সকল কাজের মধ্যমনি ছিল কিভাবে ইসলামী শিক্ষাকে এদেশে বাস্তবায়ন করা যায়। ইসলামী শিার কথা বলতে গিয়ে নিজের জীবনকে একেবারে তুচ্ছ মনে করে শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করেন শহীদ আব্দুল মালেক।
ছাত্র হিসেবে আব্দুল মালেক
১৯৪৭ সালে জনগ্রহণকারী শহীদ আব্দুল মালেক বগুড়ার অদূরবর্তী থানা ধুনটের খোকসাবাড়ীতে মৌলভী মুন্সি মোহাম্মদ আলী ও মা ছাবিরুন নেছার ৫ জন ছেলের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। একাডেমিক জীবনের হাতেখড়ি থেকে শুরু করে সর্ব্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ পর্যন্ত তিনি মেধার স্বার রেখে গেছেন। খোকসাবাড়ী প্রাইমারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে তিনি স্কলারশিপ লাভ করে ভর্তি হন গোসাইবাড়ী হাইস্কুলে। সেখানেও তিনি অষ্টম শ্রেণীতে স্কলারশিপ লাভ করেন। জ্ঞানের তীব্র আকাক্সা নিয়ে এবার তিনি নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন বগুড়া জেলা স্কুলে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আব্দুল মালেক শিক শিার্থীর ভালোবাসা অর্জন করতে সমর্থ হন। সময় গড়িয়ে এবার এলো এসএসসি পরীা। দেখা গেলো এবারও তিনি তাঁর মেধার স্বার রেখেছেন। এসএসসি পরীায় তিনি রাজশাহী বোর্ডে মেধা তালিকায় একাদশ স্থান অর্জন করেছেন।
তারপর শুরু হলো উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পথ চলা। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেন রাজশাহী কলেজে। আব্দুল মালেক এবার আরও ভালো রেজাল্ট করতে সমর্থ হলেন। এইচএসসি পরীক্ষায় এবার তিনি মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। উচ্চ শিক্ষার সুতীব্র আকাক্সা নিয়ে এবার তিনি প্রাণ রসায়নে ভর্তি হলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেও তিনি প্রথম স্থান অধিকার করতে থাকেন। শাহাদাত বরণকালে তিনি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
কর্মী হিসেবে আব্দুল মালেক
আব্দুল মালেক একজন নীরব কর্মী ছিলেন। অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী হয়েও তিনি কখনো গর্ব করে বেড়াতেন না। তিনি শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করেই সামনের দিকে এগুতে চাইতেন। আর তাইতো তিনি নবম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় তাঁর পিতার নিকট লিখলেন- “বাড়ির কথা ভাবি না, আমার শুধু এক উদ্দেশ্য খোদা যেন আমার উদ্দেশ্য সফল করেন। কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি এবং কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি দোয়া করবেন খোদা যেন সহায় হন। আমি ধন সম্পদ কিছুই চাই না শুধু যেন প্রকৃত মানুষরূপে জগতের বুকে বেঁচে থাকতে পারি।”
আব্দুল মালেক ছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য কর্মী। যখন তিনি ঢাকা শহর শাখার অফিস সম্পাদক তখন অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সেই অফিসের চেহারা পাল্টে দিলেন। আব্দুল মালেকের দায়িত্বশীল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেছেন- “আব্দুল মালেকের সহযোগিতায় ঢাকা শহর শাখার পর পর তিনজন সভাপতি যত সহজে বিরাট দায়িত্ব পালন করেছেন তেমন আরামে ও সহজে গুরুদায়িত্ব পালনের সুযোগ কোনদিন কেউ পেয়েছে বলে আমার জানা নাই।”
শহীদ আব্দুল মালেক একদম সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তাঁর একটা মাত্র জামা ছিল। সারাদিন কাজ শেষে রাতে রুমে এসে সেটা ধুয়ে শুকাতে দিতেন আর তা পরের দিন পড়ে আবার দ্বীনের কাজে বেড়িয়ে যেতেন।
ইসলামী আন্দোলনের একজন উদীয়মান কর্মী হিসেবে তাঁর মন ছিল মানবতার দরদে ভরপুর। দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের অবস্থা জানাও ছিল তাঁর অন্যতম কর্মসূচি। বর্তমান আমীরে জামায়াত বলেছেন- ‘‘ঈদুল আজহা উপলক্ষ কর্মীরা বাড়িতে যাচ্ছে। রাতের ট্রেনে আব্দুল মালেক বাড়ি যাবেন শুনেছি। দু’একদিনের মধ্যে দেখা হয়নি। সময় মতো স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম। আব্দুল মালেককে খুঁজে পেতে বেশ সময় লেগেছে। কারণ তিনি মধ্যম শ্রেণীতে উঠেননি। আমাকে দেখে তিনি বেশ অপ্রস্তুত হলেন। আমার স্টেশনে যাওয়া তাঁর কাছে কেমন যেন লেগেছে। বেশ একটু জড়সড় হয়ে বলতে লাগলেন, আপনি স্টেশনে আসবেন জানলে আমি যে করেই হোক দেখা করেই আসতাম। অবশ্য একবার খোঁজ করেছি আপনাকে পাইনি। আমি কথাগুলোর দিকে কান না দিয়ে কামরাটার দিকে ভালো করে দেখছিলাম। তিল ধরনের জায়গা নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে সারারাত। আমি চেষ্টা করলাম ইন্টারে জায়গা করে দেয়ার। টিকিটের ঝামেলাও চুকিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু রাজি করানো সম্ভব হলো না। আব্দুল মালেক অকপটে বলেই ফেললেন, এই লোকগুলোর সাথে আলাপ করলে আমার ভালো লাগবে। তখনো বুঝতে পারিনি কত মর্যাদাবান ব্যক্তির কাছে এই কথাগুলো শুনছি।’’
দায়িত্বানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল শহীদ আব্দুল মালেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক। এব্যাপারে মাওলানা নিজামী বলেন- ‘‘সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে একদিন ঢাকায় প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেল। আগামসি লেনস্থ সংঘের পূর্ব পাক দফতর থেকে বেরোবার উপায় ছিল না আমাদের। বস্তির লোকেরা বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতন কলভবন, হোসেনী দালান ও সিটি ল’ কলেজে আশ্রয় নিয়েছে। আমি কোনোমতে ফজলুল হক হলে গেলাম। তিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে আমরা কি করতে পারি সে সম্পর্কে পরামর্শ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে কথা উঠার আগেই আব্দুল মালেকের মুখে খবর পেলাম ঢাকা শহর অফিসে পানি উঠেছে। বৃষ্টি একটু থেমে যেতেই তিনি অফিসে গিয়ে সব দেখে এসেছেন। অধিক পানি ওঠায় কাগজপত্রাদি সামান্য তিগ্রস্ত হয়েছে। আব্দুল মালেক ওগুলো সব ঠিকঠাক করে এসেছেন। তাঁর দায়িত্ব সচেতনতার এ চাুষ প্রমাণটুকু আমার পে কোনোদিনই ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তারপর কর্মী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে একদিন নিউমার্কেট ও আরেক দিন জিন্নাহ এভিনিউয়ে রোড কালেকশন করা হলো। অল্প সময়ে কর্মীদেরকে জমায়েত করে এত বড় কাজ আঞ্জাম দেয়ার মতো আর কোন কর্মীই ছিল না। আমারতো কাজ ছিল শুধু কাগজের টুকরায় কিছু নোট লিখে অথবা আধঘণ্টা পনের মিনিটের আলাপে মোটামুটি কিছূ বুঝিয়ে দেয়া। আব্দুল মালেকের সুদ পরিচালনায় সংগৃহিত অর্থের নিখুত হিসাব পেলাম। সিকি, আধুলি, পাই পয়সা থেকে নিয়ে কত টাকার নোট কতটি, তার হিসেবের ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছিলেন। এরপর তিন দিন তিন রাত একটানা পরিশ্রম করে আব্দুল মালেক অল্প সংখ্যক কর্মী নিয়ে চাল বন্টনের কাজ সমাধান করে ফেললেন। সেদিন আব্দুল মালেককে স্বচে অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখেছি। আর মুরুব্বি সেজে পরামর্শ দিয়েছে কাজটা আর একটু সহজে কিভাবে করা যায়। এই ভাগ্যবান ব্যক্তির পরিশ্রমকে লাঘব করার জন্য সেদিন তার সাথে মিলে নিজ হাতে কিছু করতে পারলে আজ মনকে কিছু শান্ত্বনা দিতে পারতাম।’’
বিষয়: বিবিধ
১০৪৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন