প্রয়োজন সমন্বিত সামাজিক আন্দোলন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ গালিব মেহেদী খান ১৯ জানুয়ারি, ২০১৩, ১১:২৩:০৬ সকাল
যখন একজন রিপোর্টার দেশে ধর্ষণ নামক সন্ত্রাসটির রিপোর্ট করতে গিয়ে প্রথমেই উল্লেখ করেন এটা কোন সরকারের আমলে ঘটেছে। তখন ঐ রিপোর্টেই এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডটি বিস্তারের পিছনে একটি অন্যতম প্রধান কারণ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। আর সেটি হল এই অপকর্মটিকে একটি রাজনৈতিক রঙ দেয়া। বিষয়টি যেন এমন যে অন্য কোন সরকার হলে সমাজে এই অপকর্মটি ঘটত না। অথচ তুলনামূলক বিচারে দেখা যায় আমাদের সমাজে ক্রমশ এই সমস্যাটি বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে পাড়ার বখাটে পর্যন্ত জড়িয়ে পরছে এই হিংস্র কর্মকাণ্ডে। এরা ঠাণ্ডা মাথায়, পরিকল্পিতভাবে ঘটাচ্ছে একের পর এক ঘটনা। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই হিংস্রতার ভাইরাসটি ছড়িয়ে পরেছে। যার বলি হচ্ছে অপেক্ষাকৃত শান্ত, দুর্বল এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কন্যা ও শিশুরা।
প্রতিটি ঘটনা ঘটার পেছনে থাকে কিছু কার্যকারণ। হঠাৎ করে এই ঘৃণ্য অপরাধটি কেন মহামারি আকার ধারণ করল? কি সে কারণ? আমরা যদি তা খুঁজে বের করার চেষ্টা না করি তাহলে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ারও কোন উপায় বের করতে পারব না।
সমাজবদ্ধ থেকেও আজ আমরা প্রত্যেকেই নিজস্ব জগতে বাস করি, যেখানে অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই। ভুলে গেছি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। সামাজিক দায়বদ্ধতা বলতে যা বোঝায় তা এড়িয়ে চলি সচেতনভাবে। সমাজে বেড়ে ওঠা প্রতিটি শিশু-কিশোরের প্রতি যত্নবান হওয়া সকলের দায়িত্ব অথচ আমরা তা এড়িয়ে চলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এই অবহেলা এক সময় আমাদেরই করে তোলে বিপদাপন্ন। অথচ একটু সচেতনতা একটু দায়িত্ব পালন একদিকে যেমন নিশ্চিত করতে পারত একটি অনাগত ভবিষ্যৎ অন্যদিকে আমাদেরও দিতে পারত নির্ভরতা।
প্রযুক্তি নির্ভর আজকের যুগে যেখানে শিশু-কিশোরদের দিকে লক্ষ রাখা, তাদের সঠিক নির্দেশনা প্রদান বেশি জরুরী; সেখানে দিন দিন আমরা আলগা করে দিচ্ছি পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের গ্রন্থি। একটি কিশোর চাইলেই হাতের কাছে পাচ্ছে-
স্মার্ট ফোনের নামে পর্নগ্রাফির সহজলভ্যতা।
ইন্টারনেটে ১০ টাকায় ১০ মেগাবাইট ডাউনলোডের সুবিধা।
সাইবার ক্যাফের নির্জনতায় পর্নগ্রাফির মধ্যে ডুবে থাকার অবারিত সুযোগ।
ভালবাসা নামক এক অদ্ভুত ফ্যাসিনেসন তাকে বুদ করে রাখছে। বিনোদন বলতে তো এক নাটক আর সিনেমাই সম্বল। ইদানীং সে নাটক-সিনেমা, এমনকি বিজ্ঞাপনেও ভালবাসা বোঝাতে আবার জৈবিক আবেদনকেই উপজীব্য হিসেবে তুলে ধরছি। যেন, মানুষের জীবনে জৈবিক চাহিদা পূরণ ব্যতিরেকে আর কোন লক্ষই নেই। এর সাথে যোগ হয়েছে ব্যস্ততার অজুহাতে সন্তানের খোঁজ না রাখা। আর সর্বোপরি বিচার হীনতার সংস্কৃতি। যা এই অপরাধীদের করে তুলেছে আরও নির্ভার, অপ্রতিরোধ্য।
আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে মেয়েদের বেলায় কলঙ্ক বলে একটা কথা থেকেই যায়। যা মূলত তাকে দমিয়ে রাখতে এবং ছেলেদের অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যার ফলে শ্লীলতাহানী থেকে শুরু করে ধর্ষণ পর্যন্ত চেপে যাওয়ার একটা সর্বনাশা মানসিকতা চোখে পড়ে সর্বত্র। এখানে আমাদের সমাজব্যবস্থার একটা বৈপরীত্য লক্ষণীয়। যেখানে অন্যায়কারীকে সমাজ আশ্রয় দিতে চায় আর যার উপর অন্যায় করা হল তাকেই অপদস্থ করা হয়। এই যে ভ্রান্ত নীতি এটা সমাজে অপরাধের মাত্রাকেই বাড়ায়।
অনেক সময় এমনও দেখা যায় ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে দিয়ে মীমাংসার ব্যবস্থা করা হয়। এটা কি ধরনের বিচার! ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে কি করে হয়? এ যেন শয়তানের গলায় মাল্যদান! এর পরে আবার আছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। আমাদের দেশে তো রাজনৈতিক দলগুলোর আবার অঙ্গ সংগঠনের অভাব নেই। ভবঘুরে আর ভিক্ষুক ছাড়া সব শ্রেণীরই আছে দলীয় ব্যানার। রাজনৈতিক দলগুলো এদের ব্যবহার করে তাদের ক্ষমতা পোক্ত করতে। আর এরা রাজনৈতিক ব্যানারকে ব্যবহার করে সকল অনাচারের ঢাল হিসেবে। আর তাই দেখা যায় ধর্ষণের মত জঘন্য কাজটি যারা করে তারা কোন না কোন দলের ছত্রছায়ায় থেকে পিঠটি বাঁচানোর চেষ্টা করে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তাদের সে প্রচেষ্টা বেশিরভাগ সময়েই সফলও হয়। এটা তো ঠিক, কোন অন্যায় কর্মকাণ্ড ঘটাতে ক্ষমতার ছত্রছায়া লাগবেই। নির্লজ্জের মত অপরাধীদের মাথার উপর ছায়া প্রদানের সে কাজটি করে চলেছেন আমাদের স্থানিয় প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ ক্ষমতাধররা। যে কারণে দেখা যায় কখনো থানা মামলা নিচ্ছে না, কখনো স্থানীয় ভাবে আপোষ মীমাংসার নামে ভীকটিমকে অপদস্থ করা হচ্ছে আবার কখনোবা নির্যাতিতাটি ফতোয়াবাজির স্বীকার হচ্ছে। যা এই অপরাধপ্রবনতাকে ক্রমশ বাড়িয়েই তুলেছে।
এর থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রয়োজন সমন্বিত সামাজিক আন্দোলন। প্রয়োজন অপরাধীদের দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এবং গনমাধ্যমে তা প্রকাশ করা।
এ ক্ষেত্রে এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপগুলো হতে পারে অনুকরণীয়। যা এসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিল। গণমাধ্যমে প্রতিটি ধর্ষকের ছবি সহ পূর্ণ ঠিকানা প্রকাশ করা হোক এমনকি তাঁর নিকটাত্মীয়দের পরিচয়ও। যা তাঁর পরিবারটিকেই সমাজে নিগৃহীত করবে। অন্যরকম শোনালেও এটা হতে পারে একটি রক্ষাকবচ। যদি পরিবারের মধ্য থেকেই প্রতিরোধ গড়ে না ওঠে তাহলে এর প্রতিষেধকও অত সহজ নয়। এখন প্রয়োজন ধর্ষক ও তাঁর পরিবারকে সামাজিকভাবে বয়কট করা। সেইসাথে ধর্ষিতার পাশে এসে দাঁড়ানো।
ধর্ষণের বীভৎসতার নেপথ্য কারণ বলতে গিয়ে বিএসএমএমইউ’র সহযোগী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুলতানা আলগিন সিরাজগঞ্জে সংগঠিত একটি নারী নির্যাতন এবং একই সংগে সাইবার ক্রাইম প্রসঙ্গে লিখেছেন-
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘মানসিক সমস্যার কারণেই সৃজনের মতো যুবকেরা বিপথগামী হচ্ছে। অনেকেই এমন অপরাধ করেও নিজেকে ‘বীরপুরুষ’ ভাবে। অপরাধীর বন্ধুরাও অনেক ক্ষেত্রে এসব ঘটনায় উৎসাহ দেয়। বখে যাওয়া এই যুবকেরা পরবর্তীতে ধর্ষণের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না।’
ঘটছেও তাই। প্রতিটি পেশায় যেমন সাধারণ কাজের পাশাপাশি বাড়তি যোগ্যতা তাকে বিশেষায়িত কয়রে তোলে। অপরাধীদের মধ্যেও নিজেকে অন্যান্য অপরাধীদের নেতৃস্থানীয় হতে অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে নিজেকে প্রমাণের একটা ব্যাপার থাকে। যে কারণে উঠতি অপরাধীরা প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের এই উঠতি অপরাধীদের যদি শুরুতেই আইনের আওতায় আনা যেত তাহলে পরবর্তীতে তারা যেমন এই দুষ্কর্ম করার সাহস পেত না তেমনি সমাজে এদের সংখ্যাও কমে যেত।
এটা অনস্বীকার্য অপরাধ করে পাড় পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি অপরাধপ্রবনতাই বৃদ্ধি করে। যারা বলেন মেয়েদের পোশাক এর জন্য দায়ী তাদের কাছে আমার সবিনয়ে প্রশ্ন আমাদের দেশে মেয়েদের পরিধেয় পোশাকে এমন কি পরিবর্তন এসেছে যা তাদের এতটা নিরাপত্তাহীন করে তুলল? বলা হয় ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবেই ঘটছে এসব। আমি তা মেনে নিয়েই জানতে চাইব তা হরণ করল কে?
আর তাছাড়া এই ধর্ষণের মত নারকীয় সন্ত্রাসের স্বীকার যারা হচ্ছেন তারা কতটা উগ্রভাবে চলাফেরা করেন দয়া করে লক্ষ করে দেখবেন। এই কথাগুলো বলে কি এই জঘন্য অপরাধটিকেই বৈধতা দেয়া হচ্ছে না? দিল্লিতে এই ভয়াবহতার স্বীকার মেয়েটিকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সে তাঁর ছেলে বন্ধুটির সাথে কোন আপত্তিকর অবস্থায় বসেছিল কিনা। যারা এই প্রশ্ন তুলেছেন তাদের কাছে প্রশ্ন মানুষ কি তবে পশু হয়ে গেল যে আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেললো। তাছাড়া ছেলে বন্ধু না হয়ে মেয়েটার সাথে মেয়েবন্ধু থাকলে কি হত? দামিনীর সংখ্যাই বাড়ত।
ভারতে এই ঘটনাটি ঘটা অবশ্যম্ভাবী ছিল, তাই নয় কি? একদিকে মানুষ হাড়িয়ে ফেলছে স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধি অন্যদিকে রাষ্ট্র যন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তায় যখন কাশ্মীরের একটি গ্রামের সব মহিলাই ধর্ষিতা হয় সেনা বাহিনীর হাতে অথচ তাঁর কোন বিচার হয় না। যখন প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা অথচ ধর্ষককে বাঁচাতে চলে আপ্রাণ প্রচেষ্টা। ধর্ষিতা পায় না আইনের আশ্রয়। সেখানে দামিনীরা এভাবে নির্যাতিত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। সমাজ-রাষ্ট্র কেউই এর দায় এড়াতে পারে না।
যদি কেউ মনে করেন ভারতে লক্ষ জনতা দামিনীর কারণেই ফুসে উঠেছেন সেটা ভুল হবে। যদিও দামিনীকে কেন্দ্র করেই জনতার রোষানলে জ্বলছে ভারত। তবে এ ক্রোধ একদিনের নয়। প্রতিনিয়ত ঘটে চলা এই অনাচারের বিরুদ্ধে বহুদিনের ধূমায়িত ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই তা শেষ হয়ে যায় না। এরপরে শুরু হয় ধর্ষিতার বেঁচে থাকার সংগ্রাম, বিচার প্রাপ্তির সংগ্রাম, সমাজে পুনর্বাসিত হওয়ার সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামে পুরো পৃথিবীই তাঁর প্রতিপক্ষ। সেইসাথে ধর্ষকের পক্ষ থেকে অব্যাহত ভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শনের কারণে; নির্যাতিতা মেয়েটি ও তাঁর পরিবার পড়ে যায় চরম অনিশ্চয়তায় এমনকি অস্তিত্ব সংকটে। আর এই চাপ সৃষ্টিতে ধর্ষক ব্যবহার করে তাঁর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি, সামাজিক প্রতিপত্তি, প্রশাসনিক ক্ষমতাকে। এভাবে একজন ধর্ষিতার প্রতিপক্ষ হয়ে দারায় সমগ্র সমাজ এমনকি রাষ্ট্র যন্ত্রও।
• নৃশংস ঘটনার পর দুষ্কৃতকারীরা নির্যাতিতাকে রাস্তায় ফেলে যায়।
• রাস্তায় পড়ে থাকলেও প্রাথমিক অবস্থায় পুলিশ বা পথচারী কেউই সাহায্যে এগিয়ে আসেনা।
• থানা মামলা নেয় না।
• হাসপাতাল/ ক্লিনিক সহজে চিকিৎসা দিতে চায় না।
• এলাকার ক্ষমতাধররা মীমাংসার নামে ধর্ষককে বাঁচাতে চালান আপ্রাণ প্রচেষ্টা। পারলে নির্যাতিতার চরিত্র হননেও পিছপা হননা।
অর্থাৎ ধর্ষককে সহযোগিতা করে গণমাধ্যম ব্যতিরেকে রাষ্ট্র যন্ত্রের সকল শক্তি।
তবে ভারতের জন্য সুখবর দামিনীর ঘটনায় প্রতিবাদী হয়েছে ভারতবাসী। দামিনীর বন্ধুর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমাদেরও অনুরোধ, “প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছে তা যেন থেমে না যায়। সেটাই হবে মৃত তরুণীর প্রতি একমাত্র শ্রদ্ধাঞ্জলি”।
সেইসাথে সময় হয়েছে আমাদেরও আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে ওঠার। আজ ধর্ষণকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে চলেছে বাংলাদেশও। সরকারী হিসাব মতেই প্রতি বছর গড়ে ৩০০০ থেকে ৪০০০ ধর্ষণের ঘটনার রিপোর্ট হয়। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় ১০,০০০। টাঙ্গাইলে স্কুল ছাত্রী, বাগেরহাটে স্বামীকে বেঁধে গৃহবধূকে, গোবিন্দগঞ্জে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী, রাজধানীতে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা, মৌলভীবাজারের ৪র্থ শ্রেণীর এক ছাত্রী, সাভারে গণ ধর্ষণ, মিরপুরে শিশু চাঁদনী। অল্প ক’দিনের চিত্র এটি। প্রতিদিনের খবরের কাগজে এমন একাধিক ধর্ষণের খবর আমাদের বোধের দরজায় নিয়ত কড়া নাড়ছে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। আমরা কি শুনতে পাচ্ছি?
বিষয়: বিবিধ
১১১৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন