একটি ভয়াল কালো রাত ৫/৬ মে ২০১৩
লিখেছেন লিখেছেন নকীব কম্পিউটার ০৫ মে, ২০১৬, ০৩:৪০:২৫ দুপুর
আজকের এই ভয়াবহ দিনটির কথা লিখলে কষ্ট বাড়বে। তাই কোনদিন এ দিনটিকে নিয়ে লিখিনি। আমরা ৫-৬ জন বন্ধু মিলে কয়েকদিন আগেই চলে গিয়েছিলাম ঢাকা। সাভারে এক ভাইয়ের বাসায় আমরা অবস্থান নেই। ঢাকা শহরে এতগুলি মানুষ কারো বাসায় মেহমান হওয়াটা খুবই কষ্টের । এরপরেও ভাইয়ের সহৃদয় আহবানে আমরা তাঁর বাসায় অবস্থান করি। সমাবেশের আগের দিন আমরা রানা প্লাজা পরিদর্শনে যাই। ঘুরে আসার পথে স্মৃতি সৌধে কিছু সময় কাটাই। রাতে আবার ভাইয়ের বাসায় চলে আসি। রাতে শোয়ার আগেই পরামর্শ করতে থাকি কিভাবে আমরা সমাবেশে যোগ দেব। কোন যানবাহন চলতে দেওয়া হবে না। আশে পাশের কয়েকটি মাদরাসায় আমরা যোগাযোগ করলাম আগেরদিন। না তাদের কোন সাড়া পেলাম না। তারা যাবে তবে তাদের সাথে জামাত বন্দী হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই।
৫ মে ২০১৩ ফজরের পরপরই আমরা প্রস্তুত বাহির হব। ভাই আমাদের জন্য কিছু নাস্তা আনলেন। আমরা খেয়ে দেয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলাম। আশুলিয়া থেকে পুরো রাস্তা হেটে আব্দুল্লাহপুর এসে আমরা শরীক হলাম। এখানেই অবস্থান নিলাম। লাখ মুসলিমের ঢল নেমেছে ঢাকা প্রবেশের প্রতিটি রাস্তায়। দুপুর ১২ টা পর্যন্ত আমরা সেখানেই অবস্থান করলাম। সমাবেশ চলছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলি সাক্ষাতকার নিচ্ছে, লাইভ প্রচারে ব্যস্ত।দুপুর ১ টার দিকে উপরের নির্দেশ শাপলার ময়দানে হাজির হওয়ার। আমরা হেঁটে রওয়ানা দিলাম। রাস্তায় হাজারো তৌহিদী জনতার ভীড়। কেউ কেউ পানির বোতল, বাসায় পাকানো খাবার নিয়ে আপ্যায়ন করছে। চলার পথেই আমরা তা উদরস্থ করলাম। এক মসজিদে জোহর পড়লাম। রামপুরার রাস্তা ধরে আমরা চলছি। বায়তুল মোকাররমে যাওয়ার আগেই আমরা পুলিশের মুখোমুখি। আছরের নামাজের সময় হলো। এক মসজিদে নামাজ পড়লাম। আবার রাস্তায় এলাম। সামনে টিয়ার গ্যাস। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সামনে এগোবার পথ নেই। স্থানীয় কিছু সাহসী ভাইয়েরা আমাদের উৎসাহ দিচ্ছে সামনে এগোবার। চারদিক থেকে গুলির আওয়াজ। প্রায়ই চোখের সামনে দিয়ে রিকসায়, এম্বুলেন্সে করে লাশ যাচ্ছে। লাশের মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। কোন পথ নেই শাপলা চত্বরে যাওয়ার। আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। মোবাইল চার্জ শেষ হওয়ার পথে। কারো সাথে যোগাযোগ করছি না। ভাবছি রাতে নীরব হলে ফোন দিব। মাগরিবের পর অনেক বার তৈরী হয়েছি শাপলা চত্বরে যাব বলে। কিন্তু সম্ভব হয়নি। সন্ধার পর আরো কয়েক দফা মুখোমুখি। আমাদের হাতে ভাঙা ইট, আর ওদের বুলেট। কিছুক্ষণ পরপর আমাদের সামনে দিয়েই লাশ যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আহতরাও। একটি দলের অতি সাহসী ভাইয়েরা ইট মেরে মেরে বড় বড় দালানের কাঁচগুলো ভেঙে দিচ্ছে। রাস্তায় গাছ কেটে অবরোধ করছে। নারকীয় তান্ডব চলছে। আমরা কোথায় যাব ভাবছি। কোন আত্মীয় স্বজনের বাসা পাশে নেই। এশার আজান হলো। পাশের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লাম। নামাজের সাথে সাথেই কর্তৃপক্ষ আমাদের বের করে দিলেন। মসজিদ খালি করতে হবে। কেউ মসজিদে থাকতে পারবে না। বের হয়ে আরেকটি মসজিদে গেলাম। দেখি পা রাখার জায়গা নেই। তিনতলায় গেলাম। সেখানে একটু ঠাঁই পেলাম। সারাদিনের না খাওয়া, ক্লান্ত দেহ এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজের অজান্তেই। কিছু ভাইয়েরা রুটি ও কলা নিয়ে এলেন। বললাম: হাজার হাজার জনতার কয়জনের খিদে নিবারণ করবেন? একজন বলল; যতটুকুই পারা যায়, চেষ্ঠা আরকি। আরও কিছু ভাই ছোট ছোট প্যাকেটে করে খাবার নিয়ে এলেন। তাদের সহমর্মিতার কথা কোন দিন ভুলা যাবেনা। তাদের আদর্শ আমার চিরকাল মনে থাকবে। রাত ১২ টা। হঠাৎ আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিল। ডাক এসেছে সকলকে শাপলা চত্বরে যেতে হবে। উপরের নির্দেশ। সবাই চোখ কচলে হাঁটতে শুরু করলাম। এই বড় পথ দিয়ে যাওয়া যাবে না। গলি পথ দিয়ে আমরা নির্বিঘ্নে শাপলা চত্বরে এলাম। হাজার মুসলিম ঘুমিয়ে আছে। এক পাশে বক্তব্য চলছে। সাহস করে আমি একেবারে মঞ্চের কাছে গেলাম। দেখলাম পাশে ৬টি লাশ আছে। আত্মীয়রা আসলে নিয়ে যাবে। খবর দেয়া হয়েছে। দু চোখে ঘুমের ভাব। এরপরও বসে থাকলাম শাপলার সামনে।
রাত ১ টা শুরু হলো আকাশ কাঁপানো গুলির আওয়াজ। হাজারো বন্দুক থেকে একযোগে তিন দিক থেকে গুলি আসছে আমাদের ধেয়ে। একটা হুড়ো হুড়ি শুরু হলো। কোন দিকে যাই? চাইলাম ব্যাংক এড়িয়ায় প্রবেশ করতে না পারিনি। সামনে এগুতে চেষ্ঠা করলাম। মানুষের চাপে নিচে পড়ে গেলাম। আট দশজন মানুষ মনে হয় আমার পিঠে পা রেখে সামনে এগুয়েছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দুহাতে মাটিতে ভর দিয়ে উঠলাম। চশমাটা পড়ে গেল। আবারও নুয়ে কষ্ট করে ধরলাম। পকেটে মানি ব্যাগ। এক হাতে মোবাইল মানিব্যাগে ধরে রাখলাম। কেননা আমার হাতে সাথীদের সকলের টাকা জমা ছিল। যদি হারিয়ে যায়, বিশ্বাস নাও করতে পারে। জীবন গেলেও পকেট ছাড়বো না। এক হাতে চশমা ধরে দৌড় দেওয়ার চেষ্ঠা করলাম। আরেকটি বাসার এরিয়ায় প্রবেশের চেষ্ঠা করলাম। দেখি কাটাতারের বেড়া। জুতা হারিয়ে ফেললাম। শরীরে শক্তি নেই। বহু চেষ্ঠা করে দেয়াল টপকালাম। ভিতরে গিয়ে দেখি অনেকগুলো বাস। অনেকেই বাসের নিচে, আবার কেউ বহুতল ভবনের নিচে একটু ফাঁকা দেখে লুকোতে চেষ্ঠা করছে। আমি ও কয়েকজন একটি বাসের নিচে ঢুকলাম। একদলা বালি মাটি শরীরের পড়ল।পায়ের দু জায়গায় আঘাত পেলাম। মনে হয় কাঁটাতারে লেগে কেটে গেছে। এদিকে খেয়াল নেই। এক সময় হয়ত রক্ত বন্ধ হয়েছে। বাইরে প্রচণ্ড গুলির আওয়াজ। আবার আমরা যেখানে ঢুকলাম সেই এরিয়ার মুল ফটকে জোরে জোরে লাথির আওয়াজ শুনতে পাচিছ। জোরে জোরে ডাকছে বের হয়ে আয় নয়তো ভিতরে এসে গুলি করব। দু হাতে কান ধরে আছি। পাশেই বিকট আওয়াজ হচ্ছে গুলির। তওবা পড়ে নিলাম। মনে মনে ভাবছি, এই বুঝি ইরাকের আফগানিস্তানের অবস্থা। কেউ কেউ বাহির হওয়ার চেষ্ঠা করছে। দেয়াল টপকিয়ে বের হয়ে যাচেছ। কেউবা বাসের ভিতর লুকোচ্ছে। আমি ও আরও অপরিচিত কয়েকজন বাসের নিচেই বসে রইলাম। ফজরের আজানের আগে আবারও ডাক শুরু হলো। বের হয়ে এসো তোমাদের কিছু করা হবে না। আমরা যদি ভিতরে আসি তাহলে খারাপ হবে। কেউ কেউ বের হলো। আমি ভাবলাম আরো একটু আলো হোক পরে বের হবো। আজান তখনও চলছিল। আমি আরও কয়েকজনের সাথে বের হলাম। সারা শরীর ধুলো মলিন। পকেট থেকে টুপিটা বের করে মাথায় দিলাম। অনেকেই টুপি হারিয়েছে। টাকা হারিয়েছে, জুতো হারিয়েছে বেশিরভাগ। আরও অনেকে তো নিজের প্রাণটাই হারিয়েছে। আল্লাহ হয়তো আমাকে কবুূল করেনি। মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে হাঁটছি। দেখলাম কিছু পুলিশ সামনের লোকগুলিকে লাঠিচার্জ, লাথি দিচ্ছে। কেউ কেউ অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করছে। আরও আসবি? আমি দৌড় না দিয়ে ধীরে ধীরে বের হয়ে এলাম। মনে মনে কালিমা পাঠ করছি। কোন দিকে যাব ভাবছি। শেষ পর্যন্ত যাত্রাবাড়ীর দিকে রওয়ানা দিলাম। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে জামাতের সাথে ফজরের নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষে বাস স্ট্যান্ডে এসে আমার এলাকার একজনকে পেলাম। তার সাথে যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় গেলাম। সেখানে যাওয়ার পরও কয়েকবার ধাওয়া পাল্টা হলো। স্থানীয় লীগাররা মাদরাসায় হামলা করতে চাইলো। ছাত্রদের প্রতিবাদের মুখে তারা সরে পড়ল। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ পর গোসল করলাম। কাপড় ধুইলাম। একটু ঘুমালাম। মোবাইলটা চার্জ করলাম। নাস্তা খেয়ে জোহর পরে বাসে করে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলাম। সেখানে ট্রেনের টিকিট কাটলাম। বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলাম। বহু পরিচিত মুখের সাথে দেখা হলো। সবাই আতংকে আছে, কেউ কারো সাথে এ বিষয়ে কথা বলছে না। রাত ১১টার দিকে ময়মনসিংহ এলাম। সিএনজি করে কেন্দুয়া এলাম তখন রাত ১টা বাজে। সাথে করে নিয়ে এলাম কিছু দু:সহ স্মৃতি। সারা রাত আর ঘুমাতে পারিনি। পরদিন বাসায় এসে দিনভর ঘুমালাম। আর কেউ কেউ চিরতরে ঘুমিয়ে গেছে। তাদের কথা মনে করতে লাগলাম। (সংক্ষিপ্ত ভাবে সমাপ্ত)
বিষয়: বিবিধ
২৩৮২ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন