স্মৃতির মণিকোঠায় বাবা : টুকরো টুকরো স্মৃতি
লিখেছেন লিখেছেন নকীব কম্পিউটার ২১ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৮:৩২:১৭ সকাল
পৃথিবীর সব বাবারাই সন্তানের মঙ্গলের জন্য শ্রম দিয়ে থাকেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করে আয়-রোজগার করে সন্তানের ভরণ পোষণ করেন। এত কঠোর পরিশ্রম করে যখন তিলেতিলে সন্তানকে বড় করেন, শিক্ষিত করেন, তখন কি তাদের উপর কোন হক বা অধিকার থাকে না? মনুষ্যত্বহীন, নিমক হারাম আর পিতার অবাধ্য সন্তানেরা সে কথা ভুলে যায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি- প্রভূ যেন আমাদের পিতা মাতার অবাধ্য সন্তান না বানান।
১। আমার বাবার পড়াশুনা বেশি ছিল না। তবে পড়াশুনাকে মূল্যায়ন করতেন। ঘরে যখন নিজে একাকী থাকতেন পুঁথি পড়তেন। আমার দাদার রেখে যাওয়া কিছু ইসলামী বই ছিল। সেই গুলি তিনি পড়তেন। আমি যে বছর ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা দিব- সে বছরের কথা, প্রতিদিনই ফজরের আগে বাবা আমার ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। আমার প্রাইভেট শিক্ষক ছিলেন কৃষক মানুষ। আমার মনে আছে, স্যার একটি গমের ক্ষেত করেছিলেন বাড়ী থেকে অনেকটা দূরে। সেখানে গিয়েও আমরা পড়াশুনা করতাম। ক্ষেতের পাশে ছালার চট বিছিয়ে সকালবেলা পড়তাম।
২। আমার বাবা কৃষক ছিলেন। কিন্তু কৃষি কাজে মন বসত না। জমিতে কাজ করাতেন কাজের লোক দিয়ে। নিজে জমিতে গেলেও কিছুক্ষণ পরেই চলে আসতেন। বেশি সময় তিনি মাছ শিকারে লিপ্ত থাকতেন। এটা তার নেশা ছিল। সকাল বেলা চলে যেতেন আর দিনভর নৌকা নিয়ে নদীতে বসে থাকতেন। তাঁর মত বড়শী শিকারী আমাদের এলাকায় বিরল ছিল। নদীতে পাওয়া যায় সব ধরণের মাছ আমরা খেয়েছি। অনেক বড় বড় মাছ । আজ মাছের বাজারে গেলে বড় বড় মাছের দাম শুনলে ভয় লাগে। অথচ এই সমস্ত মাছ আমার বাবা নিয়মিত শিকার করতেন। বাবার জন্য দোয়া করি- আল্লাহ যেন তাকে ক্ষমা করে দেন। বাবা তুমি মাছ ভক্ষণ কেন শুধু কোন ব্যাপারেই অতৃপ্ত রাখনি। আমরা ছোট বেলায় যে পরিমাণ মাছ খেলাম সারা জনম চেষ্ঠা করলেও আমার সন্তানকে তা খাওয়াতে পারব না।
আমার বাবা বাজারে গেলে সিজনারী ফল কিনে আনতেন। আমাদের গাছের কোন ফল বিক্রি করতে দিতেন না। আমরা ভাইবোন সংখ্যা বেশি। এরপরেও তিনি কাউকে অতৃপ্ত রাখতেন না। সবাইকে সমানভাবে ভাগ করে দিতেন। বোনদেরকে বলতেন- আমার বাড়ী থেকে সব খেয়ে যাও, স্বামীর বাড়ী গিয়ে কখনো বায়না ধরবে না, এটা খাব, ওটা খাব। অল্প তুষ্টির শিক্ষা আমাদের দিতেন।
আমার ছোটবেলার একটি ঘটনা। তখন চৈত্র মাস। এলাকায় অভাব আর অভাব। সবাই আটার পিঠা আর গমভাজা খেয়ে থাকে। আমি এখনও আটার পিঠা পছন্দ করি না, তখনও খেতে পারতাম না। আমার দাদী ছিলেন বৃদ্ধ মানুষ। তার জন্য আর আমার জন্য শুধু চাল কিনে আনা হত। যা খুব সামান্য কিন্তু দাম বেশি। এখনতো অভাব বলতে কিছু নেই। আমার দাদী ভাত না খেয়ে আমার জন্য রেখে দিত। তখনই বাবা বলতেন- মা, ভাত খাওনা কেন? দাদী বলতেন- আমার নাতি টা আরেকবার খাইব নে। দাঁত ছিল না দাদীর। আটার পিঠা খেতে তার কষ্ট হত। একবার তো গলায় আটকে গেল দাদীর। আমরা তাড়াতাড়ি পানি পান করতে দিতাম আর গলায় ঢলতাম। যাতে সহজে নিচে নামে।
বাবা বলতেন- ‘আমার পোলা জমিদার অইয়া জন্ম লইছে। আটা খাইত পারে না। খালি বাছাবাছি করে। বাছাবাছি কইরে খাইলে ব্যাটা হইতে পারবে?’ আসলে আল্লাহ তায়ালা আমাকে অন্য রকম রুচি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যে গুলি আমার অন্য ভাই বোনদের নেই। ভাই বোনেরা যে সকল কাজ করত, আমি সেই সমস্ত কাজ করতে পারতাম না। তারা যা খেতে পারত, আমি তা সব খেতে পারতাম না। এখনও এই স্বভাব আছে।
আমাদের কয়েকটা গরু ছিল। কাজের ছেলেটি বাড়ী গেলে আমাদের দুই ভাইয়ের গরু রাখতে হত। আমার গোয়াল ঘর পরিষ্কার করতে হত। অন্যরা হাত দিয়ে কাজ করলেও আমি কোদাল দিয়ে গোবর সাফ করতাম। আর পায়ে থাকত জুতা। একদিন তো আব্বা গোয়াল ঘরে গিয়ে দেখেন আমার হাতে কোদাল আর পায়ে জুতা। হাতে পায়ে যাতে গোবর না লাগে। তখন কিছু না বললেও খাবারে বসার পর ঠিকই সবার কাছে বললেন আমি কিভাবে গোবর পরিষ্কার করি। আমার তখন লজ্জায় মাথা নত। কষ্ট আমার শরীরে সহ্য হত না। ডাক্তার আমাকে নিষেধ করেছিলেন মাথায় ভারী বোঝা না নিতে, রোদে না যেতে, ফুটবল না খেলতে। কেননা চোখের কিছু সমস্যা হয়েছিল জন্মের কিছুদিন পর। এখনও সেই সমস্যা বিদ্যমান। গ্রামে বড় হলেও এখন আমি গ্রামে থাকি না। কষ্ট কম এমন কর্ম করেই জীবিকা উপার্জন করি।
আমার মা, অন্য ভাই বোনেরা গ্রামে থাকেন। ঈদে বা বিশেষ অনুষ্ঠানে আমরা সবাই একত্রিত হই। আমার ভাই বোনেরা বলে- ঈদে আমি বাড়ি না গেলে তো ঈদ প্রাণবন্ত হয় না। সব মরা মরা লাগে তাদের কাছে। আমি যতক্ষণ বাড়ী থাকি সবাই হাসি খুশিতে থাকে। কারণ খুনসুঁটি গুলি আমিই নিরসনে ভূমিকা নেই। মা চরম রাগান্বিত থাকলেও আমি নানা রকম গল্প, ঘটনা শুনিয়ে সবাইকে হাসিয়ে ছাড়ি।
৩। পড়তে আর লিখতে আমার ভাল লাগে। হাতের কাছে যা পাই তা পড়ি। তা থেকে জ্ঞান নিতে চেষ্ঠা করি। ২০০১ সাল থেকেই আমি কিছু কিছু লিখতাম। মাসিক রহমত পত্রিকায় আমার লিখা ছাপা হত। আমি যখন কিছু লিখতাম, বাবা খুব মনোযোগ সহকারে পড়তেন। নিজে ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকলে আমাকে বলতেন- পড়, আমি শুনতেছি। ভাই বোনদের যদি কেউ কথা বলত এই সময়, তাহলে এমন ভাবে তাকাতেন- যেন কী যে করবেন। আমাকে বেশি বেশি লিখার জন্য উৎসাহ দিতেন । আমি যখন বাড়ীতে ছুটিতে এসে ঘরে বসে কুরআন শরীফ পড়তাম বাবা তখন মনোযোগ সহকারে শুনতেন। মাঝে মাঝে পাড়ার অন্য লোকদের ডেকে আনতেন, আমার কুরআন তিলাওয়াত শুনার জন্য।
৪। আমার বাবা একবার আমার জন্য গ্রীষ্মকালীন ফল নিয়ে মাদরাসায় এলেন। হেঁটে আসার পথ। তখন এই রাস্তায় রিকসা পাওয়া কঠিন ছিল। রাস্তায় একটি খাল ছিল। পানিতে ভরপুর। পানিতে নামলেন। অমনি বাঁশের খোঁটার আঘাত লাগে উরুতে। অনেকটা কেটে যায় । এটা আমি পরে জানতে পারি মায়ের কাছ থেকে। কিন্তু বাবা আমার কাছে বলেন নি- তোর জন্য আমি দু:খ পেলাম। বেশ কয়েকদিন কষ্ট করতে হয়েছে বাবাকে। এই কাটা শুকাতে অনেক সময় লাগে। যে বছর বাবা নিজে না আসতে পারতেন তখন আমার ছোট বোনদেরকে পাঠাতেন আম, কাঁঠাল দিয়ে। আমি ২ মাস অন্তর অন্তর বাড়ী যেতাম। আর ১ দিনের বেশি বাড়ীতে থাকতাম না। মাদরাসায় পড়াকালীন আমার কোন অনুপস্থিতি ছিল না।
৫। বাবা আমাদের জন্য খুব কষ্ট করতেন। তা অস্বীকার করার জো নেই। একবার মা আমাকে কিছু চাল ভেজে দিলেন। যাও তো বাবা, এগুলি তোমার বাবার জন্য নিয়ে যাও। প্রায় ২ মাইল দূর হাওড়। সেখানে আমি নিয়ে এলাম। বাবা জমিতে চাল চাষ করতেছিলেন। তখন ট্রাক্টর ছিলনা আমাদের এলাকায়। গরুগুলিকে দাঁড় করাইয়া রাখিয়া আমার হাত থেকে চালভাজা গুলি নিলেন। কোথাও বসলেন না। কাঁদার জমিতে দাঁড়িয়ে থেকেই কিছুক্ষণ চালভাজা ভক্ষণ করলেন। ঢক ঢক করে জগ থেকে পানি পান করলেন। এরপর বলেন- যাও বাবা পড় গিয়ে, স্কুল কামাই দিও না। বাবার সেই কষ্টের কথা মনে হলে, চোখ দিয়ে বেদনার অশ্রু ঝরঝর করে ঝরে পড়ে। বাবার জন্য হাওড়ে ভাত নিয়ে আমি মাঝে মাঝে যেতাম। আমার শখ ছিল- অন্যদের সাথে হাওড়ে বসে রোদের মধ্যে ভাত খাওয়ার। আমার মনে হত বাড়িতে বসে ভাত খাওয়া থেকে হাওড়ে বসে খেলে মজাই আলাদা। মা সেটা জানতেন। তাই ভাত-তরকারী আমার জন্যও দিয়ে দিতেন। আর আমি না শুধু অন্য ছেলেদেরও আব্বা ডেকে এনে খাওয়াতেন।
৬। আমার বাবা আমার কারণেই দাড়ি রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমি যখন মাদরাসা থেকে বাড়ি আসতাম। আর মাকে বলতাম বাবা কেন দাড়ি রাখে না। অনেক দেরীতে নামায ধরেছেন। বিশেষ করে ৯৪ সালের পর আমি যখন মাদরাসায় গেলাম। তাবলীগে গিয়েছেন পাড়ার অন্য লোকদের সাথে। আমলে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছিল। শার্ট ছেড়ে পাঞ্জাবী পড়া শুরু করেছিলেন।
৭। আমার বাবার একটি রোগ ছিল। বেশি ঠান্ডা লাগলেও সমস্যা বেড়ে যেত আবার বেশি গরম লাগলেও রোগ বেড়ে যেত। টনসিল ফুলে উঠত। ব্যাথায় কোন কিছু খেতে পারতেন না। খেতে না পারলে মেজাজ খুব খারাপ থাকত। মা বাবার জন্য সাবুদানা, সুজি রান্না করে দিতেন। এগুলি খেতেন, ঔষধ খেতেন। আমার খালু বলতেন- অপারেশন করানোর জন্য। বাবার ভয় ছিল যদি মারা যাই।
আমার বাবা অবশ্য টনসিলের ব্যাথার কারণে মারা যাননি। আমার এক বোনের বাড়ীতে গিয়েছিলেন। তাদের বাড়ীর জায়গা নিয়ে ঝামেলা ছিল। দরবার সালিশ করে মীমাংসা করলেন। জায়গা মেপে দেওয়ার কাজ শেষ করে তাদের বাড়ীতে খাওয়া-দাওয়া করলেন। বাড়ীতে এসে রাতের বেলায় স্ট্রোক করলেন। ভাইয়েরা বাবাকে ময়মনসিংহ নিয়ে গেলেন। কিন্তু তিনি আর বাঁচতে পারলেন না। আমি তখন বাড়ী ছিলাম না। রাতে আর বাবার সাথে শেষ কথা বলতে পারি নি। পরদিন সকালে যখন আমিও ময়মনসিংহ গেলাম। তখন দেখি একটি এম্বুলেন্স বাহির হয়ে আসছে মেডিকেল কলেজের গেট থেকে। চিরদিনের মত বিদায় হয়ে গেলেন আমার বাবা। এত সুঠাম দেহের অধিকারী বলিষ্ট লোকটি আর দুনিয়াতে নাই। পরিপূর্ণ বৃদ্ধ হওয়ার আগেই পরপারে পাড়ি জমালেন। আমার বাবা আজ দুনিয়াতে নাই। গত ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী আমার পিতা দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছেন।
আমি কুরআন তিলাওয়াত করে বাবার জন্য দাদা-দাদী, নানার জন্য দোয়া করি। গত রমজানে বাবার নামে কুরআন তিলাওয়াত খতম করলাম। বাড়ীতে প্রতি বছরই মৃত্যু বার্ষিকী পালন করে থাকে। আমি বলি বছরে একটি দিন কেন যে কোন সময়ই তো গরীবদের এনে খাওয়ানো যায়। দান খয়রাত করার জন্য তো কোন তারিখ নির্দিষ্ট করতে হয় না। আমি তো প্রতি ওয়াক্তের নামাযের পর এই দোয়াটি পাঠ করি- রব্বির হামহুমা কামা রব্বাইয়ানী সগীরা। এরপরেও আমার বোনেরা বাবার মৃত্যুর দিনটিকে স্মরণ করে থাকে। বাধ্য হয়ে আমাকেও যেতে হয় ওই দিন বাড়ীতে।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকাগণ, আপনাদের মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমার বাবার জন্য সবাই দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন আমার বাবাকে জান্নাতবাসী করেন।
বিষয়: Contest_priyo
১৪৭৩ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আপনার আব্বাকে জান্নাতবাসি করুন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন