ছোট গল্প নতুন বইয়ের গন্ধ
লিখেছেন লিখেছেন আবু আশফাক ০৪ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৮:৪৯:০১ সকাল
আজ রুমার চান রাত। প্রকৃত চান রাত নয়, তবে তার চেয়েও যেন বেশি কিছু। আজ সে হয়ে উঠেছে তার প্রিয় পুসি’র সমক এক নতুন পুসি। ঘরময় তার ছুটোছুটিতে আদনান সাহেব বেজায় খুশি। কে না চায় তার সন্তান আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে চু শীতল করুক? তবে এতোণ যারা ভাবছেন ‘কি কারণে রুমার এই আনন্দ-উচ্ছ্বাস'? তাদের জন্য উত্তর হচ্ছে- নতুন বইয়ের গন্ধ!
নতুন বইয়ের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে আজ বাড়িকে মাথায় তুলেছে রুমা। আজ বাবা নতুন বই উপহার দিয়েছে রুমাকে। উহ! কি সেই বইয়ের গন্ধ! কি সুন্দর বইয়ের মলাট!! লাল টুক টুকে সূর্যের নীচ দিয়ে উড়ন্ত পাখিটি কি নির্ভয়ে উড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা ওরা সূর্যের এতা কাছে যায় কীভাবে? ভাবছে রুমা।
এখন ওকে যেন নব আবিষ্কারের নেশায় পেয়ে বসেছে। বইয়ের ওপরের (কাভার) ছবিটার দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে রুম। ইস! পাখিটার মতো যদি দুটো ডানা আমারও থাকতো! তাহলে আমিও হারিয়ে যেতাম দূরদিগন্তে ঐ চাদের দেশে। এসব ভাবছে আর গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে তার সেই নতুন বইয়ের দিকে।
রুমা ভাবছে- আব্বুটা যে কি না! আমি সেই কবে বড় হয়েছি, আর আমাকে আজকেই মাত্র বই এনে দিল! নাহ! আগে বই পেলে কি এমন সুন্দর বই পেতাম? এমন সময় আদনান সাহেব ডাক দিলেন, রুমা মা; এদিকে এসো তো। বই নিয়ে ছুটে গেল রুমা।
আব্বু, আরো আগেই আমাকে নতুন বই এনে দিলে না কেন?
তুমি তো তখন আরো ছোট্ট ছিলে, তখন কি পড়তে পারতে?
হ্যা, আমি আরো আগে পড়তে পারতাম। না পারলে টুকটুকে ছবিগুলো দেখতাম!
এখন দেখ, তোমাকে আরো সুন্দর সুন্দর বই এনে দেব। তুমি পড়ে পড়ে আমাদের শুনাবে। আচ্ছা আম্মু, বলো তো এটা কি?
আব্বু যে কি না! আরে বাবা এটাতো একটি পাখি। আকাশে উড়ছে, কি সুন্দর লাগছে তাই না আব্বু? আমি যদি ওটার মতো উড়তে পারতাম!
হাসলেন আদনান সাহেব। আসলে ছোটদের মনটাই এমন। সেদিন একটি স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম নতুন বই নিয়ে হাসিমুখে ছুটাছুটি করছে। কিছু আবার লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ছোটবেলায় খুব উৎকন্ঠায় থাকতাম কখন বই দিবে। নতুন বই দিতে কেন স্যাররা এত দেরী করছে? এ নিয়ে আমরা রীতিমত গবেষণা করতাম। তারপর একদিন হঠাৎ দেখা যেত বিশাল বিশাল বইতের স্তুপ নিয়ে ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে স্কুল মাঠ। আমরা ঘিরে ধরতাম নতুন বই। লাল নীল হলুদ রঙের বই। স্যার ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিতেন। আমরা আবার ফিরে আসতাম। বই গিয়ে জমা হত স্কুল ঘরে। আমরা অপোয় থাকতাম বইয়ের জন্য। একসময় আমাদের হাতে আসত বই। নতুন বইয়ের সবচেয়ে মজার অভিজ্ঞতা ছিল এর গন্ধ। বই খুলে গন্ধ নিতে এত ভাল লাগত আমাদের। নতুন বই নেয়ার আগে পুরনো বই জমা দিয়ে দিতে হত। ব্যাপারটা আমার মোটেই ভাল লাগত না। আমি করতাম কি বইয়ের ভিতরে যত ছবি আছে সব কাঁচি দিয়ে কেটে রেখে দিতাম। আমার বন্ধুদেরও এই মহান কাজে শামিল করতাম। ভেবেছিলাম আমার বাবা আমার এই বুদ্ধিতে খুব খুশি হবেন। কিন্তু উল্টো আমাকে জ্ঞান দিলেন- এইসব করা ভাল না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও খুব লজ্জা পাওয়ার ভান করে বললাম এরকম আর করব না। বড়রা যে ছোটদের চেয়ে কম বুঝে এটা আমি তখনি টের পেয়েছিলাম। আর ওদেরকে বোঝনোও যায় না। একদম আমাদের রাজনীতিবিদদের মত। নিজেরা যা বুঝে তাই। সুতরাং বড়রা কি বলল সেটা কোন ব্যাপার না। আমরা পুরনো বই কাঁচি দিয়ে কাটা বন্ধ করিনি। বই দেয়ার পরে স্যাররা মাঠে জড় করিয়ে আমাদের বাণী দিতেন। বই ছেঁড়া যাবে না, হ্যান না ত্যান না। বাঁধাই করতে হবে। ভয় দেখাতেন। আমার খুব কষ্ট হত এত সুন্দর বইয়ের উপর কালো কালো কিংবা খাকি কালারের গাধা কাগজ মুড়িয়ে দিতে। বড়রা চিরকালই ছোটদের শত্রু। আজ দুপুরে একটি স্কুলের সামনে ছোট ছোট হাসি মুখ দেখে আমার মন আনন্দে ভরে গেছে। কতদিন হুয়ে গেল নতুন বইয়ের গন্ধ নিই না। তালপাতার বাঁশি আর আগের মত বাজে না। দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না। এসব ভাবতে ভাবতে কোথায় হারিয়ে গেলেন আদনান সাহেব।
আব্বু! এতো কি ভাবছো? মেয়ের কথায় সম্বিত ফিরে পেলেন আদনান সাহেব।
কি আর ভাববো রে মা। আমি ভাবছি ছোট বেলার কথা। আমি যখন তোমাদের মতো ছোট ছিলাম তখন আমরাও নতুন বই পেয়ে খুব খুশি হতাম। ক খ অ আ পড়তাম। কি যে মজা লাগতো! তুমি এখন থেকে পড়, খুব মজা পাবে।
রুমার কাছে যেন কথাগুলো বিদঘুটে লাগলো। আব্বু কি বলেন, আব্বুরা কোনো দিন ছোট থাকতে পারে? ছোট্ট মনে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো রুমা। বাবাও যে এক সময় ছোট ছিলেন, একথা তার ছোট্ট মনে মানতেই চায় না।
কি ভাবছো মা? প্রশ্ন করেই যেন বোকামীটা করে ফেললেন আদনান সাহেব।
আচ্ছা আব্বু! আব্বু আম্মুরা কি ছোট থাকতে পারে?
কেন পারে না। তারাও তোমার মতো এক সময় ছোট ছিলেন। এক সময় তুমিও তাদের মতো বড় হবে। বুঝতে পেরেছ মা?
ঘাড় কাত করলো রুমা। ঠিক বোঝা গেল না, সে হ্যা বললো নাকি না বললো।
আচ্ছা মা, এবার যাও তুমি ঘুমিয়ে পড়। সকালে উঠে তোমাকে আমি স্কুলে নিয়ে যাব। সেখানে তোমার মতো অনেক ছেলে মেয়েদের সাথে পড়াশোনা করবে, খেলবে, অনেক মজা হবে।
আমার বইটা কোথায় রাখবো আব্বু? প্রশ্ন করলো রুমা।
কেন? টেবিলের ওপরে রাখো।
যদি কেউ নিয়ে যায়?
কেউ নিবে না। তোমার বই কি অন্যরা পড়তে পারে যে নিবে?
কিন্তু রুমার মন সেটা মেনে নিল না। তাই সে তার বইটি বুকের সাথে ধরে বিছানায় চলে গেল। সেখানে গিয়েও যেন শান্তি নেই। কখনও বইটির পাতা উল্টিয়ে দেখছে, কখনও বই দিয়ে মুখ ঢাকছে, কখনও বইয়ের গন্ধ শুকছে, আবার কখনও বইটিকে চুমো খাচ্ছে।
এক সময় বইটি বালিশের নিচে রেখে শুয়ে পড়লো রুমা। যেন সেটিই তার প্রিয় বইয়ের নিরাপদ স্থল।.. . . . . .
বিষয়: বিবিধ
২০৫৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন