একজোড়া খড়ম ও ৮০’র দশকে ফিরে যাওয়া
লিখেছেন লিখেছেন আবু আশফাক ১২ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:৪১:৪৯ রাত
আমাদের কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার হিসেবে কর্মরত উত্তরবঙ্গের এক ভদ্রলোকের সাথে অফিসের সবারই মোটামুটি ভালো সম্পর্ক। তবে এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবার চেয়ে আমার সাথে একটু বেশি বলে মনে হয়। কারণ হচ্ছে- তিনি নাকি আমার ভায়রা ভাই। তো কীভাবে?
পাঠক অনেকেই হয়তো জানেন, আমার শশুড়বাড়ী বনলতা সেনের নাটোরে। ঐ ভদ্রলোকের শশুড়বাড়ীও নাটোরে! সুতরাং তিনি আমার ভায়রা ভাই!!
সে যাই হোক, ভদ্রলোকের বাড়ি বগুড়ায় হওয়ায় একবার তিনি আমাদের বিখ্যাত বগুড়ার দই খাইয়েছেন। তা যাক সে প্রসঙ্গ।
এখন যে প্রসঙ্গের অবতারণা করতে কী-বোর্ড চালাচ্ছি তা হলো- তিনি আজকে আমার জন্য একজোড়া খড়ম পাঠিয়েছেন। খড়ম জোড়া পায়ে দিয়ে দাদার স্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠছে বার বার।
দাদা ভাইকেই আমি প্রথম খড়ম পায়ে হাটতে দেখি। সেটা অবশ্য শেষ বারও মনে হয়। সময়টা ছিল ৮০’র দশক। এর পরে আর সেভাবে খড়ম পায়ে কাউকে হাটতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
খড়ম কী?
উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা মতে, খড়ম একপ্রকার কাঠের পাদুকা। হিন্দি "খড়ৌঙ" শব্দটি থেকে বাংলায় "খড়ম" শব্দটির উৎপত্তি। সংস্কৃতে খড়ম "পাদুকা" নামে পরিচিত।
একখণ্ড কাঠ পায়ের মাপে কেটে খড়ম তৈরি করা হয়। সম্মুখভাগে একটি বর্তুলাকার কাঠের গুটি বসিয়ে দেয়া হয় যা পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও পাশের আঙ্গুলটি দিয়ে আঁকড়ে ধরা হয়। বর্তমানে পা আটকে রাখার জন্য কাঠের গুটির পরিবর্তে রাবার খণ্ড ব্যবহার করা হয়। প্রাচীন কালে খড়মের উদ্ভব। খড়ম পায়ে হাঁটা সহজ নয়। এছাড়াও খড়ম পায়ে হাঁটার সময় চটাশ্ চটশ্ বেশ শব্দ হয়। বাংলাদেশের নিম্নোদ্ধৃত লোকজ ছড়াটিতে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে :
হরম বিবি খড়ম পায়
খটটাইয়া হাঁইটা যায়
হাঁটতে গিয়া হরম বিবি
ধুম্মুড় কইরা আছাড় খায়
আছাড় খাইয়া হরম বিবি
ফিরা ফিরা পিছন চায় ....
ভারত উপমহাদেশের বিশিষ্ট আউলিয়া হযরত শাহজালাল (রহ ১৪শ শতকে বাংলাদেশের সিলেটে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর ব্যবহৃত খড়ম এখনো তাঁর সমাধিস্থল সংলগ্ন স্থাপনায় রক্ষিত আছে।
‘খড়ম’ এখন শুধুই স্মৃতি
বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাঠ নির্মিত পাদুকা খড়ম এখন শুধুই স্মৃতি। এককালে সমগ্র দেশের মানুষই ছিলো খড়ম নির্ভর। কিন্তু বর্তমানে এ শিল্পটি হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।
বর্তমানে চামড়া, রেকসিন, প্লাস্টিক, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি জুতা (পাদুকা) মানুষের পায়ে শোভা বর্ধন করে। বিগত কয়েক বছর ধরে বার্মিস জুতায় ছেয়ে গেছে বাংলাদেশের নগর মহানগর শহর এমনকি গ্রাম বাংলার মানুষের পায়ে পায়ে। বলতে গেলে এখন দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই বার্মিস জুতা ব্যবহার করেন। অথচ ৭০’র দশক পর্যন্ত গ্রাম বাংলায় অনেক জনপ্রিয় ছিল এই খড়ম পাদুকা। জানা যায়, কাঠ দিয়ে তৈরি খড়ম পরিবেশবান্ধব। তারপরও মানুষ এটিকে পরিহার করেছে। অপরদিকে বার্মিস জুতা মানুষের মাথা গরম করা, পায়ের নিচের স্তর চামড়া মোটা করে বয়রা নামক রোগের সৃষ্টি করে।
বিষয়: বিবিধ
৩১১০ বার পঠিত, ৪৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আচ্ছা খরম কি লুঙ্গীর সাথে বেশি মানান সই??
নাকি পায়জামাতে ? ? ভালো লাগলো ধন্যবাদ।
পিলাচ ++
দ্বিতীয়ত, খড়ম পাজামা নাকি লুঙ্গির সাথে মানানসই তা হয়তো বলতে পারবো না, তবে সে সময় লুঙ্গি পরিহিতদের পায়েই বেশি দেখেছি বলে মনে পড়ে।
আমার দাদা-দাদিকে ব্যবহার করতে দেখতাম। আব্বাও একসময় ব্যবহার করতেন। গ্রামের দিকে অনেককে কয়েকবছর আগে ব্যবহার করতে দেখেছি। খড়ম এর আরেকটা ভাল ব্যবহার আছে। পিটানর জন্য বেশ ভাল!!
ধন্যবাদ স্মৃতিময় পোস্টটির জন্য।
ঢোলের তালে ঢেড়ম ঢেড়ম
লাগছে আহা লাগছে চরম
চলছি পাযে শাহী খড়ম
শাহী নহে গ্রাম্য খড়ম
পায়ে দিয়ে লাগছে চরম
কাঠের উপর পা দিয়েছি
মনে মনে ভাবছি নরম!
অনেকদিন আপনার কবিতা দেখছিনা???(!)
অফিসে আমার নিজেই রাজা
বিব্রত করা নয়তো সোজা
আস্তে হাটলে হয় না আওয়াজ
শৈল্পিক এক ভাবনা খোজা।
দাদা ছিলেন ঠাকুর মশায়
খড়ম পায়ে হাটতো বাসায়
জমিদারী ছিলোও বটে
ছিল আরো আশয়-বিষয়।
আমি কাল থেকে প্র্যাকটিস করছি। খারাপ না চলছে। অবশ্য বাইরে কোথায়ও যাচ্ছি না, শুধুই অফিসে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
কিছু কিছু খড়মে ওপরের বর্তুলাকার পা বন্ধনীটিও থাকতনা, শুধু বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ধরে রাখার মত একটি কাঠের পেরেকের মত থাকত। দেখে মনে হয় স্বাস্থ্যকর হলেও এটি পরে হাঁটা বেশ কঠিন এবং দক্ষতার বিষয় ছিল।
আমারও মনে হয় এগুলো পায়ে দিয়ে হাটা একটি শৈল্পিক ভাবের প্রয়োজন।
আমি তো নিজেই খড়ম পরছি। দুই ধরণের খড়মই পরেছি। একেবারে ছোটবেলায় রাবারের বেল্ট যা সাধারণত গাড়ির চাকার টিউব কেটে ফিতার মতো করে লাগানো ছিল ঠিক আপনার দেয়া ছহবির মতো। এটা পায়ে দিলে দুইটা শব্দ হয়। প্রথম শব্দ হয় মাটিতে পা পড়ার সাথে সাথে। এই শব্দটা মাটিতে কাঠের আঘাত করার জন্য তৈরী হয়। যখন পেছনের পা তুলে সামনে বাড়িয়ে দিতে যাবেন এমনি রাবারের বেল্টের টানে কাঠ খন্ডটি পায়ের তলায় আঘাত করে আরেকটা শব্দ বানায়। আমরা সাধারণত সন্ধ্যয় পুকুরে হাত পা ধুয়ে ও্জু করে ঘরে আসতাম খড়ম পায়ে দিয়ে। সে সময় সেন্ডেল বা জুতার প্রচলন তেমন ছিলনা।
কিছু বড়ো হয়ে খুঁটি যুক্ত খড়ম পরেছি। বড়ো চাচা ছিলেন গ্রামের মসজিদের ইমাম। তিনি খুঁটি ওয়ালা খড়ম পরতেন। ওটা অনেক উঁচু ছিল। অন্তত তিন চার ইঞ্চি পুরু কাঠের মাঝখানের অংশ কেটে বাদ দিয়ে সামনের এবং পেছনের দুই দিকের অংশ রেখে দেয়া হতো। বুড়ো এবং অনামিকা আঙুলের মাঝখানে একটা খুঁটি ঠিক লাটিমের মতো করে বাসিয়ে দেয়া হতো যা দিয়ে খড়মকে ধরা হবে। এই খড়ম পায়ে দেবার বায়না ধরলে প্রথমে দেয়া হয়নি কারণ ওটা পরে হাঁটতে পারবোনা বলে। যখন চাচার খড়ম পরে হেঁটে দেখালাম যে আমি পারি, তখন বাবা একটা ছোট খড়ম কিনে এনেছিলেন। তবে বেশীদিন পরা হয়নি কারণ এর মাঝেই দুই ফিতাওয়ালা স্পঞ্জের সেন্ডেল বাজারে এসে গেছে।
খুঁটি ওয়ালা খড়ম পায়ে দিলে নিজেকে মুরব্বি মুরব্বি মনে হতো। সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
আর এইটা আপনারটার ধরণ বলে মনে হচ্ছে-
চিঠি খানা এই হানে আগে দিলাম-
নানা ভাই
সালাম নেবেন। আমাদের এখন ছুটি। মাকে নিয়ে আপনার কাছে বেড়াতে যাব। আমাদের লাল মুরগী ডিম দিয়েছে। আটটা ফুটফুটে বাচ্চা হয়েছে। দেখতে খুব সুন্দর।
আমাদের পেয়ারা গাছে টুনটুনি বাসা বেধেছে। আমি আর আবু টুনটুনির গান শুনি। আবু একটু একটু পড়তে পারে।
আল্লাহর রহমতে আমরা ভালোই আছি। আপনি আর নানি ভালো আছেনতো? নানীকে ছালাম দেবেন।
আমিও দাদার খড়ম পায়ে দিয়ে কয়েক বার আছাড় খেয়েছি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন