ট্রাম্প কার্ড : গনতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী মাহমুদুর রহমান
লিখেছেন লিখেছেন আবু আশফাক ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৮:১৪:২৯ সকাল
২০০৪ সালে চারদলীয় জোটকে দিনক্ষণ বেঁধে ক্ষমতাচ্যুত করার আগাম ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীকে চমকে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। সেবারই প্রথম রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ট্রাম্প কার্ড শব্দটি সুপরিচিত হয়ে ওঠে। সে সময় মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় দু’ মাস ধরে নানারকম গুজব চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। গুজবগুলোর মধ্যে দু’টি সবচেয়ে আলোচিত এবং জনমনে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল। প্রথমটি জনৈক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বিএনপির এমপিদের মাথাপিছু এক কোটি টাকা দিয়ে কিনে পক্ষ ত্যাগ করাবেন এবং সংসদে ক্ষমতাসীনরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে। এ ধরনের গল্প বারবার কেন যে শুধু বিএনপি’র সম্পর্কেই ওঠে, সেটা পিএইচডি থিসিসের একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে।
আওয়ামী লীগের লোকজনকে এভাবে অনায়াসে কেনা যায়, এ রকম গুজব কিন্তু তেমন একটা শোনা যায় না। তারা সব সময় কেবল একটি দেশের কাছে বিক্রি হয়ে আছে। একমাত্র ব্যতিক্রম ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে প্রধানত আওয়ামী লীগের এমপিদের সমন্বয়ে সামরিক সরকার গঠিত হয়েছিল। তারপর মিজানুর রহমান চৌধুরী, কোরবান আলী এবং আবদুর রাজ্জাকদের দলত্যাগের ইতিহাস থাকলেও সেটি কখনও ব্যাপক আকারে দেখা যায়নি। এদের মধ্যে আবদুর রাজ্জাক তার আশির দশকে পুনরুজ্জীবিত করা নতুন বাকশালের সঙ্গী-সাথী নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই শেখ হাসিনার কাছে আত্মসমর্পণ করে আওয়ামী লীগে ফিরে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা এবং আবদুর রাজ্জাকের মধ্যকার ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক জোড়া লাগানোতে উভয়ের বিশেষ বন্ধু ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলেই দেশের জনগণ বিশ্বাস করে।
আর ড. কামাল হোসেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে রীতিমত অপমান করে দলত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। অথচ বিএনপিতে দলত্যাগ অনেকটা মড়ক লাগার মতো যখন-তখন ঘটে থাকে। ২০০৬ সালে সরকারের একেবারে শেষদিন পর্যন্ত মন্ত্রিত্ব, এমপিত্ব করে জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃবৃন্দ যেভাবে দল ছেড়েছিলেন, তার তুল্য সুবিধাবাদী উদাহরণ আমি অন্তত খুঁজে পাইনি। সর্বশেষ ১/১১’র রাজনৈতিক কুশীলবদের মূল হোতা মান্নান ভূঁইয়ার ক্যু-দেতা এতই সাম্প্রতিক যে, সে সম্পর্কে অতি দুর্বল স্মরণশক্তির বাঙালি মুসলমানকেও বোধহয় মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। এর অর্থ বিএনপি’র রাজনৈতিক দর্শন চর্চায় কোথাও নিশ্চয়ই মারাত্মক রকম গলদ রয়েছে। যাক সে প্রসঙ্গ। পরে কখনও সময় সুযোগমত এক এগারোর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এ বিষয়ে লেখা যাবে। আপাতত ট্রাম্প কার্ডে ফিরে যাচ্ছি।
২০০৪ সালে দ্বিতীয় যে গুজবটি সরকারকে বেজায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছিল সেটি হলো, বিরোধী পক্ষ রাজধানীতে দশ লাখ লোকের এক বিশাল সমাবেশ ঘটাবে যারা চারদলীয় জোট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত না করা পর্যন্ত শহর ত্যাগ করবে না। লোক আনার দায়িত্ব প্রশিকা নামের এনজিওকে দেয়া হয়েছে এমন একটি কথাও বাজারে বেশ প্রচলিত ছিল। দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে বন্দী বহুল বিতর্কিত বিএনপি নেতা এবং প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর তখনও বোধহয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একক দায়িত্ব পাননি। আলতাফ হোসেন চৌধুরী সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যে কারণেই হোক, ট্রাম্প কার্ড ঠেকানোর দায়িত্ব দেয়া হলো লুত্ফুজ্জামান বাবরকে। তিনি বাস, ট্রেন, লঞ্চ থেকে ঢাকায় পা দেয়া মাত্র যাত্রীদের নির্বিচারে আটক করে দেশব্যাপী মহা আতঙ্ক সৃষ্টি করলেন। জেলখানায় তিল ধারণের ঠাঁই থাকল না। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী অবস্থায় কারা রক্ষীদের কাছ থেকে শুনেছি, সেলে স্থান সংকুলান না হওয়ায় গ্রামের এসব অসহায় লোকজনকে নাকি এক রাত জেলখানার মাঠে খোলা আকাশের নিচে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। অবশ্য আবদুল জলিল ঘোষিত ট্রাম্প কার্ডের দিনটি পার হয়ে যাওয়া মাত্রই এরা সবাই ছাড়া পেয়েছিলেন। মাঝখান থেকে পুলিশ, কারারক্ষী ও নিম্ন আদালতের ব্যক্তিবর্গের আয়-রোজগার ওই ক’দিন বেশ ভালোই হয়েছিল।
৩০ এপ্রিল সরকারের পতনের দিন ধার্য ছিল। ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারকে বহাল তবিয়তে দেখতে পেয়ে সাংবাদিকরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি অম্লানবদনে বলেছিলেন, এখনও ২৪ ঘণ্টা বাকি আছে! পরে অবশ্য আওয়ামী লীগ এটাকে রাজনৈতিক কৌশল, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ইত্যকার কথা বলে পাশ কাটিয়েছে। আর ট্রাম্প কার্ডের ওপর ওভার ট্রাম্প করার সাফল্যে সেই যে বাবর মন্ত্রিসভার মহা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন, তার সেই স্থান চারদলীয় জোট সরকারের শেষদিন পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। অবশ্য, ফুল মন্ত্রী হতে না পারার মনোকষ্ট তিনি ভুলতে পারেননি।
যাই হোক, বাংলাদেশের চিহ্নিত ভারতপন্থী দলটি বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় ট্রাম্প কার্ড ব্যবহার করতে না পারলেও সরকারে থেকে সম্প্রতি এর চমকপ্রদ প্রয়োগ করেছে। তাদের ট্রাম্প কার্ডের ধাক্কায় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের সুখস্বপ্নে বিভোর বিএনপি ধরাশায়ী হয়ে এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শাহবাগ চত্বর ওরফে প্রজন্ম চত্বর, ওরফে জাগরণ মঞ্চ ওরফে শাহবাগ সার্কাস যে নামেই সেই ট্রাম্প কার্ডটিকে ডাকা হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে একটি কোণঠাসা, দুর্নীতিগ্রস্ত, অজনপ্রিয় সরকার এর ঘাড়ে সওয়ার হয়ে প্রবলভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ক’দিন আগে জনগণের জুতার আঘাতে লাঞ্ছিত যে সব মন্ত্রী রাস্তায় নামতে সাহস পাচ্ছিলেন না, তাদের রণহুঙ্কারে দিগ্বিদিক প্রকম্পিত হচ্ছে। আর বিএনপির আগে থেকেই ঘরে ঢুকে যাওয়া নেতৃবৃন্দ এখন শয়নকক্ষ ছেড়ে বসার ঘরে আসতেও সভয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন।
শাহবাগ আন্দোলনের স্ববিরোধিতার বিষয়টি খানিক পর্যালোচনা করে নেয়া যাক। মহাজোট সরকার ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী জনগণকে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মিথ্যা আশ্বাস দেয়া হলেও মাঠে নেমে যখন দেখা যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে তাদের সহযোগীদের ওই নামে বিচারে আইনগত বাধা রয়েছে, তখন নাম পাল্টে মানবতাবিরোধীদের বিচার শুরু হয়। যে কোনো বিচারের আগে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে তদন্ত করার প্রয়োজন পড়ে। সরকার সেই তদন্তের আগেই জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ২০১০ সালের জুন মাসের শেষদিকে একে একে বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় গ্রেফতার করে। পরে এদের সবাইকে মানবতাবিরোধী অপরাধে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তকারী দল গঠন করা হলেও প্রথমেই বিপত্তি বাধে। তদন্ত দলের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে আবদুল মতিন নিয়োগ পেলে ফাঁস হয়ে যায় যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে মুন্সেফ পদে চাকরি নিয়েছিলেন। পত্রপত্রিকায় এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হলে আবদুল মতিনকে তার পদ থেকে সরে যেতে হয়। অর্থাত্ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুই হয় বিতর্কের মধ্য দিয়ে। তদন্তকারী দলের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নিয়ে সরকারের মধ্য থেকেই যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। পরবর্তী সময়ে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে বিচারপতিরাও বিতর্কমুক্ত থাকতে পারেননি।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের গত শতাব্দীর নব্বই দশকে ঘাদানিকের গণআদালতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকায় দেশের অনেক বিবেকসম্পন্ন বিশিষ্ট আইনজীবী প্রথম থেকেই তার মনোনয়নে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। স্কাইপ কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে বিচারপতি নাসিম দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার কার্য সমাপ্তির প্রায় পূর্ব মুহূর্তে পদত্যাগে বাধ্য হন। অথচ সরকার তার নিয়োগের সময় অন্যায় জিদ না ধরে ন্যূনতম প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিলে পরবর্তী বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে পারত। বিচারপতি নাসিমের পদত্যাগের আগে একই ট্রাইব্যুনালের আর এক সদস্য বিচারপতি জহিরকে সরকার অপ্রকাশিত কারণে নিজেরাই পদত্যাগে বাধ্য করে। এই অবস্থায় সবার আগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার সরকারি উদ্যোগ ভেস্তে যায়। শেষ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল-২ পলাতক আসামি আবুল কালাম আযাদকে দিয়েই তাদের রায়ের বউনি করে। আসামির অনুপস্থিতিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে মহাজোটে আনন্দ-উল্লাসের সূচনা হয়। কিন্তু, প্রথম মৃত্যুদণ্ড পরিকল্পনামাফিক ঘোষণার পর গোল বাধল জামায়াতে ইসলামীর এসিস্ট্যান্ট জেনারেল সেক্রেটারি আবদুল কাদের মোল্লাকে নিয়ে। আবুল কালাম আযাদের মতোই তিনিও একই ট্রাইব্যুনালের বিচারে একটি অভিযোগে খালাস এবং অন্য অভিযোগগুলোতে দোষী সাব্যস্ত হন। সবাইকে বেশ অবাক করেই বিচারকগণ আবদুল কাদের মোল্লাকে চরম দণ্ড দানের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন।
ঘটনা না বুঝেই সরকারি দল আনন্দ-মিছিল শুরু করলেও তা দ্রুত থেমে যায়। দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ-জামায়াতে ইসলামীর আঁতাতের গুঞ্জন ওঠে। আবদুল কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার আগেই আরও এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যাওয়ায় গুজবের পালে জোর হাওয়া লাগে। প্রায় তিন বছর পর হঠাত্ একদিন জামায়াতে ইসলামীকে সারা দেশে পুলিশের প্রহরায় বিশাল সব মিছিল করতে দেখা যায়। ঢাকার রাজপথে পুলিশ এবং শিবির কর্মীদের মধ্যে রজনীগন্ধা ফুল বিনিময় হয়। জনগণকে গায়ে চিমটি কেটে বুঝতে হয় যে, তারা জেগে আছে না স্বপ্ন দেখছে। কাহিনীর পেছনের চিত্তাকর্ষক কাহিনীটি এবার বলে ফেলি।
রাজধানীতে জামায়াতে ইসলামীর ঘোষিত সমাবেশের পূর্ব রাতে ডিএমপি কমিশনার বিএনপির যুগ্ম সেক্রেটারি জেনারেল রিজভী আহমেদের কাছে জামায়াতে ইসলামীর নেতা হামিদুর রহমান আযাদ এমপির টেলিফোন নম্বর জানতে চান। বিস্ময়ে হতবাক রিজভী সেদিন ঢাকার পুলিশ কর্তাকে শুধু তার অজ্ঞতার কথাই জানাতে পেরেছিলেন। বিএনপির সাহসী তরুণ নেতাটি তখনই সরকারের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগের বিষয়টি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। আবদুল কাদের মোল্লার রায়ের ঠিক আগে সরকারের আচরণের এই অভাবনীয় পরিবর্তন কেবল হৃদয় পরিবর্তনের কারণে হয়েছে এমনটি ভেবে নেয়ার মতো নির্বোধ এ দেশে খুব বেশি নেই। রিজভী আহমেদ তার অফিস বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে আমার কুশল জানতে আমার দেশ অফিসে এলে গল্পটি তার কাছ থেকে সরাসরি শুনেছি। দুয়ে দুয়ে চার মিলালে কাদের মোল্লার দণ্ডাদেশ সরকার প্রধানের অগোচরে হয়েছে এই ধারণা একমাত্র অযৌক্তিক আওয়ামী দালাল ছাড়া কারও পক্ষে পোষণ করা অসম্ভব। অতএব শাহবাগের সমাবেশ সাধারণ জনগণের কিংবা তরুণ প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের অংশ হলে সেখানে জমায়েতকারীদের অনুযোগ-অভিযোগের তীরে প্রথমেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বিদ্ধ হওয়ার কথা ছিল। তার নামেও রাজাকারের স্লোগান ওঠা উচিত ছিল। অথচ সেখানে উল্টো চিত্র দেখা গেল।
সরকারবান্ধব তাবত্ মিডিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়লো একটি অনুল্লেখ্য জমায়েতকে মহিমান্বিত করার গুরুদায়িত্ব পালনে। খাদ্য, পানীয়, আনন্দ উপকরণের ছড়াছড়ি পড়ে গেল। নীতি ও আদর্শের ধ্বজাধারী একশ্রেণীর বাম তরুণরা লুটেরা, লুম্পেন, ভূমি দস্যুদের পাঠানো যাবতীয় খাদ্যসামগ্রী গো-গ্রাসে গলাধঃকরণ করতে করতে ‘গণবিপ্লবের’ প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। আড়ালের ইন্ধনদাতারা ঘন ঘন পলিটব্যুরোর বৈঠকে বসতে লাগলেন। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র নেমে গেল আন্দোলনকারীদের সহায়তা প্রদানে, আরাম-আয়েশের বন্দোবস্তে। এই প্রথম দেখলাম সরকার কিংবা এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে তরুণদের কোনো প্রতিবাদ, কোনো আন্দোলন হচ্ছে না। আমাদের তারুণ্যের সঙ্গে এ যুগের প্রজন্মের কোনো মিল খুঁজে পেলাম না। মহাজোটের সঙ্গী-সাথী আর স্বঘোষিত তরুণ প্রজন্মের নেতৃবৃন্দের এক এবং অদ্বিতীয় লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো দেশ থেকে সব ভিন্নমত বিতাড়ন। আবেগের জোয়ারে জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে অনেকে শাহবাগ পিকনিককে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করারও ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। একবিংশ শতাব্দীর মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা শহরে পুলিশি প্রহরায় নাচানাচি করছেন, গান গাইছেন, হাতে হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট ঘুরছে, রাত নামলে আলো-আঁধারিতে একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব বিনিময় হচ্ছে। এই পরিবেশের সঙ্গে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রের চার দশক আগের পাকিস্তানি বর্বরদের বিরুদ্ধে সেই অবিস্মরণীয় সংগ্রামের তুলনা শুনলে গা গুলিয়ে ওঠে, বমনেচ্ছা হয়।
এই প্রসঙ্গে আমার এক মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুর গল্প বলি। সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম মোয়াজ্জেম হোসেন। বুয়েটে আমরা শুধু সহপাঠীই ছিলাম না, শেরেবাংলা হলের উত্তর ব্লকের ৩১০ নম্বর ঘরে একসঙ্গে চার বছর কাটিয়েছি। মোয়াজ্জেমের বাবা নরসিংদী জেলার মনোহরদির প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। আমিও শিক্ষকের সন্তান, তাই বন্ধুত্বটা গাঢ় হতে সময় নেয়নি। মোয়াজ্জেম এইচএসসি পাঠরত অবস্থায় আঠারো বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। সেসব যুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে শেরেবাংলা হলে আমাদের কত রাত পার হয়ে যেত। মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার কষ্টের কাহিনী শুনে চোখের পানি আটকানো যেত না। পানির মতো ডাল দিয়ে কাঁকর ভর্তি ভাত খাওয়ার চেয়েও আমার বন্ধু মোয়াজ্জেম বেশি কষ্ট পেত একটু ঝাল খেতে না পাওয়ায়। কুপির তেলের খরচ বাঁচাতে শরণার্থী শিবিরে রাতের খাবার অধিকাংশ সময়ে অন্ধকারেই খেতে হতো। এক রাতে ডালের মধ্যে সবুজ মরিচ দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিল প্রচণ্ড ঝালভক্ত মোয়াজ্জেম। অনেক উত্সাহ নিয়ে সেই বস্তুতে কামড় বসাতেই বুঝতে পেরেছিল ওটা মরিচ নয়, সবুজ রংয়ের বেচারা ঘাসফড়িং গরম ডালে পড়ে মরে আছে। মোয়াজ্জেম আমাকে বলেছিল, দোস্ত এত কষ্ট লাগল যে তোকে বোঝাতে পারব না।
আমার সেই অন্ধ আওয়ামী লীগার বন্ধু দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে চাকরি করে। তার প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার জামানায় আমার ওপর নির্যাতনে মনে বড় কষ্ট পায়। দূরদেশ থেকে ফোন করে সেই কষ্টের কথা জানায় আর বলে সুযোগ পেলেই আমাদের মহানবী (সাঃ)-এর পবিত্র ভূমিতে নাকি আমার জন্য দোয়া করে। যে তরুণ প্রজন্ম ২০১৩ সালে শাহবাগে বন্ধু-বান্ধবীসহ আড্ডা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার গাল-গল্প ফাঁদছেন, তারা প্রকৃতপক্ষে শহীদ এবং জীবিত উভয় শ্রেণীর মুক্তিযোদ্ধাদেরই অপমান করছেন। ওখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসা তরুণ-তরুণীদের মাথা ঝাঁকিয়ে অসুস্থ মনের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই কোরাস গাওয়ার ভঙ্গি দেখলে কেন জানি না ছায়াছবিতে দেখা প্রেত সাধনার কথা মনে পড়ে যায়।
জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের অবশ্যই একটা ফয়সালা হওয়া দরকার। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ এই বিভাজন ষোল কোটি মানুষের এই দেশে আর চলতে দেয়া যায় না। জামায়াতে ইসলামী তার পাকিস্তানি আমলের দলীয় নাম নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন করে রাজনীতি শুরু করার আগে মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য জনগণের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলে এর একটা নিষ্পত্তি হয়তো বহু আগে হয়ে যেত। কিন্তু, তারা সেটি করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে মোটামুটি সমজাতিক জনগোষ্ঠীর দেশটিকে চাণক্য নীতি প্রয়োগে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশী সাফল্যের সঙ্গে আফ্রিকার হুতু-টুটসি অধ্যুষিত কঙ্গোর চেয়েও হিংস্রভাবে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এ ধরনের পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ নিয়ে প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে আমাদের টিকে থাকা সম্ভব নয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর চার দশকেরও অধিক সময় পার হয়ে গেলেও ইস্যুটির নিষ্পত্তি না হওয়াতেই রাজনীতিবিদরা শাহবাগের তরুণ প্রজন্মকে এতটা ভয়ঙ্করভাবে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার কেন হয়নি, সে সম্পর্কেও তাদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হয়েছে। ইতিহাসবিদরাও প্রকৃত ইতিহাস লেখার পরিবর্তে যার যার রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুযায়ী বিকৃত, বিকলাঙ্গ, মনগড়া ইতিহাসের জন্ম দিচ্ছেন।
এই সরকারের আমলে অপ্রত্যাশিতভাবে বিচারপতিরাও ইতিহাসবিদের ভূমিকা নিয়ে দেশকে অধিকতর সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ইতিহাস মিডিয়াবান্ধব না হলেও বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশের মিডিয়া বরাবরই আওয়ামী এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বামসমর্থিত সাংবাদিকদের দখলে। সুতরাং সেখানেও প্রতিনিয়ত সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ উদ্ধারে ইতিহাসকে অসত্য রূপে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আর রাজনীতি থেকে যাবতীয় আদর্শ তো দীর্ঘদিন আগেই উঠে গেছে। সুতরাং রাজনীতিবিদরা নিজ অথবা দলীয় স্বার্থের বাইরে সত্যনিষ্ঠ থাকবেন, এমন ভাবনা দুরাশা মাত্র। আমি প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বুয়েট এবং আইবিএতে করলেও সময় পেলেই ইতিহাস চর্চা করতে ভালোবাসি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে কিছুদিন থেকেই বেশকিছু বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে চলেছি। এই বিষয়ে এ পর্যন্ত যেসব তথ্য জোগাড় করতে পেরেছি তাতে পাকিস্তানের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়া এবং তাদের বাংলাদেশী সহযোগীদের ক্ষমা করার দায় প্রধানত মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানকেই বহন করতে হবে। এটাই প্রকৃত ইতিহাস।
আজ শুধু একটি উদাহরণ দিয়ে এ প্রসঙ্গ শেষ করব। শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতাকারী বাঙালি সামরিক অফিসারদের একজন লে. কর্নেল ফিরোজ সালাউদ্দিনকে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব পদে নিয়োগ দেন। (তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, এএসএম সামছুল আরেফিন) ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ এবং অপরাধীদের ক্ষমাবিষয়ক ইতিহাস চর্চা আজ এ পর্যন্তই। ইচ্ছে আছে সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে বিশদভাবে তথ্যভিত্তিক লেখালেখি করার। এ নিয়ে সবার মধ্যে একটি সুস্থ, নির্মোহ এবং তথ্যভিত্তিক বিতর্ক জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্যই করতে হবে। ফিরে যাচ্ছি ট্রাম্প কার্ডে।
আকণ্ঠ দুর্নীতি ও অপশাসনে নিমজ্জিত সরকার শাহবাগকে পুঁজি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিহীন একটি একতরফা নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুতের মরিয়া খেলায় লিপ্ত হয়েছে। সাংগঠনিক দুর্বলতা, গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দের সম্পদ রক্ষার আকুলতা, জেল-জুলুমের ভীতির কারণে বিএনপি আন্দোলনের মাঠ পরিত্যাগ করায় আওয়ামী লীগ সেই শূন্যতার পুরোপুরি সুযোগ নিয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টাবৃন্দ তাকে সম্ভবত বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত সহায়তা করতে সম্মত হলেই কেবল তিনি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। সে কারণে দলটির পুরো মনোযোগ বেশ কিছুদিন ধরে কেবল বিশ্ব ও আঞ্চলিক পরাশক্তির সন্তুষ্টি অর্জনের মিশনে কেন্দ্রীভূত রয়েছে। শেয়ারবাজারে কমপক্ষে এক কোটি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিএনপি এই অসহায় প্রতারিত মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়ায়নি। সরকারের শীর্ষ মহলের দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাইকা ঋণ প্রত্যাহার করে নিল। দক্ষিণের মানুষের এতদিনের স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটল, কিন্তু বিএনপি নির্বিকার। হরতাল দেয়া তো দূরের কথা, চোখে পড়ার মতো দেশব্যাপী বিক্ষোভ করা থেকেও তারা নিবৃত্ত রইল। মনে সর্বদা জুজুর ভয়, এই বুঝি যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচালের অভিযোগ উঠল। ভোটের অঙ্কে জামায়াতকে পরিত্যাগও করা যাচ্ছে না, আবার ওদিকে একসঙ্গে আন্দোলন করলে সতীত্ব নষ্ট হয়। এই দোটানায় বিএনপির অবস্থা না ঘরকা, না ঘাটকা। অথচ, জনগণ ও নিজেদের যুক্তিসঙ্গত ইস্যুগুলো নিয়ে রাজপথে ১৮ দল বাদ দিয়ে শুধু বিএনপি’র ব্যানারে আন্দোলন করলেই তো আর জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আওয়ামী লীগ তুলতে পারত না। আর তুললেও জনগণ সেটা প্রত্যাখ্যান করত। কিন্তু তার পরিবর্তে ঘরে বসে থাকার আত্মঘাতী নীতি সরকারকে যে সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে, বিশেষ রাষ্ট্রের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা তারই সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে। শাহবাগ আন্দোলনের সমাপ্তি এখন যেভাবেই হোক না কেন, তার লাভ পুরোটা আওয়ামী লীগের ঘরেই যাবে। এই অবস্থায় বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় অসম্ভব না হলেও নিশ্চিতভাবেই দুরূহ হয়ে পড়ল। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের ট্রাম্প কার্ড তামাশায় পর্যবসিত হলেও এবার আন্দোলন প্রশ্নে বিএনপি নেতৃত্বের দোদুল্যমানতায় সেটি কার্যকর হয়েছে।
শাহবাগ জমায়েতের প্রথম থেকেই আমি এটিকে সরকারের রিমোট কন্ট্রোলে পরিচালিত একটি ফ্যাসিবাদী আন্দোলন হিসেবেই দেখছি। ট্রাইব্যুনাল নিয়ে যে বিতর্ক আজ সৃষ্টি হয়েছে, তার সব দায় সরকারের হলেও কী চমত্কারভাবেই না শাহবাগ চত্বরে বিএনপি ও জামায়াতকে প্রতিপক্ষ বানানো হয়েছে। সরকারের অপদার্থতার সর্বশেষ উদাহরণ ২০০৯ সাল থেকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন। এই সংশোধনীর ফলে সরকার পক্ষও এখন ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করতে সমর্থ হবে। একটি চলমান মামলার একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে এভাবে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা নিয়ে আইন সংশোধন করায় নতুন করে বিতর্কের সুযোগ সৃষ্টি হলো। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আইনের এই সর্বশেষ সংশোধনীর প্রেক্ষিতে সমগ্র বিচার প্রক্রিয়াকেই উপহাস আখ্যা দিয়েছে।
আশির দশকের প্রারম্ভে শেখ হাসিনার রাজনীতি শুরু হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীকে মিত্র রূপে পাশে নিয়েই। শেখ হাসিনার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী এবং স্বৈরাচারী এরশাদের দহরম-মহরম নতুন কোনো ঘটনা নয়। ১৯৮৬ সালে তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ জাতির কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে অবৈধ এরশাদ সরকারকে বৈধতা দিয়েছিল। ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে একই শেখ হাসিনা একপাশে গোলাম আযম এবং অন্য পাশে এরশাদকে নিয়ে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। জামায়াতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনেই সরকার গঠন করেছেন। তাহলে শাহবাগের তরুণদের কণ্ঠে ‘শেখ হাসিনা তুই রাজাকার’ ধ্বনি আজ পর্যন্ত কেন উচ্চারিত হলো না? ফতোয়া চত্বর থেকে তারা তো যাকে তাকে তুই রাজাকার বলে অসম্মান করছে। এ কোন বিকৃত মানসিকতার তরুণ প্রজন্ম, যারা বয়স্কদের সম্মান করতে জানে না, ব্লগে অবিশ্বাস্য সব অশ্লীল বাক্য নির্দ্বিধায় লেখে, পিতা-মাতার ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে কুত্সা রচনা করে? এরাই নাকি জাতির সেই ভবিষ্যত্ যাদের নির্দেশে মন্ত্রী, এমপি, সচিবরা তিন মিনিটের জন্য রাস্তায় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
এদেশের বিচারপতিরা এতই সংবেদনশীল যে ভিন্নমতের লোকজনের লেখালেখিতে পান থেকে চুন খসলেই নাকি তাদের ইজ্জতের হানি ঘটে। আদালত অবমাননা নামক এক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের কালো আইনের যত্রতত্র প্রয়োগ করা হয়। শাহবাগের lynching mob-এর কণ্ঠে ফাঁসি চাই এবং জবাই করো মার্কা কুিসত হুঙ্কার প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা ধরে উচ্চারিত হওয়া সত্ত্বেও সেই আদালত এখন দেখেও না দেখার ভান করছেন। প্রধানমন্ত্রী নির্দ্বিধায় বলছেন শাহবাগের জনমতকে আমলে নিয়েই নাকি ট্রাইব্যুনালের রায় দিতে হবে। এই অনৈতিক ও বেআইনি দাবি সত্ত্বেও আদালত অবমাননা নাকি হচ্ছে না। দ্বিমুখী নীতির সব সীমা বাংলাদেশের বিচার বিভাগ লঙ্ঘন করেছে। সার্বিক অবস্থার ভয়াবহ অবনতিদৃষ্টে প্রধানমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠজন আইন-সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল চক্রবর্তী পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, চাপ প্রয়োগে রায় সমাজের জন্য ভালো নয়। আসক-এর প্রধান যে কতখানি সেক্যুলার সেটি তার নামের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। আমি আশ্চর্য হব না যদি শাহবাগ চত্বর থেকে এখন তাকেও রাজাকার হিসেবে ফতোয়া দেয়া হয়।
২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার খুনি বাপ্পাদিত্য বসু গত শুক্রবার আমাকেও খুন করার হুমকি দিয়েছে। ছাত্রলীগের পাণ্ডারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পিয়াস করীমসহ আমার পিঠের চামড়া তুলে নিতে চেয়েছে। এই বিধর্মী এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের কাছে কোরআন শরিফ থেকে কোনো উদ্ধৃতি দেয়া সেই পবিত্র গ্রন্থেরই অবমাননা। মহান ইংরেজ নাট্যকার শেক্সপীয়রের বইপত্র পাঠ করার বিদ্যাও এদের আছে কিনা আমার জানা নেই। তবু খুনের হুমকির জবাবে শেক্সপীয়রের অমর সৃষ্টি জুলিয়াস সীজার নাটকের একটি বাক্য উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। স্ত্রীর উদ্বেগের জবাবে অসীম সাহসের প্রতীক জুলিয়াস সীজার বলছেন,
Death, a necessary end,
Will come, when it will come.
(মৃত্যু, এক অবধারিত নিয়তি,
অবশ্যই আসবে, যখন তার সময় হবে)
আমি গভীরভাবে বিশ্বাসী মানুষ। এই ধৃষ্টতার জবাবে শুধু বলব, আল্লাহর নগণ্য বান্দা আমি; তিনি যখন, যেভাবে ডাকবেন আমি ব্যাকুল হয়ে বলব, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক।
আইনের শাসনের সব চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এই শাহবাগ উন্মাদনা সৃষ্টির অন্যতম রূপকার অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের পিতা পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছিলেন। তিনি একজন শহীদের গর্বিত পুত্র হওয়া সত্ত্বেও দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মামলায় আদালতের সমন পেয়েও কেন সরকার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে যাননি, সেই প্রশ্নের জবাবও আবেগের ঘোর থেকে মুক্ত তরুণ প্রজন্মের কাছেই তাকে একদিন দিতে হতে পারে। ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে প্রমাণ মিলবে যে শাহবাগ আন্দোলনের ভেতরে লুকায়িত রয়েছে চরম রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা এবং ফ্যাসিবাদের বীজ। দেশের সব মিডিয়া একজোট হয়ে একে মহিমান্বিত করার যতই চেষ্টা করুক না কেন, আমার একাকী অবস্থান থেকেই শেষ পর্যন্ত প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে যাব। এই পবিত্র কর্তব্য সাধনে মৃত্যুবরণ করতে হলেও তাকে আল্লাহ্র রহমত রূপেই বিবেচনা করব। কোনো চাপ অথবা হুমকির কাছেই আমার দেশ মাথা নত করবে না। এদেশের তরুণদের ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য বহুলাংশে দায়ী বহুজাতিক টেলিফোন কোম্পানিগুলো আমার দেশ পত্রিকায় কালে-ভদ্রের বিজ্ঞাপন প্রদানও বন্ধ করেছে। কোনো অসুবিধে নেই। পাঠকের অফুরান ভালোবাসাই এই পত্রিকাটিকে বাঁচিয়ে রাখবে। ইনশাআল্লাহ, মিথ্যাকে পরাজিত করে সত্যই শেষ পর্যন্ত আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হবে।
সর্বশেষ বলছি, অবিবেচক সরকার তরুণ প্রজন্মের ধ্বংসাত্মক আবেগকে উস্কে দিয়ে দেশকে এক ভয়ঙ্কর হানাহানির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই আত্মঘাতী খেলা থেকে নিবৃত্ত হওয়ার জন্য আবারও ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানাই। একশ্রেণীর মিডিয়াও বুঝে অথবা না বুঝে সমাজে চরম বিপর্যয়কর অস্থিরতা সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে। আশা করি, তারাও সার্বিক পরিস্থিতির অবনতিদৃষ্টে সতর্কতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সম্পাদকীয় নীতির পুনর্মূল্যায়ন করবেন। আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে গত দু’সপ্তাহের উন্মাদনার আশু সমাপ্তি টানা জরুরি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রে বিপর্যয় নেমে এলে আমরা কেউই রেহাই পাব না। ইতোমধ্যে অনেক রক্ত ঝরেছে। এখনও আমাদের সংবিত্ না ফিরলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করার দায় সবাইকেই নিতে হবে। ম্যাকবেথ নাটকে শেক্সপীয়র যেমন লিখেছিলেন Blood will have blood (রক্ত আরও রক্ত ঝরাবে)। এরপরও সরকার নির্বিকার থাকলে ধরে নিতে হবে ২০০৮ সালের আঁতাতের নির্বাচনের উদ্দেশ্যই ছিল আমার মাতৃভূমিকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া। জাতির সম্মিলিত বিবেকের কাছে তাই এই আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে সরে আসার আবেদন রেখে আজকের লেখার সমাপ্তি টানলাম।
বিষয়: বিবিধ
১৪৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন