নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসের ভাবনা : নারী নির্যাতনের কারণ ও প্রতিরোধে পুরুষের ভূমিকা
লিখেছেন লিখেছেন আবু আশফাক ২৪ আগস্ট, ২০১৩, ১১:৪৯:৩৫ সকাল
২৪ আগস্ট। আজ থেকে ১৮ বছর আগে ১৯৯৫ সালের এইদিনে দিনাজপুরে কয়েকজন বিপথগামী পুলিশ সদস্যের হাতে ধর্ষণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল কিশোরী ইয়াসমিন। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল দিনাজপুরের সর্বস্তরের জনতা। কিন্তু প্রতিবাদী জনতার ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে নিহত হন সামু, সিরাজ, কাদেরসহ সাতজন, আহত হন তিন শতাধিক মানুষ। তখন থেকেই দিনাজপুরসহ দেশব্যাপী দিবসটি ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
ফিরে দেখা
২৪ আগস্ট ১৯৯৫ সালের এই দিনে ঢাকা থেকে দীর্ঘদিন পর মাকে দেখার জন্য আকুল হয়ে দিনাজপুরে বাড়ি ফিরছিল কিশোরী ইয়াসমিন। কিন্তু দিনাজপুরের কোচে না উঠতে পেরে সে পঞ্চগড়গামী একটি কোচে ওঠায় কোচের লোকজন তাকে দশমাইল নামক স্থানে নামিয়ে দিয়ে সেখানকার চায়ের দোকানে জিম্মায় দেয়। নিরাপদ ও রক্ষক ভেবে ইয়াসমিনকে দিনাজপুর শহরে মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য কাকডাকা ভোরে পুলিশের হাতে তুলে দেয় দশমাইলের লোকজন। কিন্তু রক্ষক হয়ে পুলিশ ভক্ষক সেজে পথিমধ্যে কিশোরী ইয়াসমিনকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে হত্যা করে। পুলিশ ইয়াসমিনের লাশ দিনাজপুর শহরে থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ব্র্যাক অফিসের পাশে রাস্তায় ফেলে চলে যায়।
পরের দিন পুলিশের এ পৈশাচিক ঘটনা জানাজানি হলে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা শহরে প্রতিবাদ মিছিল বের করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। কিন্তু তত্কালীন পুলিশ প্রশাসন ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে উল্টো নিষ্পাপ কিশোরী ইয়াসমিনকে পতিতা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করে। এতে আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে প্রতিবাদী জনতা। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ। বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর লাঠিচার্জ করে। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ২৬ আগস্ট রাতে বিক্ষুব্ধ জনতা কোতোয়ালি থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করতে থাকলে পুলিশ আবারো তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। ২৭ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতা একে একে রাজপথে নেমে এলে মারমুখী পুলিশ শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ৭ জনকে।
নারী নির্যাতনের কারণ
আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে। নির্যাতিত হওয়ার কারণ গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যৌতুক। যদিও আমরা ঘটা করে প্রচার করছি যৌতুক একটা সামাজিক ব্যাধী। যৌতুক নেওয়া বা দেওয়া দুটোই অপরাধ। কিন্তু আমাদের প্রচার প্রচারণা আদেৌ সুফল বয়ে আনছে কি? বরং দেখা যাচ্ছে- অভিভাবকেরা মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। মেয়ের সুখের জন্য যৌতুক দিতে বাধ্য হচ্ছে বাবা। যৌতুকের টাকা হাতে না পেলে কিছু পশু স্বভাবের পুরুষ স্ত্রীকে বেদম ভাবে প্রহার করছে। কখনও বা হিতাহিত জ্ঞান শুণ্য হয়ে স্ত্রীর মুখে এসিড মারতেও দ্বিধা করছেনা।
দ্বিতীয়ত, কারো ভালোবাসার ডাকে সাড়া না দিলেও নারীকে হতে হচ্ছে লাঞ্চিত। স্কুল কলেজগামী মেয়েরা ইভটিজিং এর শিকার হচ্ছে। পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং ধর্মীয় শিক্ষার অভাবেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষের করণীয়
আমরা কাকে নির্যাতন করছি? নারী কি শুধুই নারী? না, এই নারী শুধুই নারী নয়। এই নারী সময়ের পরিবর্তনে আমাদের মা, বোন , মেয়ে এবং কখনো জীবন সঙ্গীনী। এই সম্পর্কগুলোর কোনটি কোনটা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এই নারীই যখন হয় লাঞ্চিত, অপমানিত তখন সেই অপমানের কিছুটা অংশ আমাদের অস্তিত্বেও এসে লাগে। আর যদি না লাগে তাহলে ধরে নিতে হবে আমরা আর রক্ত মাংসের শরীরে মানুষ নেই। মনুষত্বহীন অমানুষে পরিনত না হলে এমনটি হওয়া সম্ভব নয়। নারী নির্যাতন বন্ধে আইন ছিল, আইন আছে এবং আরও নিত্য নতুন আইন প্রনয়ন হবে। কিন্তু তাতেকি নারী নির্যাতন বন্ধ হবে। এটা স্পষ্ট করে বলা যায় এতেই নারী নির্যাতন বন্ধ হবেনা। শুধু সরকারী উদ্যোগে এবং নারীদের নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিই নারী নির্যাতন রোধে যথেষ্ট নয়। এ জন্য মূলত এগিয়ে আসতে হবে পুরুষকে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের মিছিলে সবার অগ্রে থাকা চাই পুরুষের । নারী নির্যাতিত হচ্ছে পুরুষের মাধ্যমে আর তাই নারী নির্যাতন রোধে পুরুষই পারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে। দেশে নারী নির্যাতন হচ্ছে, আবার এর রিরুদ্ধে মামলাও হচ্ছে। কিন্তু তাতে কি নির্যাতন হ্রাস পাচ্ছে? যদিও আমাদের মাননীয় আইনমন্ত্রীর ভাষায়- বেশিরভাগ নারী নির্যাতনের মামলাই মিথ্যা। তাই মামলা আর শাস্তি নয়, বরং পুরুষের সদিচ্ছাই পারে নারীকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে। এজন্য পুরুষকে যা করতে হবে তা হলো-
দায়িত্ব নিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা।
যৌতুক বিরোধী আন্দোলন জোরদার করা এবং যৌতুক দেওয়া নেওয়া দুটোই অপরাধ জনগণকে তা তুলে ধরা ও যৌতুক না নেয়ার এবং না দেয়ার প্রতিজ্ঞা করা।
ভিকটিমকে আইনী সহায়তার পাশাপাশি সমঝোতা এবং আলোচনাকে প্রাধান্য দেওয়া। পরিবারের কোন বিষয়ে একাই সিদ্ধান্তের অধীকারী এই মনোভাব পরিত্যাগ করে নারী পুরুষ মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাস সৃষ্টি করা।
সমাজে ধর্মীয় শিক্ষা প্রসার ঘটানো এবং নারীদের মর্যাদা এবং অধিকার কতটুকু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা।
নির্যাতনকারীকে চিহ্নিত করে আইনের হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর হওয়া, যদিও সে হয় আপনজন।
সামাজিকভাবে নির্যাতনকারীকে বয়কট করে তাকে তার কর্ম সম্পর্কে আত্মউপলব্দিতে বাধ্য করা।
আসুন,
নারী নির্যাতনকে না করি, নিজে নির্যাতন থেকে বিরত থাকি, অন্যকেউ বিরত রাখতে সচেষ্ট হই।
বিষয়: বিবিধ
৪৭১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন