আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে খাপ খাওয়াতে হাদিসের ‘যুগোপযোগী’ সংকলন করছে তুরস্ক?

লিখেছেন লিখেছেন আবু আশফাক ২৯ মে, ২০১৩, ১১:১৯:৪১ সকাল



একুশ শতকের তুর্কি প্রজন্মের উপযোগী বলে দাবি করা একটি হাদিস সংকলন প্রকাশ করতে যাচ্ছে তুরস্ক। আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত তুর্কিরা বুঝতে পারবে এবং তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে এমন দাবি তুলে এই সংকলনে কয়েশ হাদিস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

একশ ধর্মতাত্ত্বিক ছয় বছর ধরে কাজ করে প্রায় ১৭ হাজার হাদিসের মধ্যে তাদের বিবেচনায় সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাদিসগুলো বেছে নিয়েছেন বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। বাছাই করা এই কয়েকশ’ হাদিস সাত খণ্ডের বিশ্বকোষ ধরনের একটি সঙ্কলনে স্থান পেয়েছে। সংকলনটির নাম রাখা হয়েছে “হাদিসের আলোকে ইসলাম”।

এ প্রসঙ্গে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় ধর্ম সংক্রান্ত পরিষদের (দিয়ানেত) সহসভাপতি ও হাদিস প্রকল্পের পরিচালক মেহমেত ওজাফসার বলেন, “আমরা আর বিশ শতকে বসবাস করছি না। এ কারণেই বর্তমান সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামী বিশ্বাসগুলো নিয়ে নতুনভাবে কাজ করা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।”

প্রচলিত অন্যান্য হাদিস সংস্করণগুলো থেকে এটি আলাদা। এতে আধুনিক তুর্কিদের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হাদিসগুলো নির্বাচন করা হয়েছে এবং সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই এগুলোর ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে দাবি করছে দিয়ানেত।

এতে হাদিসগুলোকে বিষয় অনুযায়ী বিভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এগুলোর শেষে সংক্ষিপ্ত পরিসরে ওই হাদিসে কি বলা হয়েছে তা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটসহ তুলে ধরে বর্তমান পরিস্থিতিতে এগুলো কি অর্থ বহন করে তাও বর্ণনা করা হয়েছে।

দিয়ানেতের পররাষ্ট্র বিষয়ক বিভাগের মহাপরিচালক মেহমেত প্যাকাসি বলেন, “মুসলমানদের শুধু কোরআনের কোনো উদ্ধৃতি বা হাদিসের একটি সংকলন খুলে নবীজী কি বলেছেন তা দেখে বলা উচিত নয়, ‘হা! এই বিষয়ে তাহলে এই করণীয়’। আমরা যদি শুধু এরকমই করি তাহলে তা হবে অজ্ঞতা ও অন্ধ অনুকরণ।”

“দুভার্গ্যজনকভাবে মুসলমান বিশ্বে আমাদের মধ্যে এ ধরনের অজ্ঞতা আছে,” বলেন তিনি।

তুরস্কের “আঙ্কারা ধারা” নামে পরিচিত ধর্মতাত্ত্বিকরা এ প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সপ্তম শতকের আরব সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি হওয়া হাদিসগুলোর মধ্য থেকে ‘সর্বকালের উপযোগীগুলো’ বেছে নেয়ার জন্য সাম্প্রতিক দশকগুলোতে প্রকাশিত ইসলামী ধর্মগ্রন্থগুলো তারা বারবার পড়ে দেখেছেন।

এই ধর্মতাত্ত্বিকরা ঐতিহ্যগত মুসলমান পণ্ডিতদের মতো নন। তারা আধুনিক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত। চলমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খ্রিস্টানরা তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের বাখ্যা কিভাবে করেছে তা বোঝার জন্য এদের কেউ কেউ পশ্চিমে গিয়েও পড়াশোনা করে এসেছেন।

নিজেদের কাজকে তারা চিহ্নিত করেছেন ‘রক্ষণশীল আধুনিকতা’ বলে। এটি সুন্নি ইসলামের এমন একটি ধারা যা ইসলামের মূল ধারাগুলোর ওপর আস্থা স্থাপন করে এর কঠোর আক্ষরিক দৃষ্টিভঙ্গির ধারাটিকে অস্বীকার করেছে। মুসলিম বিশ্বের অনেক অংশেই কঠোর আক্ষরিক দৃষ্টিভঙ্গির গোঁড়া মতবাদের প্রচলন আছে।

“মুসলমান বিশ্বে ধর্ম নিয়ে অনেকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, এখানে কেউ কেউ খুব বদ্ধ-মানসিকতার। কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতির বিষয়ে তুরস্কের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী আছে, যা অনেকের চেয়েই আলাদা,” বলেন প্রকল্প পরিচালক ওজাফসার।

সবুজ প্রচ্ছদে বাধাঁই করা প্রথম ছাপানো এ সংকলনের একটি সংস্করণ প্রদর্শন করে কর্মকর্তারা জানান, এতে নারীর অধিকারের মতো বিষয়সহ আলোচিত সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে, তবে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়নি।

“লিঙ্গ বৈষম্য, শাস্তি ও জিহাদের মতো বিষয়গুলোর উত্তর দেয়া এ সংকলনের উদ্দেশ্যে নয়,” বলেন প্যাকাসি।

এ সংকলনে নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে প্রথমেই একটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে- জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। এরপর একই বিষয়ে আরো কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে।

এর ব্যাখ্যা ও আলোচনায় বলা হয়েছে, সব মুসলমানের জন্য জ্ঞানার্জন ফরজ, তাই নারীদেরও শিক্ষার অধিকার রয়েছে।

অন্য একটি অংশে নারী অধিকার সম্পর্কে আলোচনায় বলা হয়েছে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদীনা শাসনকালে নারীরা মসজিদে যেতে পারতেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারতেন।

এ প্রসঙ্গে প্যাকাসি বলেন, “সামাজিক জীবনের সব অংশেই তাদের উপস্থিতি ছিল।”

হাদিসে উল্লেখিত বিভিন্ন শাস্তি, যেমন চুরির জন্য হাত কেটে নেয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গে সপ্তম শতকের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে ওই সময়ে এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। তবে বর্তমানের পরিবর্তিত পরিস্থিতে এগুলো আর প্রযোজ্য নয় বলেও মন্তব্য করেন ওজাফসার।

“নবীজীর আমলে এগুলো প্রচলিত ছিল কারণ তখন সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এগুলোর প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে আমাদের সামাজিক পদ্ধতি সপ্তম শতকের মতো নয়। তাই আমরা বলতে পারি, এই আইন এবং শাস্তি ঐতিহাসিক,” বলেন তিনি।

“আলেমদের এতো বেশি সংখ্যক হাদিস ব্যবহারেও পক্ষে নই আমরা,” বলেন আঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক সাবান আলি দুজগুন।

তিনি মনে করেন, এখন থেকে তুরস্কের ইমামদের এই হাদিস সংকলনটিই ব্যবহার করা উচিত এবং এর থেকেই সমাধান দেয়া উচিৎ।

তুরস্কের এই হাদিস সংকলন আরব বিশ্বেও যথেষ্ট কৌতুহলের সৃষ্টি করেছে।

এ প্রসঙ্গে মিশরের শীর্ষ মুফতির উপদেষ্টা ইব্রাহিম নিজাম বলেন, “তুর্কি মডেলটিতে মিশরের বুদ্ধিজীবীরা খুব আগ্রহী। এটি শুধু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে নয়, মধ্যপন্থী ধর্মীয় ভাবধারার কারণেও।”

তুরস্ককে ওহাবি-সালাফি মতবাদের বিরুদ্ধ মতবাদের উৎস হিসাবে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

আগামী রোজায় ‘হাদিসের আলোকে ইসলাম’ সংকলনটি প্রকাশ পাবে বলে জানা গেছে। বর্তমানে এর মুদ্রণের কাজ চলছে।

তুরস্ক একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং গতিশীল অর্থনীতির দেশ। দেশটির মসজিদগুলোতে নারী ইমাম যেমন আছেন, তেমনি বড় বড় শহরগুলোতে নারী মুফতিও আছেন। তবে দেশটির শাসনভার ইসলামপন্থী একটি দলের হাতে।

সংগৃহীত

বিষয়: বিবিধ

১৮৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File