শয়তানের সাংবাদিকতা
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ মাহবুব হাসান ২৭ অক্টোবর, ২০১৩, ০৫:০১:৪৬ বিকাল
ইবলিশ শয়তানের মেজাজ খারাপ। বয়স হয়েছে। এই রকম একটা গ্লোব্যাল এম্পায়ারকে ফিজিক্যালি মেইনটেইন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে সে ঠিক করলো যে সে একটা দৈনিক পত্রিকা বের করবে। ঘৃণা আর বিদ্বেষের বীজ বপনের এর চেয়ে ভালো কোনও উপায় নেই। তার উপর আত্মপক্ষ সমর্থনও করা যাবে, আবার বিরোধীদের আচ্ছাসে গালাগালিও করা যাবে।
ইবলিশ যেহেতু খুব মেথডিক্যাল সে ঠিক করলো যে প্রথমে পৃথিবীর সবচেয়ে নটোরিয়াস পত্রিকায় শিক্ষানবীশ হিসেবে কিছুদিন কাজ করবে। মোটামুটি অভিজ্ঞতা হয়ে গেলে তারপর নিজেই একটা পত্রিকা বের করবে। বন্ধু রুপার্ট মার্ডকের সাথে কথা বলে সে প্রথম ব্রিটেনে 'দ্য সান' পত্রিকার সম্পাদকের সাথে দেখা করতে গেল। রিসেপশনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতেই লাস্যময়ী রিসেপশনিস্ট তাকে সরাসরি সম্পাদকের খাস কামরায় নিয়ে গেল। তাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে জড়িয়ে ধরলেন সম্পাদক ডেভিড ডিনস্মোর। নিজে চেয়ার টেনে দিয়ে বসিয়ে দিলেন ইবলিশকে।
নিজের চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে ডেভিড বললেন, "স্যাটান ওল্ড চ্যাপ হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?"
ইবলিশ বললো,"লুক ডেভিড, আমি একটা পত্রিকা বের করতে চাই। আমি চাই তুমি আমাকে কাজ শেখাও। লোকমুখে শুনেছি তুমিই পৃথিবীর সবচেয়ে নটোরিয়াস পত্রিকাটা চালাও।"
সব শুনে ডেভিড বললো, "সব ঠিকই আছে স্যাটান। কিন্তু একমাত্র লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের সমর্থকরা ছাড়া কেউ আসলে আমাদের ততটা ঘৃণাও করেনা। সত্যি কথা বলতে কি সেলেব্রেটিদের আপত্তিকর ছবি আর গসিপ ছাপিয়েই আমরা চলি। ইন ফ্যাক্ট যাদের ছবি ছাপাই তাদের ৯৫%ও সেই ছবি ছাপাতে আপত্তি করেনা। সেলেব্রেটিদের মধ্যে একটা কথাও প্রচলিত আছে যে সান পত্রিকায় আপত্তিকর ছবি না ছাপা হলে কেউ আসলে সেলেব্রেটিই না। তার উপর যে যাই বলুক আমাদের এখানে লোকদেখানো হলেও একটা কোড অফ ইথিক্স মেনে কাজ করতে হয়, তাই অনেক মজার মজার আইডিয়া আমরা কাজেও লাগাতে পারিনা।"
"তাহলে কি করা যায় ডেভিড? আমিতো এমন একটা পত্রিকা খুঁজছি যেখানে ইচ্ছেমতন কেবল ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়ানো যাবে। নৈতিকতা, ইথিক্সের কোনও বালাই থাকবে না, কিন্তু সবাই পড়বেও। "
"দ্যাখো স্যাটান এরকম একটাই পত্রিকাই বিশ্বে আছে। সেটা বাংলাদেশে। নাম তার 'প্রশম আলো'। ওটা চালায় মতিলাল বলে এক লোক। তুমি তার সাথেই দেখা করো। পত্রিকার নাম শুনেই বুঝতে পারছো জ্ঞানের বা তথ্যের আলোকে প্রশমিত করাই এদের কাজ।"
"থ্যাংকস্ ডেভিড।"
"ওহ্ নো নো ... প্লেজারস অল মাইন ... তোমাকেতো আসলে কোনও হেলপ্ই করতে পারলাম না ... উড ইউ লাইক এ কাপ অফ আর্ল গ্রে টি?"
"নো থ্যাংকস্ ডেভিড। তাড়া আছে। আরেকদিন হবে।" এই বলে ইবলিশ বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঝড়ের বেগে সে কারওয়ান বাজারে 'প্রশম আলো' কার্যালয়ে হাজির হলো। ওখানে প্রথমেই তার দেখা বিশিষ্ট মতিয়াল আনিশূলের সাথে। "আরে! এই লোকই না কী যেন একটা প্যারডি করে একটা লেখা লিখেছিল ... যাক্ ডেভিডতো আমাকে আসল জায়গাতেই পাঠিয়েছে দেখছি" বলে মনে মনে ডেভিডকে একটা ধন্যবাদ দিল ইবলিশ।
আনিশূলকে তার পরিচয় দিতে আনিশূল বললো, "স্যরি, ইবলিশ ভাই। মনে কিছু নেবেন না আপনাকে যে একটু অপেক্ষা করতে হবে।"
বিরক্তমুখে ইবলিশ বললো, "আপনি আমাকে চিনেছেনতো?"
"জ্বি ভাই চিনেছি। কিন্তু এই মুহূর্তে আপনার চেয়ে বড় শয়তান মতি ভাইয়ের রুমে আছে। তাই আপনাকে ভেতরে নিতে পারছিনা।"
"কে সে? কে আমার চেয়ে বড় শয়তান?"
"ভাইজান, ভিতরে ভাঁড়তীয় রাষ্ঠ্রদূত আছেন।"
আনিশূলের এই কথা শুনে চুপসে গেল ইবলিশ। আসলেই এই মতিয়ালটাতো ঠিকই বলেছে। গোটা বিশ্বের এই অংশটাতে তার নিজের চেয়ে এদের প্রতিপত্তিই বেশি। যাইহোক কী আর করা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই দেখে সে ওয়েটিং রুমে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। সামনে রাখা পত্রিকার কপিগুলো উল্টোতে উল্টোতে, পরতে পরতে ছড়ানো ঘৃণাকে উপভোগ করতে করতে কীভাবে যে সময় পার হয়ে গেল সে নিজেও টের পেলনা।
কয়েক ঘন্টা পর ওয়েটিং রুমের দরজা ফাঁক করে উঁকি দিল আনিশূল। কাঁচাপাকা গোঁফের ভেতর থেকে একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বললো, "চলুন ইবলিশ ভাই। মতিভাই এখন ফ্রি। উনি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।"
আনিশূল ইবলিশকে মতিলালের রুমে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিল। পর্থম দেখাতেই তার মিষ্টি কথা আর অমায়িক ব্যবহার দিয়ে ইবলিশের মন জয় করে নিলেন মতিলাল।
কুশলাদি বিনিময়ের পরে জিজ্ঞেস করলেন, "বলুন ইবলিশ ভাই। আপনার জন্যে আমি কি করতে পারি?"
"মতিভাই আমি সাংবাদিকতা শিখতে চাই। কেউ যেন কোনও দিনও বলতে না পারে, আমার কোনও পেপার নাই।"
"আচ্ছা আচ্ছা! আসলে ব্যাপারটা কি হয়েছে বুঝলেন আমরা অলরেডি ওভারস্টাফড ... উইথ সাহিত্যিকস্ আই মিন। এমন এক অবস্থা যে সাহিত্যিকদের দিয়েই রিপোর্টিং চালাতে হচ্ছে আরকী। যাইহোক আপনাকে খালি হাতে ফেরাতে পারবনা। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা বহুদিন অপেক্ষায় ছিলাম কোনদিন আমরা আপনার চোখে পড়ব। আপনার আসাটা এবং আমাদের সাথে কাজ করতে চাওয়াটা যে আমাদের জন্যে কি বড় পাওয়া সেটা কোনওভাবে বোঝাতে পারবনা। এখন কাজের কথায় আসি। আমাদের একটা খুব চ্যালেঞ্জিং কাজের জন্য মানুষ প্রয়োজন। ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং। আন্ডারকাভার জব। ছদ্মবেশ ধরার ব্যাপার আছে। একটা জঙ্গী গোষ্ঠীকে ইনফিলট্রেট করতে হবে, আপনি কি ইন্টারেস্টেড?"
"অফকোর্স" উৎসাহে চেঁচিয়ে উঠল ইবলিশ।
"ওকে ওকে। এতটা উত্তেজিত হওয়ার কারণ নেই। আপনি একটু ছদ্মবেশ নিয়ে দেখাতে পারবেন কি? ধরে নেন এইটাই আপনার ইন্টারভিউ।"
"কোন ব্যাপ্পার!"
"গ্রেট! একটা মিনিট। আমাদের চীফ ফটোগ্রাফারকে ডাকি। ওর আবার জঙ্গীদের ব্যাপারে বিরাট অভিজ্ঞতা। যেকোন জায়গাতেই জঙ্গী খুঁজে পাওয়ার অসাধারণ গুণের জন্যেই তাকে আমরা রেখেছি।" এই বলে ফোন তুলে আনিশূলকে বললেন ধেঁড়ে ফটোমতিয়ালকে ভেতরে পাঠানোর জন্য।
"তো ইবলিশ ভাই আপনার কাছে কি কোন সাজসজ্জা ..."
"মতিভাই আপনি আমাকে আন্ডারএস্টিমেট করলেন ..." এই বলে এক সেকেন্ডের মধ্যে সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামা, মাথায় টুপি, গালভর্তি দাড়ি নিয়ে এক বেশ ধরল ইবলিশ।
"বাহ্! ইবলিশ ভাই। ওয়েল ডান। এই যে শহিধূল তুমি এদিকে এসোতো ... ভাইকে কী জঙ্গী দেখাচ্ছে? কী মনে হয়?" বলে ফটোমতিয়ালের দিকে ইশারা করলেন।
"দেখুন মতিভাই! পারর্ফেক্ট ... এস্পেশিয়ালি দাড়িটা ... !" তড়িৎ একটা স্ন্যাপ তুলে ক্যামেরার স্ক্রিনটা মতিলালকে দেখিয়ে বললো শহিধূল।
"আসলেইতো! ইবলিশ ভাই ইওর ইন। খালি একটা ব্যাপার ...।"
"কী ব্যাপার মতিভাই?"
"যেহেতু এটা একটা ডেঞ্জারাস মিশন, আমরা জাস্ট শিওর হইতে চাইছি যে জঙ্গীরা যদি আপনার আসল পরিচয় জেনে যায় তাহলে আপনি নিজেকে ডিফেন্ড করতে পারবেন কি না?" এই বলে চোখের ইশারায় শহিধূলকে বাইরে যেতে বললেন তিনি।"
"হাহ্ মতিভাই আপনি আবারও আমাকে আন্ডারএস্টিমেট করলেন। একটু আমার সাথে আসেন ..."
"কই আসবো?" একটু নার্ভাস হয়ে বললেন মতিলাল।
"আরে একটু জানালার কাছে আসেন।"
"আচ্ছা।" বলে দুরুদুরু বক্ষে গুটিগুটি পায়ে জানালার দিকে এগোলেন মতিলাল। আজকাল নিজের শত্রু সংখ্যা এতই বেড়েছে যে জানালাটানালার কাছে যাওয়াটাও বিপজ্জনক।
"ঐ যে নিচের গাড়িগুলো দেখতে পাচ্ছেন? এখান থেকে দাঁড়িয়েই আমি কিন্তু চাইলে সবকটাকে ভস্মীভূত করে দিতে পারব।"
"সিরিয়াস?"
"আপনি কিন্তু আমাকে আবারও আন্ডারএস্টিমেট করলেন মতিভাই। আই এম নট ইউজড টু ইট।" বিরক্তমুখে বললো ইবলিশ।
"দুঃখিত ইবলিশ ভাই। মাফ করে দেন। আচ্ছা সবকটা গাড়ি জ্বালিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই। ঐ যে বামদিক থেকে তিন নাম্বার সাদা গাড়িটা দেখছেনতো? বেশ দুরূহ এঙ্গেলে রাখা। ওটা জ্বালিয়ে দিলেই বুঝব আপনি তৈরি। ধরে নেন এইটাই আপনার ফাইন্যাল ইন্টারভিউ।"
"হাহাহাহা এটা কোনও ব্যাপার।" এই বলে আঙ্গুল দিয়ে একটা টুসকি বাজাতেই ঐ গাড়িটা বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে গেল।
"ওয়াহ্! ইবলিশ ভাই! আই এম রিয়্যালি ইম্প্রেসড্। নাও ইওর এ মেম্বার অফ দ্য 'প্রশম আলো' ফ্যামিলি! এই সপ্তাহটা আমরা একটা ব্রেকিং নিউজ নিয়ে বিজি আছি। আগামী সপ্তাহ থেকেই আপনি জয়েন করবেন।" বলে আবেগাপ্লুতভাবে ইবলিশকে জড়িয়ে ধরলেন মতিলাল।
অনেক কষ্টে মতিবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে, বিদায় নিয়ে বাইরে এলো ইবলিশ। খুশিতে ডগমগ হয়ে, লাস ভেগাসে এখন সকাল দেখে নিমিষেই গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের বলরুমে এক ড্যান্স পার্টিতে চলে গেল। আর অনেক রাত ধরে পার্টিতে মৌজমাস্তি শেষে হোটেলের প্রেসিডেনশিয়াল স্যুটের নরম বিছানায় আরামের ঘুম দিল। ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময় 'প্রশম আলো'র হেডিং দেখেই বিষম খেল সে।
পত্রিকায় বিশাল হেডিং: 'প্রশম আলো' সম্পাদকের উপর জঙ্গী হামলা। গাড়িতে আগুন, ড্রাইভার নিহত। নিচে গতকাল শহিধূলের তোলা তার ছবি আর ঠিক বিস্ফোরণের সময় তোলা গাড়ির একটা ছবি
(ফেসবুকার Nayel Rahman-এর স্ট্যাটাস হুবহু কপি)
বিষয়: বিবিধ
১৩১৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন