কাশ্মিরি নেতা আফজাল গুরুর মৃত্যুদণ্ড : ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের মুসলিম নিধন

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ মাহবুব হাসান ০৯ আগস্ট, ২০১৩, ০১:১৫:৫০ রাত



দেশ আবি শরমিন্দা হ্যায়, আফজাল আভিভি জিন্দা হ্যায়’- বিদ্রুপাত্মক এ ছন্দটি ভারতের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল ‘বিজেপি’র নির্বাচনী স্লোগান ছিল। জগতসেরা ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত- এটাই আন্তর্জাতিক মিডিয়াকুল এবং ‘'রাঘববোয়ালসমগ্র’'দের স্বীকৃতি। যে রাষ্ট্র একজন শীর্ষস্থানীয় মুসলিম নেতাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাতে পারে। টুপি পরিহিত শ্মশ্রুমণ্ডিত ধর্মীয় নেতা আফজাল গুরুকে অকারণে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাতে পারে। যে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে নির্দোষ মুসলিম নেতাকে ফাঁসি দেবার মতো অযৌক্তিক দাবি সংশ্লিষ্ট থাকে- গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা সে দেশের কোথায় বিদ্যমান, কোনাকাঞ্চি তদবির-তালাশেও তা আমি খুঁজে পাই নি।

আদালত জেনেবুঝেই আফজাল গুরুকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসির রায় দিয়েছে। রায়ে আদালত পরোক্ষভাবে তা স্বীকারও করেছে। সরকার-আদালতের যোগসাজশেই এমন অবিচার এখানে হয়েছে- কথাটি ম্যান বুকার পুরষ্কারজয়ী ভারতের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক ও মানবাধিকারকর্মী অরুন্ধতি রায় খুব জোর দিয়েই বলেছেন। প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে আফজালের বিচার প্রক্রিয়ার ঘাপলা নিয়েও অরুন্ধতি বেশ উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন। ভারতের কথিক গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের মুখোশ তিনি উম্মোচন করেছেন। অরুন্ধতির নিবন্ধ থেকে- ‘'আফজাল গুরুর সত্যিকার কাহিনী ও ট্র্যাজেডি শুধু আদালতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, প্রকৃত ঘটনা জানতে হলে কাশ্মির উপত্যকার ঘটনাবলী জানতে হবে। এটি একটি পরমাণু যুদ্ধক্ষেত্র এবং পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিকীকরণকৃত এলাকা। এখানে রয়েছে ভারতের পাঁচ লাখ সৈনিক। প্রতি চারজন বেসামরিক নাগরিকের বিপরীতে একজন সৈন্য। আবু গারিবের আদলে এখানকার আর্মি ক্যাম্প ও টর্চারকেন্দ্রগুলোই কাশ্মিরিদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের বার্তাবাহক। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিতে সংগ্রামরত কাশ্মিরিদের জঙ্গি আখ্যা দিয়ে এখন পর্যন্ত ৬৮ হাজার কাশ্মিরিকে (মুসলমান) হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ হাজারকে গুম করা হয়েছে। নির্যাতিত হয়েছে আরো অন্তত এক লাখ লোক।

আফজালের হত্যাকাণ্ডটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জেলে যে হাজার হাজার কাশ্মিরিকে হত্যা করা হয়েছে, আফজালের জীবন ও মৃত্যু নিয়েও সেরকম অন্ধখেলা চলেছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠানই আফজাল গুরুকে হত্যায় ভূমিকা রেখেছে।’'

যে অজুহাতে গ্রেফতার

২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতের সংসদ ভবনের গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ৫জন সশস্ত্র ব্যক্তি গাড়িবোমা হামলা চালায়। তাদের চ্যালেঞ্জ করা হলে গাড়ি থেকে বের হয়ে তারা গুলিবর্ষণ করে ৮ নিরাপত্তাকর্মী ও ১ মালিকে হত্যা করে। পরে বন্দুকযুদ্ধে হামলাকারী ৫জনই নিহত হয়।

ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এনকাউন্টার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য কুখ্যাত দিল্লি পুলিশ স্পেশাল সেল দাবি করে যে, তারা ঘটনার আসল পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে পেয়েছে। এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ১৫ ডিসেম্বর দিল্লি থেকে অধ্যাপক এসএআর গিলানি, কাশ্মিরের শ্রীনগর থেকে শওকত গুরু ও তার চাচাতো ভাই আফজাল গুরুকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর গ্রেফতার করা হয় শওকতের স্ত্রী আফসান গুরুকে। পরবর্তীতে কুখ্যাত পুলিশ আফজাল গুরুকে দিয়ে হামলাকারীদের নাম বলাতে বাধ্য করে।

মিডিয়ার মিথ্যা প্রচারণা ও বিচারে প্রভাব

ঘটনা পরবর্তী কিম্বা বিচার চলাকালীন দীর্ঘ সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যম আর কষ্ট করে বিষয়টির সত্যমিথ্যা যাচাই করতে যায়নি। সোৎসাহে পুলিশের ভাষ্যই তারা প্রচার করে। উপরন্তু আরো রঙচঙ মাখিয়ে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্যচিত্র নির্মাণ করে ভারতীয় গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের কয়েকটি শিরোনাম প্রণিধানযোগ্য। '‘দিল্লি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকের বাসায় বোমা হামলার পরিকল্পনা’', ‘'ভার্সিটির ডন ফিদাইনদের পরিচালক’', ‘'অবসর সময়ে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে ফ্রি লেকচার দিতেন ডন'’ প্রভৃতি। জিটিভি ১৩ ডিসেম্বরের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে। এতে দাবি করা হয়, এটি পুলিশের চার্জশিটের ওপর ভিত্তি করে তৈরি সত্য কাহিনী। অরুন্ধতি এনিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বলেন, ‘'পুলিশি ভাষ্যই যদি সত্য হবে, তবে আদালত কেন?’'

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ও আদভানি প্রকাশ্যে ওই তথ্যচিত্রটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। সেটি প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে অস্বীকৃতি জানায় সুপ্রিমকোর্ট। কোর্টের মন্তব্য, ‘গণমাধ্যম বিচারকদের প্রভাবিত করতে পারবে না।’ তবে শেষ পর্যন্ত আদালতের এ দাবি আর সত্য থাকে নি। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, আদালত এসব দ্বারা প্রভাবিত হয়েই রায় দিয়েছে।

বর্তমানে বিজেপির এমপি ও সেই সময়ে পাইয়োনিয়ার সংবাদপত্রের সম্পাদক চন্দন মিত্র লেখেন, ‘'২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সংসদ ভবনে হামলার অন্যতম সন্ত্রাসী ছিলেন আফজাল গুরু। তিনিই প্রথমে নিরাপত্তা রীদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। নিহত ছয়জনের মধ্যে তিনজনকেই হত্যা করেন আফজাল।’' যদিও পুলিশের চার্জশিটে আফজাল গুরু সম্পর্কে এমন কথা বলা হয়নি।

এভাবেই গোয়েবলসীয় কায়দায় আফজাল গুরুর বিপক্ষে প্রপাগাণ্ডা চালানো হয়েছিল।

আড়ালের প্রকৃত ঘটনা

কিছু লোক এখন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে উৎসবে মাতোয়ারা। তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন, ভারতের আদালতে গিলানিকে খালাস ও আফজালকে শাস্তি দেয়ায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বিচার স্বচ্ছ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। বিচার প্রক্রিয়া বিশ্লেষন করলে এতো সহজে একে স্বচ্ছ বলে রায় দেয়া যায় না।

এক

২০০২ সালের মে মাসে দ্রুত আদালতে বিচার শুরু হয়। তখন বিশ্ব ওয়ান-ইলেভেনের উম্মত্ততায় কাঁপছে। অসময়েই আফগানিস্তানে বিজয় হয়েছে দাবি করে উল্লাস করছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই বছরেরই ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে গুজরাট রাজ্যে পুলিশ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় মুসলিম নিধন শুরু হয়ে তখনো বিক্ষিপ্তভাবে চলছিল। বাতাসে ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। এ অবস্থায় সংসদ ভবনে হামলার বিচার শুরু হয়। ফৌজদারি মামলার বিচারের ঠিক চরম মুহুর্তে যখন হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টে বিচার চলে, সাক্ষীদের জেরা করা হয়, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়, আইনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়, তখন তো নতুন কোনো প্রমাণ হাজির করা যায় না।

আফজাল গুরুকে এ সময় হাই সিকিউরিটি সেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বন্দী করে রাখা হয়। তার কোনো আইনজীবী ছিল না। আদালত এক জুনিয়র আইনজীবীকে নিয়োগ দিলেও তিনি একটিবারের জন্যও আফজাল গুরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নি। আফজালের সমর্থনে কোনো সাক্ষীকেও হাজির করা হয় নি। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরা করেননি তিনি। ওই পরিস্থিতিতে কোনো কিছু করার সামর্থ্য নেই বলে মন্তব্য করেন বিচারক।

দুই

তারপরও কিছু তথ্য বের হয়ে আসে। কয়েকটি উদাহরণ হলো- গ্রেফতারের সময় জব্দ করা একটি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। তবে আইন অনুযায়ী সেগুলো সিলগালা করা হয়নি। বিচারের সময় ফাঁস হয়ে যায়, ল্যাপটপের হার্ডডিস্কে গ্রেফতারের পরও হাত দেয়া হয়েছে। তাতে দেখা যায়, সংসদ ভবনে প্রবেশের সময় ভুয়া অনুমতিপত্র ব্যবহার করা হয়েছে এবং আফজাল তার সব তথ্য মুছে ফেলেছেন।

তিন

পুলিশ দাবি করেছে, মোবাইল নম্বর দিয়ে হামলাকারীদের সঙ্গে ২০০১ সালের ৪ ডিসেম্বর যোগাযোগ করেছেন আফজাল। তবে রাষ্ট্রপক্ষের কল রেকর্ডে দেখা যায়, সিমটি ২০০১ সালের ৬ নভেম্বরের পর আর চালু ছিল না।

চার

আফজালকে গ্রেফতারের ব্যাপারে পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে, গিলানির সহায়তায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। তবে পুলিশি রেকর্ডে দেখা যায়, গিলানিকে গ্রেফতারের আগেই আফজালকে গ্রেফতার করা হয়। হাইকোর্ট একে স্ববিরোধী বললেও এ নিয়ে আর সামনে এগোয়নি।

অরুন্ধতি এসব তার নিবন্ধে উল্লেখপূর্বক মন্তব্য করেছেন, ‘এভাবে মিথ্যা আর সাজানো তথ্যের পাহাড়ের ওপর ভিত্তি করে প্রমাণ হাজির করা হয়। আদালত এসব বিষয় স্বীকার করলেও পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।’

মানবাধিকার লঙ্ঘন

আফজাল গুরু মহাসন্ত্রাসী হোন বা না হোন, আইন ও নিয়মমাফিক তার যতটুকু অধিকার পাওয়ার কথা, কথিক গণতান্ত্রিক ভারত স্বৈরাচারীর মতো গুরুকে তা থেকে বঞ্চিত করেছে।

এক. আফজাল গুরু একযুগ পর্যন্ত তিহার জেলে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে পরিবার-পরিজনের কেউই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেনি।

দুই. বিচার প্রক্রিয়া ছিলো সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ এবং সাজানো।

তিন. পরিবারকে তার ফাঁসির সময় জানানো হয়নি। মৃত্যুপূর্ব সাক্ষাতের বিধান থাকলেও সরকার তা মানেনি। সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী কুলদীপ নায়ারও এ নিয়ে সমালোচনা করেছেন। লিখেছেন, ‘'জেনারেল জিয়াউল হকের মতো একনায়ক পর্যন্ত জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসির একদিন আগে তাকে তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিয়েছিলেন। তাহলে কেন সে অনুমতি গুরুর পরিবার পেল না? তার পরিবার-পরিজনকে দিল্লির তিহার জেলে এসে কবরে ফাতেহা পাঠের অনুমতি দিলে কোনো ক্ষতি হতো না।'’

চার. মৃত্যুপূর্ব লেখা আফজালের চিঠি পরিবারের নিকট পৌঁছাতে সরকার গড়িমসি করেছে। এমনকি চিঠিটি মৃত্যুর তিনদিন পর বাড়ি পৌঁছেছে।

কুলদিপ নায়ার আরো লিখেছেন, ‘'When the Supreme Court bases its judgment primarily on the circumstantial evidence, it becomes all the more necessary to commute the death conviction to life sentence.' অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্ট তার রায়টি দিয়েছেন প্রথমত ‘পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ’-এর ওপর ভিত্তি করে। এ কারণে (আফজাল গুরুর) মৃত্যুদণ্ডকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তন করার খুবই প্রয়োজন ছিল।

আফজাল গুরুর জনপ্রিয়তা

আফজাল গুরুর ফাঁসির পর তাঁর জন্মস্থান কাশ্মিরের পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভারত সরকার হিমশিম খাচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা পরিস্থিতি মূল্যায়নে বলেছেন, ‘এখন কাশ্মিরের বেশিরভাগ শহরেই কারফিউ। যুবকদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষের খবর আসছে। কাশ্মিরের সংবাদপত্রগুলোকে বলা হয়েছে, উদ্ভূত সঙ্কট সম্পর্কে কোনো রিপোর্ট না ছাপাতে। টিভি চ্যানেলগুলোকে বলা হয়েছে এ নিয়ে কোনো কিছু প্রচার না করতে।’ এসব ঘটনা অবশ্যই তার জনপ্রিয়তার শক্ত প্রমাণ বহন করে।

আফজাল যে অন্তত তার জন্মস্থান কাশ্মিরে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ছিলেন, তার প্রমাণ হলো- গুরুর ফাঁসির প্রতিক্রিয়া। প্রচণ্ড প্রতিবাদ বিক্ষোভের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসন শ্রীনগরে একনাগাড়ে সপ্তাহখানেক সান্ধ্য আইন বলবৎ রেখেছে। তা উপেক্ষা করেই বিক্ষোভজনিত সংঘর্ষে পুলিশের হাতে কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন। নিহত এক বালকের নামাজে জানাজায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ অংশ নেয়।

সাধারণ বার্তা

প্রশ্ন করা যায়, একজন নিছক সন্ত্রাসীর কি এমন জনপ্রিয়তা থাকতে পারে? বলাবহুল্য, দখলদার ও আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রশক্তি বরাবরই স্বাধীনতা বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সশস্ত্র কিম্বা নিরস্ত্র সংগ্রামকে ‘জঙ্গিবাদ’ ‘সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে। বস্তুত এটা একটা জনগোষ্ঠীর ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম। আর তা দমনে নিজেদের অত্যাচার ও বর্বরতা আড়াল করার ব্যর্থ প্রয়াস চালায় রাষ্ট্রযন্ত্র।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কথাটি অতীব সত্য বলেই প্রতীয়মান।

জল্লাদের চোখে অশ্রু

ভারতের ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’ চমৎকার একটি রিপোর্ট করেছে। ‘'অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি জল্লাদও : হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে ওঠেন আফজাল গুরু’' শিরোনামের প্রতিবেদনে মৃত্যুপূর্ব আফজালের অভিব্যক্তি, জল্লাদ ও কারা কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারসহ বেশকিছু সুন্দর বিষয় তুলে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আফজাল গুরুকে ফাঁসির রায় দেয়ার পর শোকের ছায়া নেমে এসেছে দিল্লির তিহার কারাগারের কর্মকর্তাদের মধ্যে। তাঁকে ফাঁসি দেয়ার সময় জল্লাদও অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনিও গুরুর উদ্দেশ্যে ‘'আল বিদা’' শব্দটি উল্লেখ করেন। একই শব্দে জল্লাদকেও বিদায় জানিয়েছিলেন আফজাল গুরু।’

কারা কর্মকর্তার বরাতে ইংরেজি দৈনিকটি আরো জানাচ্ছে, ‘ভারতের উগ্র ডানপন্থি মহলসহ কোনো কোনো মহলে গুরুর ফাঁসিতে আনন্দ প্রকাশ করলেও তিহার কারাগারে এ উৎসবের নামগন্ধও ছিল না। বরং অনেক কারাকর্মীকে অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে।’

কর্মকর্তা আরো বলেছেন, ‘ফাঁসিতে যাবার পূর্বে জল্লাদের উদ্দেশ্যে গুরু ছোট্ট একটি মিনতি করেন। বলেন, ‘প্রচণ্ড ব্যথা পেতে পারি’ এমন কিছু নিশ্চয়ই তুমি করবে না। জল্লাদ চোখের পানি সামলে নিশ্চিত করেন, ‘না এমন কোনো কাজই করা হবে না’। জল্লাদ এ সময় গুরুর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছিলেন না। জল্লাদের চোখ বারবার পানিতে ভরে যাচ্ছিলো। বেশ কষ্ট হয়েছে জল্লাদের নিজেকে সামলাতে।’

আল্লাতে গুরুর অগাধ বিশ্বাস

জানা যায়, তিহার কারাগারে ২৫টি প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। কারাগারের শীর্ষ কর্মকর্তারা শেষ ১০টি প্রাণদণ্ড কার্যকর করার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তারা বলেছেন, ফাঁসির খবর পাওয়ার পর মানুষ এতো শান্ত আর নির্বিকার থাকতে পারেন, আগে কখনো এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য তাদের হয়নি।

শেষ কয়েক ঘণ্টার গুরুর সঙ্গীরা বলেন, আফজাল তাদের কাছে জীবন-মৃত্যু নিয়ে নিজের চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরেন। সত্যের পথে চলাটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে কথা বলেন। পরিবার প্রশ্নে গুরু বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের সবাইকে দেখছেন এবং তিনিই আমাদের পরিবারের প্রতি নজর রাখবেন।’

গুরু ফাঁসির মঞ্চের শেষ ১০০ ধাপ হেঁটেই পাড়ি দিয়েছেন। এ পথটুকু পার হতে গিয়ে অনেক সন্ত্রাসী নানা ধরনের চেঁচামেচি করেন, কিন্তু তেমন কিছুই করেননি আফজাল গুরু; বরং আশপাশের কারাকর্মীদের কুশল জানতে চান এবং হাসিমুখে তাদের প্রতি শুভেচ্ছা জানাতে জানাতে জীবনের শেষ পথটি অতিক্রম করেন।

কারা কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘গুরু সর্বদাই উৎফুল্ল ও শান্ত স্বভাবের ছিলেন। ফাঁসির কথা শুনলেই মানুষ ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। কিন্তু হাসি মুখে ফাঁসিতে যাবার যে রুপকথা প্রচলিত আছে, আফজাল গুরুর বেলায় ঠিক তাই ঘটেছে।’

কর্মকর্তার আরো মন্তব্য হচ্ছে, ‘আফজাল গুরুর প্রচণ্ড আধ্যাত্মিক শক্তি ছিল বলেই তিনি এমন সাহস দেখাতে পেরেছেন।’

আদালতের অদ্ভূতুড়ে রায়

আদালত রায় দিলেই ‘জজমিয়া নাটক’ বিশ্বাসযোগ্য হয় কিনা, স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া থেকে মুজিবে স্থানান্তরিত হতে পারে কিনা, ফতোয়া নিষিদ্ধ আমরা মেনে নিতে পারি কিনা, খালেদার ন্যায় সঙ্গত বাড়িটি অবৈধ হবার সুযোগ আছে কিনা, পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গিলানির প্রধানমন্ত্রিত্ব বাতিলের প্রক্রিয়া বাস্তবসম্মত কিনা- আদালত নিয়ে ইত্যাকার প্রশ্ন করার সুযোগ সব দেশেই থাকে।

সুপ্রিমকোর্ট তার রায়ে বলেছে, ‘'আফজাল গুরুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ওই ঘটনায় বিপুল সংখ্যক হতাহত এবং গোটা জাতি আলোড়িত হয়েছে। সমাজের সম্মিলিত বিবেক সন্তুষ্ট হবে যদি অভিযুক্তকে ফাঁসি দেয়া হয়।’'

আমরা তো ফুল টাশকি! আদালত বিচার করতে বসেনি। সম্মিলিত বিবেককে সন্তুষ্ট করার ঠিকাদারি নিয়ে বসেছে। তারপরও কথা থাকে। কারা সমাজের সম্মিলিত বিবেক? আর একে চিহ্নিতইবা কারা করবে? সংবাদপত্রের তথ্য? নাকি টিভির তথ্যচিত্র? আমরা যারপরনাই অবাক হইয়া ভাবিতে থাকি।

আবারো অরুন্ধতিকে ধার করছি। তার শেষ মন্তব্য- ‘'এখন তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করি, আমাদের সম্মিলিত বিবেক এখন সন্তুষ্ট হয়েছে। নাকি এখনও আমাদের রক্তের কাপের অর্ধেকটা খালি?’'

সহযোগিতা : গার্ডিয়ানে প্রকাশিত অরুন্ধতি রায়ের নিবন্ধ ‘'দ্য হ্যাংগিং অব আফজাল গুরু ইজ এ স্টেন অন ইন্ডিয়া’স ডেমোক্র্যাসি' (আফজাল গুরুর ফাঁসি ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য কলঙ্ক)।’

দ্রষ্টব্য : আফজাল গুরুকে ফাঁসি দেবার ঘটনা বেশ পুরনো। অনেক ইচ্ছে সত্ত্বেও তখন লিখতে পারি নি। তাই বেশ দেরিতে লিখতে হলো। তবে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপকতা এবং গণহারে মুসলিম নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে এমন লেখা প্রতিদিনের জন্যই নতুন। প্রতিদিনের জন্যই সাম্প্রতিক।

বিষয়: বিবিধ

১৫৮৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File