ফরহাদ মজহারের বিতর্কিত এবাদতনামা : গৌতম দাসের ব্যাখ্যা

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ মাহবুব হাসান ২২ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:৪৪:২৬ দুপুর



একটা কবিতা নিয়ে শাহবাগিরা খুব লাফালাফি করছিল। ফরহাদ মজহারও নাকি নাস্তিক। আল্লাহকে কটাক্ষ করেছে। আজ হেফাজতের পক্ষে তাই তার ব্যাপারে সবাই চুপ ইত্যাদি ।

আমারও কবিতার ব্যাখ্যাটা সেভাবে জানা ছিল না। আর নিজের স্বল্প জ্ঞানেও তা বুঝি নাই। ফেসবুকে গৌতম দাস এটার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পক্ষ-বিপক্ষ বুঝি না। পড়ার আমন্ত্রণ। কবিতাটা আগে উল্লেখ করছি।

এবাদতনামা ৬

দুনিয়া রেজিস্ট্রি কর

তিলেক হিম্মত নাই,আধা ছটাকের নাই তেজ

সাত আসমানে প্রভু খোদাতা'লা হয়ে বসে আছ

... মুখে খালি কহ শুনি দুনিয়ার তুমিই মালিক

অথচ মালিক অন্যে,অন্যে কহিতেছে তারা খোদা ।

ধরো আমাদের গ্রামে আলহাজ ছামাদ মৌলবি

তিনি খোদ নিজ নামে বাহাত্তর বিঘা হালটের

জমির মালিক ,তেতাল্লিশ চেয়ারম্যান ,ষাট বিঘা

রশিদ কনট্রাক্টর ,ইটের ভাটার ছরু মিয়া

চৌদ্দ বিঘা বিশ ডেসিমেল ,বাকি থাকে ছমিরুদ্দি

চন্দনের বাপ, হারাধন -প্রত্যেকেই কমবেশি প্রভু

মালিক এ জমিনের -প্রত্যেকেই তোমার শরিক

তোমার শরিক নাই এই কথা তবে কি বোগাস ?

এদের দলিল যদি মিথ্যা হয় যাও আদালতে

উকিল ধরিয়া করো দুনিয়া রেজিস্ট্রি নিজ নামে ।

ব্যাখ্যা

গৌতম দাস : এই কবিতাটা বহু জায়গায় উল্লেখ করা হচ্ছে এটা ফরহাদ মজহারের একটা নাস্তিক কবিতা বলে ধরে নিয়ে। এককথায় বললে, এগুলো কবিতাটার একটা নাস্তিক মনের পাঠ। আবার এই নাস্তিক পাঠ অনেককে প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত করছে দেখা যাচ্ছে।

এ থেকে বুঝা যায় নাস্তিকতা চিন্তার ক্ষমতা কত নাদান। কোথাও ইসলাম বা ধর্মীয় কোন শব্দ বা বয়ান দেখলেই এরা এটাকে শত্রু জ্ঞান করে, পশ্চাতপদ পরিত্যাজ্য জ্ঞান করে। এটাই এদের ধর্ম বুঝাবুঝির দৌড়।

দুনিয়ার মালিক আল্লাহ। জমিজমাসহ মাটি, মাটির নীচে, আকাশে পাতালে কসমিক – জড়-অজড়, প্রাণ-অপ্রাণ সব - এই অর্থে দুনিয়া। আলোচ্য কবিতায় প্রতিকিভাবে সেটা বিশেষ অর্থে জমিজমা। কিন্তু বাস্তবে দুনিয়াটাকে এই সত্যের বিপরীত করে রাখা হয়ে আছে। জমিজমার মালিকানা, রেজিষ্ট্রি এসব ধারণা এবং এর আইনগত ভিত্তি আরোপ করে দুনিয়াকে উলটা করে সাজানো হয়ে গেছে।

ধারণাটা আর একটু বিস্তারে করলে দেখা যাবেঃ মানুষ যেখানে শ্রম দেয় –কৃষিকাজের ক্ষেত্রে যেমন জমি। আবার শ্রমের হাতিয়ার মানে নাঙল কোদাল ইত্যাদি – এমন এসব কিছু এক কথায় বলে মিনস অব প্রডাকশন বা বাংলায় বললে, উতপাদনের উপায়। উতপাদনের উপায় ব্যবহার করে মানুষ নিজের নিজস্ব শ্রম ঢেলে যা উতপাদন করবে অন্য কিছু নয়, সেই ফসল কেবল মাত্র ঐ ফসলের মালিক হলো শ্রম বা যে শ্রম দেয়। জমি বা শ্রমের হাতিয়ার সহ উতপাদনের উপায় এর মালিক মানুষ নয়। ঐ ফসল সে ভোগ করবে ওটাই একান্ত তার নিজের অর্জন। এটাই তার রিজিক হবে। এটাই হলো দুনিয়ার মৌলিক স্বভাব। দুনিয়ার মালিক আল্লাহ কথাটার অর্থ তাতপর্য। এই মৌলিক দিকটা উলটে দেওয়া হয়েছে। কিছু লোক উতপাদনের উপায়গুলো মালিকানা দাবী করে বসেছে। আর এই যুক্তিতে অন্যে যে শ্রম দিয়ে ফসল ফলাচ্ছে সে ফসলের বড় এক অংশের ভাগ নিজের বলে দাবী প্রতিষ্ঠা করেছে। অন্যের শ্রমের উপর আরামে নিজের মালিকানা আছে এমন ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। এই বিচ্যুতি থেকে দুনিয়াকে মৌলিক স্বভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে। বিচ্যুতি এক দিনে হয় নাই। ফলে মৌলিক জায়গায় ফিরিয়ে নিতে লম্বা সময় ও পদ্ধতি-কৌশল লাগবে।

এটা একটা কবিতা। ফলে এই বিচ্যুতির দিকে নজর ফিরিয়ে, বিচ্যুতির বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদের ছলে কবিতা বা বয়ানটা উপস্থাপন করা হয়েছে। আল্লাহ দুনিয়ার মালিক – এই মৌলিক কালামে ফেরার ইঙ্গিত তৈরি করেছে। রেজিষ্ট্রি শব্দ, ধারণার চর্চার বিকৃত দুনিয়ার বিপরীতে দুনিয়াকে আল্লাহ নামে রেজিষ্ট্রি করে নেবার প্রতিকি কথা তুলেছে। কিন্তু কে করবে? ভালো উকিল ধরতে বলছে। কারা ভাল উকিল? যারা কালামের মৌলিক ম্যাসেজ বুঝবে, এর সাথে মিলিয়ে বাস্তব দুনিয়ার বিচ্যুতিটা আমল করবে – ইমানের বলে তারা বিচ্যুত দুনিয়াকে ওর মৌলিক স্বভাবে প্রত্যাবর্তন করাবে – এরাই সে উকিল – মোমিন।

এখন নাস্তিক মন থেকে পাঠ করলে কবিতাটার উলটা পাঠ সম্ভব। কারণ প্রথমত আল্লাহ দুনিয়ার মালিক – এই মৌলিক কালামের অর্থ তাতপর্য বুঝবার দায় এরা কখনও বোধ করে নাই। কোথাও আল্লাহ বা ইসলাম বলে বাক্য দেখলেই এদের এটিচ্যুড হলো, খেয়ে না খেয়ে এর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে হবে তাদের। এই হোল তাদের নাস্তিকতা চিন্তার দৌড়। ধর্মতত্বের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত সত্য, বয়ান পাঠ করার, উপলব্দি করার ক্ষমতা এদের নাই। নিজেদের চিন্তার এই অযোগ্যতা ঢাকবার জন্য এরা প্রচার করে বেড়ায় ধর্ম বা ধর্মতত্ব মানেই পশ্চাতপদ, মধ্যযুগীয়। এই অসুখ বহু পুরানো – এর হাতেখড়ি হয়ে ছিল, (এবং এখনও জিন্দা আছে) তাদের কথিত মধ্যযুগীয় কাল শেষের “এনলাইটমেন্ট” আন্দোলনের মধ্যে। এরা না বুঝে ধর্ম না বুঝে মার্কস অথবা রাজনীতি। অথচ ভাব ধরে এরা “আধুনিক”, “আলোকিত”।

কবিতায় ছল করে বলা হয়েছে “তিলেক হিম্মত নাই”। কার হিম্মত নাই? আল্লাহর? প্রশ্নই আসে না। আল্লাহ ধারণাটা বুঝলে হিম্মত কার, কোথায় এর উতস – এসব অবান্তর চিন্তা আসার কারণ নাই। হিম্মত তো আল্লাহ দেখানোর কথা নয়। আল্লাহ কালাম দিয়েছে, পথ বলে দিয়েছে। আর কি চাই। এরপর মোমিন হওয়া বা না হওয়ার দায় মানুষের। হিম্মত দেখানোর জন্য শ্রেষ্ঠ সৃষ্ঠি হিসাবে মানুষকে পাঠানো হয়েছে। এর “ভাল উকিল” হবার দায় কর্তব্য মানুষের।

যেহেতু ““তিলেক হিম্মত নাই” বলে কবিতা শুরু হয়েছে ফলে “নাস্তিক পাঠ” খুশি হয়ে উঠেছে। ভেবেছে তাদের মনের কথা বলছে বুঝি। “নাস্তিক পাঠ” এর কেউ লক্ষ্য করবার আর মুরোদ রাখেনি না-বাচক দিয়ে শুরু হওয়া এই কবিতা শেষ হচ্ছে কিভাবে। এতদিন তারা খুশিতে ছিল ফরহাদ মজহার বোধহয় “এবাদতনামা” নামে বলে এক নাস্তিকতার কবিতার বই লিখেছে। কেউ কেউ অবশ্য ঐ ১৯৮৯ সালে বইটা প্রকাশের সময় থেকেই আবার এটা “মৌলবাদী” কবিতার বই হিসাবে প্রচার চালিয়েছে। কারণ, ঐ বইয়ে ধর্ম বা ইসলাম বিষয়ক প্রচুর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যে শব্দ ব্যবহার “আধুনিক মনের” জমানায়, পরিত্যাজ্য করে রাখা হয়েছিল। এসবের মুল কারণ, এরা এরা না বুঝে ধর্ম না বুঝে মার্কস অথবা রাজনীতি – চিন্তা করবার মুরোদহীন এক দশা। ধর্মতত্ব পাঠ করার চিন্তার মুরোদ লাগবে, সে চাষাবাদে মন দিয়ে যোগ্য হতে হবে আমাদের আগে – তবেই যদি চিন্তা করবার মুরোদহীন দুর্দশা আমাদের কাটে।

বিষয়: বিবিধ

৫৪১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File