মা রয়েছেন অনূভবে হৃদয়ের গভিরে!
লিখেছেন লিখেছেন রাইস উদ্দিন ০৭ মার্চ, ২০১৩, ০৩:৩৪:২০ দুপুর
(এক)
আমার আব্বা ছিলেন একজন স্কুল মাষ্টার।আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল,ছয়জন।একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনই বা কত?সংসারের অবস্থাছিলো যেমন নুন আনতে পান্তা ফুরয়।পাচঁভাই বোনের লেখাপড়াসহ সংসার চালাতে বাবাকে হিমশিম খেতে হয়।তার পরও মোটামুটি কেটে যাচ্ছিল দিন।বাবা মা দুজনই ছিলেন আল্লাহভীরু তাই অভাব অনটনে কখনো মনোবল হারাতেন না।দৃঢ়তার সাথেই সবকিছুর মোকাবেলা করতেন।বাবা মা দুজনই আমাকে খুব আদর করতেন।আমি সবসময় আব্বার সাথেই স্কুলে যাওয়া আসা করতাম।
১৯৮২ইং সনের শেষের দিকে!একদিন বাবা আর আমি বাড়ি ফিরছি!গ্রীস্মের কাঠঁফাটারোদ মনে হচ্ছে আকাশ থেকে যেন অগ্নিবৃষ্টি হচ্ছে।ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বাবা পাঞ্জাবীটা খুলে উঠানে একটি গাছের ছাঁয়ায় বসলেন।আমি মাকে গিয়ে শরবত করতে বললাম।মা আগেই আমাদের জন্য আখের গুড় সাথে লেবুপাতা মিশিয়ে শরবত করে রেখেছেন।বাবা সবময় পিতল কাশার থালা বাসন ব্যবহার করতে ভাল বাসতেন। তাই মা শরবত ভর্তি কাশার গ্লাসটা বাবাকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন;একটু বিশ্রাম নিয়ে অজুটা সেরে নেন এক্ষুনি আজান হবে।
সূর্য্যটা ইস্যত্পশ্চিম দিকে হেলে পরেছে।একটু বিশ্রাম নিয়েই বাবা পিতলের বদনাটা নিয়ে নলকুপের ধারে গেলেন আমি পানি ভরায় তাকে সাহায্য করলাম। অজুর পানি হাতে নিয়ে দুএকপা অগ্রসর হতেই মুছড়া খেয়ে জমিনে পরেগেলেন।আমি দৌড়ে কাছে গিয়ে শুধু কালেমা পড়ার মৃদু আওয়াজ শোনতে পেলাম।তারপর সব শেষ।
হুহুকরে কেদেঁ উঠলাম।মা পাশে এসে পাথরের মত দাড়িয়ে রইলেন।একেবারে নিরব নিথর!চোখে একফোটা পানি নেই।মুখে কোন ভাষা নেই।যেন পাথরের মানুষ। গ্রামের এক বয়োজেষ্ঠ লোক এসে আমাদের বুঝাতে চেষ্টাকরছেন’ তারপর একজন মৃতব্যক্তির আষল ঠিকানা যেখানে সেখানেই মরহুমকে রেখে আসাহলো।
(দুই)
পৃথিবী কারো জন্য থেমে থাকেনা।পৃথিবী চলে তার অপন গতিতে।মানুষকেই তার সাথে তালমিলিয়ে চলতে হয় বাস্তবতার নিরিখে।আমাদের পরিবারে নেমে এল অন্ধাকার অমানিশা।এর ভেতর দিয়েই পথ খুঁজে বেরকরতে হবে সামনে চলার।মা দৃঢ় মনোবলের অধিকারীনী।তিনি মনোবল হারালেন না। নিঃস্বার্থ ত্যাগ আর ভালোবাসার ছোঁয়ায় তিল তিল করে আমাদের গড়ে তুলতে তার সারাটি জীবন নিজের শান্তিকে পীড়িত করে স্নেহের আঁচল বিছিয়ে রেখেছেন আমাদের চলার পথে।নিজের সমস্ত স্বার্থ আর সুখকে বিসর্জন দিয়ে আমাদেরকে মমতার ছায়ায় জড়িয়ে রেখেছেন।পিতার ভালবাসা মায়ের মমতা সত্যি আল্লাহর অশেষ নিয়ামাত বৈ আর কি?
আমার মা একজন আদর্শ মা।তিনি সবসময় সমস্ত বিপদ আপদ থেকে আগলে রাখতে যথেস্ট চেষ্টা করতেন।বাবার অভাব বুঝতে দেননি কোনদিন।পিতার রেখে যাওয়া সম্পদ স্বল্পই ছিল।বড় পুকুর একটি বাগানছিল যা থেকে কোন রকম আমাদের ভরনপুশন চলে যাচ্ছিল।বড় ভাই টিউশানীকরে তার কলেজ খরচ চালাতেন এবং মেঝুও তেমনি।সেঝু ভাই আমি ও আমার ছুট্টবোনট হাইস্কুলে পড়াশোনা করছিলাম।কয়েক বছর এমনিতে কাটতে লাগলো।বড় ভাই তার এক ছাত্রীকে বিয়ে করে নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে চেষ্টা করছেন।মেঝুভাই এক নিকটাত্মীয়ের সহযোগিতায় আবুদাবী চলেগেলেন।এভাবেই আল্লাহ আমাদের বাচার একটা পথ খোলে দিলেন।পরম করুনাময়ের অশেষকরুনায় শিক্ত হলো আমাদের পরিবার।
মা বোনটিকে এস এস সি পাশকরার পর পরই ভাল পাত্র পাওয়ায় বিয়ে দিয়ে দিলেন। খুব ঘটাকরে না হলেও একটা মূখরপরিবেশ ছিল বিয়ের অনুষ্ঠানে।
(তিন)
একদিন বাদ মাগরেব!চারদিক ঘন অন্ধকার!বাশঝারঁ থেকে ঝিঝিপোকাড় একটানা বিদঘুটে শব্দ এসে কর্ণকুহুরে প্রবেশ করছে।মা একটি চেয়ারে বসা ছিলেন কেন যেন বার বার উঠছেন বসছেন।কোন এক অজানা অশুভ লক্ষণ যেন মা উপলোব্ধি করছেন।চোখে তার দুশ্চিন্তার ছাপ লখ্যকরলাম।
-মা আপনার শরীর ভালতো? আমার দিকে এক নজর তাকালেন,কোন জবাব দিলেন না।হঠাত একটা দু:সংবাদ নিয়ে এলেন পাশরে বাড়ীর রহমত ভাই।আজই বিকেলে তিনি আবুদাবী থেকে দেশে ফিরছেন।একটু ইতস্ত করলেও সংবাদটি জানাতে তিনি বিলম্ব করলেন না।
-চাচী আম্মা!আমি একটি দু:সংবাদ নিয়ে এসেছি আপনাকে শান্ত হয়ে শুনতে হবে।
-দেড়ি করিসনে বাপ!গতকাল থেকেই আমি খুব পেরেশানীতে আছি।
-গতকাল আপনাদের মাসউদ গাড়িচাপা পরে মারা গিয়েছে।(ইন্নালিল্লাহে অইন্না ইলাইহে রাজিউন)।
আমাদের মাথায় যেন আসমান ভেঙ্গে পরলো।নিয়তির এ কেমন খেলা?যার আয়ের উপর পুরো পরিবার নির্ভর করতো আল্লাহ তাকেই উঠিয়েনিলেন।ভাইয়ের মৃত্যুতে মা একবারে নিথর হয়ে গেলেন।পর পর দুটি আঘাত তাকে ভিষন ভাবে মর্মাহত করলো।এখন আমাদেরকে এক মুহুর্ত্য না দেখলে তিনি অস্থির হয়ে উঠেন।আমি কেবল ইন্টার পাশকরেছি।সেঝু ভাই সংসারের হাল ধরতে আবার বিদেশে যাবার সকল প্রস্তুতি সমাপ্ত করেছেন।তার বি এ পরিক্ষার রেজাল্ট এখনো বেরোয়নী।
মা আমার নাছুর বান্দাহ!তিনি কিছুতেই বিদেশ যেতে দিতে রাজি নন। কান্নাবিগলিত কন্ঠে বললেন”
-আমরা না খেয়ে মরবো তবু এক সাথে মরবো।তোকে বিদেশ যেতে দিবনা খোকা! মায়ের শতবাধা উপেক্ষাকরে সে সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে রওয়না দিলেন।সে পথ ধরে আমিও কিছুদিন পর সৌদি আরব এসে গেলাম।
(চার)
সৌদি আরব বালুময় মরুভুমির দেশ হলেও এখানে সবই পাওয়া যায়।কিন্তু পাক করে খাওয়া প্রথম প্রথম আমার কাছে বড়ই কষ্টদায়ক বলে মনে হয়েছিল।কখনো পাক করিনি।মায়ের কথা খুব বেশি করে মনে পরতো।সে সময় আজকের মত মুবাইল ছিলনা যে যখন খুশি মায়ের সাথে কথা বলবো খোজ খবর নেব!একদিন একটি চিঠি এল!চিঠিটা একাই নিভৃতে বসে পড়ছি আর চোখ মুছছি।মা লিখেছেন!
খোকা আদর নিস!জানি না কেমন আছিস কি খাচ্ছিস? তোদের কথা খুব বেশি মনে পরে।জানিস খোকা!যখনই সাইকেলের শব্দ পাই তখনই তোদের কথা স্মরন করে দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে দাড়াই! তোরা কখন কলেজ থকে ফিরবি!পরক্ষনই চোখ দুটো ভিজে অশ্রু গড়িয়ে পরে।এই ভেবে যে আমার চক্ষুশিতলকারী নয়নের পুতলিরা তো কলেজ শেষ করেছে কবেই।ওরা যে আমাকে ছেড়ে সুদুর প্রবাসে চলেগেছে।আমি জানি তোদের খুব কষ্ট হচ্ছে পাক করে খেতে।নিজেকেই জামা কাপড় ধৌত করতে হয়। খোকা বাস্তবতাকে স্বীকার করে সে অনুযায়ী চলার সাধ্যমত চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।দোয়াকরি জীবনে উন্নতি করো।মায়ের স্বপ্ন পুরণ করেই দেশে প্রত্যাবর্তণ করবে ইনশাল্লাহ।তোমাদের মা তোমাদের নিয়ে শুধু এতটুকুন স্বপ্নই দেখে!তার সন্তানেরা যেনো কারও মুখাপেখি না হয়।আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের স্বচ্ছলতা দান করবেন।ভাল থেকো।ছুটির সময় হলেই বাড়ি আসবে।দুজনের জন্য বউ দেখে রাখবো।দুটি লালটুকটুক বউ ঘরে আনবো।নাতিনাতকুরে উঠান ভরে যাবে ওদের নিয়ে সাড়াদিন খেলা করবো।একা একা সময় যেতে চায়না বাবা। ইতি তোমার মা!
চিঠি পড়া শেষ করে মনে মনে ভাবছি’ মা!তুমি যদি শুকনা মরিচ, পিয়াজ কুচি করে লবন মাখিয়ে আলুভর্তা করার জন্য রেখে দিতে , সেটা চাখতেও অমৃতের মত লাগতো।আমার কি কি পছন্দ না বলতেই বাড়ি ফিরে দেখতাম, ঠিক ওগুলোই রান্না করে রেখেছো। বৃষ্টির দিনে তোমার হাতের ভুনা খিচুড়ি আর গোশত খেতে কতই মূখোরুচক মনে হতো।
আজ মা বাড়িতে একা অসুস্থ!আমাদের কথা মনে করে নিদ্রাবস্থায় আমাদের নাম ধরে ডেকে উঠেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একাকিত্ব জীবন তার জন্য খুব কষ্টের। আজ বড় অসাহায় নি:শ্ব তিনি।সেবা শশ্রুকরার কেউ নেই।বড় ভাই ভাবি ছোট বোন মাঝে মধ্যে এসে দেখে যায়। মায়ের পরিচর্য্যার জন্য একজন মহিলার খুবই দরকার।
পরিকল্পনা নিলাম সেঝু ভাইকে দেশে পাঠাবো যাতে বিয়ে করে ভাবিকে মায়ের সেবা যত্নের জন্য রেখে আসতে পারেন।নিয়তির চরম সিদ্ধান্তের কাছে মানুষ বড় অসহায়।হঠাত একটি চিঠি এসে আমাদের সকল পরিকল্পাণা স্বপ্নেগড়া সুন্দর দুনিয়াটা ভেঙ্গে তছনছ করে দিল।ঐ চিঠিটি ছিল আমাদের জীবিনের বড় ব্যর্থতার খবর। যে মা নিজে নাখেয়ে আমাদের মূখে খাবার পুরে দিতেন! অভাব কি তা কোন দিন বুঝতে দেননি।তিলে তিলে নিজের সকল সূখ আরাম বিসর্জন দিয়ে দ্বীনী শিক্ষার সাথ সাথ সব ধরনের শিক্ষায় শিক্ষত করে গড়ে তুলেছেন আমাদের,সেই মা আমাদের রেখে চলে গেছেন মহান প্রভুর সান্নিধ্যে।নিজেকে খুব ব্যর্থ মনে হলো। মায়ের জন্য কিছু না করতেপারার গ্লানি আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে এখনো। তিনি তো পারতেন সেই দু:সময় কঠিন মুহুর্ত্যে আমাদের দিয়ে দিনমজুরের কাজ করাতে।তা তিনি করেন নি।আমার মা ছিলেন সেই মায়েদের কাতারে,যে মা একজন সন্তান থেকে একটি আদর্শ জাতি তৈরী করার যুগ্যতা রাখেন।
আজ মায়ের সান্নিধ্যে থাকা সেই শৈশব কৈশরের দিনগুলোয় ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। জীবনের এ পর্যায়ে এসে ও যার বিনিদ্র রজনীর দোয়া আর প্রভুর দরবারে মিনতি আর্শীবাদের ঝর্ণাধারা হয়ে সিক্ত রেখেছে আমাদের চলার পথকে। সেই মা আজ নেই অথচ এখন অর্থ আছে বৈশয়িক সূখ কেনার সামর্থ রয়েছে কিন্তু মায়ের ভালবাসা বাবার স্নেহমমতা কিনঅর্থের বিনিময়ে পাওয়া যায়?
তাই তো প্রিয় মা কে সম্মানের সহিত শ্রদ্ধা ভরে স্মরন করি এবং হৃদয় দিয়ে ভালবাসি, এমন কি যখন আল্লাহ্ এর কাছে দোয়া করি তখন বিশেষ করে মায়ের জন্য আল্লাহ্র দারবারে ঐ দোয়টি প্রত্যক নামাযের পর পাঠ করি ”রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানী ছাগিরা"
বিষয়: বিবিধ
১৩৫০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন