মা, তুমি হয়ত ভাগ্যবান, ওরা তোমার ছেলেকে গুম করেনি, ওরা তোমার ছেলের লাশকে বিভৎস করেনি।
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ আবদুর রহিম ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ১১:১৩:৩৩ সকাল
আচমকা ঘুম ভাঙ্গে আমার! আবছা চাঁদের আলো উড়ো মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলছে, দুরের বিল্ডিং থেকে লাইটের মিটমিট আলোতে হালকা দেখা যাচ্ছে! কিন্তু পৃথিবীটা এমন নিশ্তব্দ লাগছে কেন? আমিও বা এখানে পড়ে আছি কেন? এতরাতে কেনই বা বেড়ি বাধের এই নির্জন স্থানে শুয়ে আছি? আমি এখানে কিভাবে আসলাম? একি আমার জামা রক্ত পিচ্ছিল কেন? উফ, আমার কিছুই মনে পড়ছেনা!
হে আল্লাহ, আমি নড়াচড়া করতে পারছি না কেন? আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আছে কেন? কেউ আছেন? আমায় একটু হেল্প করবেন? আমাকে একটু বাসায় পোঁছিয়ে দিবেন?
উর্দি পরা এরা এখনে কি করছে? হ্যাঁ, এরা জনগনের বন্ধু। এরা অবশ্যই আমায় হেল্প করবে। ঠিক ভেবেছি, এরা তো আমার দিকেই আসছে। এদের কেমন চেনা চেনা লাগছে। মনে হয় বহুবার দেখেছি। কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছি না!
প্লিজ আমায় একটু হেল্প করবেন? কেউ একজন অট্ট হাসি দিয়ে বলল, “শালা মনে হই মরে গেছে!” বুঝলাম না! কার কথা বলেছে! প্রশ্ন করলাম ”কে মারা গেছে স্যার?” একি, এরা দেখি আমার কথার সাড়াই দিলনা! এমন ভাব যেন আমার কথা তাদের কানেই যায়নি!
একি! এমন অমানবিক ভাবে কেই কাউকে গাড়িতে তোলে? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম! তবে আশ্চর্য হলাম, এত জোরে পড়েছি কিন্তু ব্যাথা পাইনি! নিশ্চই আল্লাহর রহমত। থাক বেচারারা যে আমায় কষ্ট করে গাড়িতে তুলেছে তাতেই সন্তুষ্ট।
এই যে, আপনারা আমায় কোথায় নিয়ে এসেছেন? আমার বাসা তো মিরপুর, আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন প্লিজ। এই যে আপনারা আমার কথা শুনছেন না কেন? উফ, হাতটায় যে কি হল? একটু টোকা দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারলে হয়ত আমার কথা শুনতে পেত। আসলেই, উর্দি পরা এই লোক গুলো অনেক ভাল! আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এসেছে। আমার শরীরের যে অবস্থা তাতে বাসা থেকে মেডিকেলেই উত্তম।
”স্যার, এই নেন ছেলেটির মোবাইল! এখানে ওর পরিবারের নাম্বার আছে। ওদের কাছে খবর দেন। এসে যেন একে নিয়ে যায়।” বুঝতে পারলাম, আমার পরিবারের কথাই বলছে। মায়ের সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে। এই যে ভাই, প্লিজ আমার মোবাইলটা দিবেন? মায়ের সাথে একটু কথা বলব। কি ব্যাপার, আপনারা আমার কথা শুনছেন না কেন?
ওয়াকিটিকি টেবিলে রেখে বড় কর্মকর্তা আমার গ্রামের বাড়ি ফোন দিয়েছেন। শুনেছি ভাইয়া আসবে। অনেকদিন বাড়ি যাই না। ভাইয়ার সাথে বাড়ি যাব। উফ, অনেক খুম পাচ্ছে। জামালপুর থেকে ভাইয়া আসতে আসতে সময় লাগবে, আমি কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নিই।
ভাইয়া, তুমি কাঁদছ কেন? দেখ ভাইয়া আমার কিছু হয়নি। মায়ের কোলের উষ্ণতা পেলে আমার অবশ দেহ ঠিক হয়ে যাবে। তুমি কেঁদনা প্লিজ। ভাইয়া তুমি ওদের খারাপ বলছ কেন? তুমি জান, এই উর্দি পরিহিত লোকগুলো আমাকে অনেক হেল্প করেছে! রুপনগর বেড়ীবাধে আমি পড়ে ছিলাম সেখান থেকে আমাকে তুলে এনে হাসপাতালে রেখেছে। তোমাদের ফোন করেছে। ভাইয়া, আমি একটি কথা কিছুতেই মনে করতে পারছি না! আমি বেড়ীবাধে কিভাবে গেলাম? তোমরা বলতে আমি নাকি ব্রিলিয়েন্ট! কোন কিছু সহজে ভুলে যাইনা। এ জন্যেই মেট্রিক-ইন্টারে গোল্ডেন এ+ পেয়েছি। কিন্তু তোমাদের ধারনা ভুল, আমিও মানুষ, আমিও ভুলে যাই।
মা, তুমি এভাবে কাঁদছ কেন? এই দেখ আমার কিছু হয় নি। মা, তোমার কোলে নিয়ে আমার দেহটাকে একটু উষ্ণ করে দাও। আমি ভাল হয়ে যাব মা। তুমি এভাবে কেঁদ না মা। ছোট বেলায় আমি যখন অসুস্থ হতাম তোমরা তো তখন এভাবে কাঁদতে না। আমার কি হয়েছে মা? আমি কি আর ভাল হব না মা?
মা, আমি বুঝতে পেরেছি। আমি আর তোমাদের মত মর্তমান নই! এজন্যই তোমরা কেউ আমার কথা শুনতে পাওনা! মা, আমায় ক্ষমা করে দাও। আমি আর তোমার কোলে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজবনা। কিন্তু মা, আমি কিছুতেই শেষ দুদিনের কথা মনে করতে পারছি না! মা, আমাকে সেটা মনে করতেই হবে।
হ্যাঁ মা, আমার সব মনে পড়েছে। মা, আমি পরশু এশার নামাজ পড়ে বাসায় ফিরছি। তখন উর্দি পরা কিছু লোক আমায় ঝাপটে ধরে। ওরা আমায় মেসে নিয়ে যায়। সেখান থেকে মেসের বাকি নয় জনকে ধরে নিয়ে যায়। মা, আমি ওদের কাছে অনেক কাকুতি-মিনতি করেছি, কিন্তু ওরা আমায় ছাড়েনি। মা, আমার কোন অপরাদ ছিল না। এই দেখ মা, ওরা আমার বুকে দুটো গুলি করেছে! আমার হাতে দুটো করেছে! মা, তুমি হয়ত ভাগ্যবান, ওরা তোমার ছেলেকে গুম করেনি, ওরা তোমার ছেলেকে বিভৎস করেনি। যা দেখে তুমি গভীর রতে আতকে উঠতে পারতে! মা, তোমার আমার দুর্ভাগ্য যে, তোমার আমার টেক্সের টাকায় কেনা বুলেট তোমার ছেলের দেহকে নিশ্তব্দ করে দিয়েছে!
মা আমাকে ক্ষমা কর। শুধু এটুকু মনে রেখ, তোমার এমদাদুল্লাহ মরেনি!
Abdur Rahim
বিষয়: বিবিধ
১৫৫৩ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
উপস্হাপনার পরতে পরতে লেগে থাকা আর্তনাদ আর করুণতা মন্তব্যের ভাষা ছিনিয়ে নিয়েছে!
অন্তর থেকে খোদার দরবারে আর্জি জানাই- 'হে পরাক্রমশালী মহান রব! ধ্বংশ করে দাও জালিমশাহীর তখতে তাউস! কবুল কর তোমার দ্বীন কে বিজয়ী করতে শহীদ হওয়া এমদাদ স হ সকল কে!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন