ছোট গল্প: “দৃষ্টির বাহির”

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ আবদুর রহিম ১৮ নভেম্বর, ২০১৪, ১২:১৪:১২ রাত

মিতালীর আরো কিছুুদিন অপেক্ষার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সাইফের অব্যাহত উদ্দিপনায় মিতালীর মনকে রঙ্গিন প্রজাপতি করে ডানা মেলে অজানায় নিয়ে যায় বারবার! প্রজাপতি হতে তার ভাল লাগে। অজানায় হারাতে চায় সেও। ইচ্ছে করে আদিম যাত্রার সঙ্গি হয়ে প্রানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে। কিন্তু নিজের সতীত্বকে সে শ্রদ্ধা করে। নিজের বিবেকের কাছে কোন প্রশ্ন রাখতে চায় না। তাই সম্ভব সব সীমানার প্রাচীর শক্ত করে ধরে রেখেছে। একাধারে সাইফও তার সীমানার আরো কাছে চলে এসেছে। হয়ে উঠেছে সমস্ত পৃথিবী। সমস্ত ভাবনার কেন্দ্রে সাইফের অবস্থান। মিতালী জানে সাইফ যে স্বপ্ন দেখে সে স্বপ্নের একমাত্র নায়িকা সেই। ভালোবাসার সব পরীক্ষায় সাইফ কখনো পিছু হটেনি। এতে সাইফের প্রতি একটি বিষয় ছাড়া সব বিশ্বাস দৃঢ়তা পেয়েছে।

মিতালীর মনে অজস্র ভাবনা নাটকের স্ক্রিপ্টের মত ধারাবাহিক মঞ্চায়ীত হচ্ছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর জীবনকে সাইফের মোহনায় নিয়ে আসার মহেন্দ্রক্ষন থেকে মাত্র কয়েক কদম দুরে। যে বাধার দেয়াল চীনের মহাপ্রাচীরের মত তাদের দুজনকে আলাদা করে রেখেছিল সে বাধার প্রাচীর ভোরের কুয়াশার মত মিশিয়ে দিতে তারা দুজনই প্রস্তুত।

বয়সের বাধা ডিঙ্গানোর আর কোন উপায়ন্ত খুঁজে না পেয়ে সমাজ, পরিবার থেকে অসীম দুরের এক আলেয়ার পিছু নিয়েছে তারা। যাওয়ার সময় সাইফের চোখে যতটা উৎসাহ দেখা গিয়েছে মিতলীর চোখ তার চেয়ে বেশী শঙ্কা। চোখের পানিকে যতই অপ্রয়োজনীয় বলে মুছে নিয়েছে ততই হৃদয় পাথর গলে ঝর্ণার ধারা বয়ে চলেছে! সাইফের প্রতি প্রকট ভরসা। সেই ভরসাতে মনকে আরো কঠিন পাথর বানানো ব্যাতিত বিকল্প তার সামনে অনুপস্থিত।

গ্রাম থেকে অনেক দুরে শহরের ছোট এক গলিতে সাইফের বন্ধুর সাহায্যে কাজী-মোল্লার পর্ব শেষে সাময়িক আশ্রয়ে দুজন আজ অবাধ্য। ছোট্ট একটি নীড় যেন বিশাল দুনিয়া! পৃথিবীর সকল রং রংধনু হয়ে দশ দিগন্ত একেঁ যায় বর্নিল সাজে। সে রং ছুতে আজ আর কোন বাধা নেই। এখন সময় নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার।

ভাল ভাবেই কেটে গেল মাস খানেক। নিজেদের সাথে থাকা সম্পদও পুরিয়ে এসেছে। সাইফ হন্য হয়ে কাজ খুঁজে চলেছে। কিন্তু কাজ খুঁজে পাওয়া যত সহজ ভেবেছিল তত সহজ হয়ে ধরা দিচ্ছে না! সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাস, নেই কোন রেফারেন্স! তার উপর দেশের রাজনীতির অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। হরতাল অবরোধের মাঝে সাইফ বাহির হোক মিতালীর এটি অপচন্দ। তবু সাইফকে যেতে হবে। তাকে কাজ খুঁজে নিতে হবে।

সাইফের মন ভালো নেই। পুরনো ঝাপসা স্মৃতি গুলো তাকে অন্ধ করে তুলছে। এলাকার পরিস্থিতিও ভালো নয়। খবর অনুযায়ী তার এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। তার উপর পুলিশি হয়রানির ভয়। জীবনের এই গুরুত্বপুর্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পুর্বে সাত-পাঁচ না ভাবলেও এখন তাকে যোগ-বিয়োগ মিলাতে হচ্ছে। কি করা দরকার এমন পরামর্শ পাবার লোকও কেউ নেই। ভাবতে গেলে শুধু মনে পড়ছে এলাকার বড় ভাইয়ের সেই পরামর্শ “একটি মেয়ের জন্য একটি ছেলেই যতেষ্ট কিন্তু একটি ছেলের জন্য একটি মেয়ে কখনো যতেষ্ট নয়। একটি মেয়ে তোমাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকতে পারবে কিন্তু তুমি তা পারবে না।” না এসব ভাবার এখন সময় নয়। কিছু একটা করতেই হবে। মিতালীর দৃষ্টিতে সে হিরো, তার বিশ্বাসে তার ভরসায় ছিড় ধরানো যায় না।

দেখতে দেখতে মাস ছয়েক কেটে গেল। একটি কনষ্ট্রাকশন কোম্পানীতে সাইফ ইতিমধ্যে লেভার থেকে প্রমোশন পেয়ে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করছে। মাসিক ছয় হাজার টাকা বেতন। কোন রকম ডাল-ভাতে চলছে তাদের দুজনের সংসার। সংসারে নতুন অথিতির আগমনী বার্তা সাইফকে যতটুকু না উদ্বেলিত করেছে তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত। যেখানে শুধু বেঁচে থাকার জন্য চলে অনন্ত সংগ্রাম সেখানে বাবা হওয়ার আনন্দ হ্রদয়স্পর্শী নয়।

মিতালীর জন্য একাকীত্ব ধীরে ধীরে অনিরাপদ হয়ে উঠছে। মিতালীর মা লুবনার সাথে তার মাঝের মধ্যে কথা হয়। যখন মিতালীর বাবা আবেদ খান ফোন রেখে কোথাও যায় তখন সুযোগ হলে মা-মেয়ের কথা হয়। নতুন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ আসে লুবণার কাছ থেকেই। লুবনা মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে চায় কিন্তু বিপরীত মেরুতে আবেদ খান। যার জন্য তিনি মান-ইজ্জত হারিয়েছেন তাকে আশ্রয় দেওয়ার ঘোর বিরোধী। যাকে একবার বিসর্জন দিয়েছে তাকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা দ্বিতীয় বারের মত অপমান বৈ কিছু নয় বলেই তিনি মনে করেন।

সাইফের বাবা নেই। বড় ভাই মোহাম্মদ সাইদুল তাদের পরিবারের কর্তা। অবশেষে শর্তের বিনিময়ে তিনি সাইফ ও তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে রাজি হয়েছেন। বাবার সম্পদের ভাগ নিয়ে আলাদা ভাবে তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। বড় ভাই হিসেবে কখনো কোন আবদার চলবে না।

মা ও ভাবীর প্রতি তার যতেষ্ট ভক্তি। তাদের কাছ থেকে মিতালী যতেষ্ট সহযোগীতা পাবে বলেই তার বিশ্বাস। সে সহযোগীতা শুধু মিতালীর একার নয় তার অনাগত ভবিষ্যতের। ভাইয়ের অতি রক্ষনশীলতার জন্য হতাশ তবুও সামান্য যে সহযোগীতা তাতেই কৃতজ্ঞ সাইফ। মিতালীর এই দুঃসময়ে যা সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ বলেই তার কছে প্রতিয়মান হচ্ছে।

মিতালীর জীবনে এখন আর আগের সেই ছন্দ নেই। নেই পুরনো সেসব স্বপ্ন। সাইফকে সাথে নিয়ে জীবনকে যেভাবে সাজানোর পরিকল্পনা ছিল তা ক্রমেই ধুসর থেকে ধুসর হতে লাগল। সেগুলোকে এখন শুধু স্বপ্নই মনে হয়। অথচ এক সময় যা বাস্তবের খুব কাছেই মনে হত। হাত বাড়ালে যা চলে আসত তা এখন আকাশের মেঘের মত হাত বাড়িয়ে ধরা যায়না। যখন কারো মন গলে তখন বৃষ্টি হয়ে একটু ঝরে পড়ে! ছোট ছেলেটির জন্য মাঝে মাঝে নিজেকে ভিখারীর মত পরের দরজায় দাঁড়াতে হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় সব ছেড়ে দুরে হারিয়ে যেতে।

সাইফকে এখন আর নায়ক মনে হয়না, এখন সে যেন নায়ক রুপী খলনায়ক! তার প্রতি এখন ভালোবাসার চেয়ে করুনাই বেশী। তার চারপাশে কত সুখ দেখা যায়, সে সুখকে চার দেয়ালের ভিতর নিয়ে আসা যায় না। এখন মনে হয় সাইফ তার যোগ্য ছিল না।

আবেদ খান তাদের দাওয়াত করছে। পরিবার, সমাজ সবকিছু এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। শুধু স্বাভবিক হতে পারছে না তারা দুইজন। কোথাও যেন এক বিশাল অপুর্নতা! ভালোবাসা নয় যেন দ্বায়বদ্ধতাই তাদের এখনো এক করে রেখেছে। এর কারন খুঁজে মিতালী। শুধু কি অর্থ সংকটই এর কারন, নাকি অজানা ভবিষ্যতের শঙ্কা? সে স্থির করতে পরে না।

সাইফকে এখন তার অমাবশ্যা রাতের জোনাক আলোর মত মনে হয়। যে আলোতে তার চলতে কষ্ট হয়। সে চায় তাকে পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে পেতে।

(ছোট গল্প) ভালো লাগা/ মন্দ লাগা যাই হোক আপনাদের মতামত অনুপ্রেরনা হিসেবে নেব।

বিষয়: সাহিত্য

১৮১৩ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

285330
১৮ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১২:৪৯
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
১৮ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৯:৪৪
228736
মোঃ আবদুর রহিম লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
285356
১৮ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০৪:১৫
কাহাফ লিখেছেন :
সুন্দর পরিকল্পনাহীন সঠিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে চরম আবেগী কর্ম-কান্ড জীবনের সব স্বপ্নময়তা কিভাবে নিঃশেষ হয়ে যায়,সাবলীল নান্দনিক বর্ণনায় চমৎকার ভাবে গল্পে তা ফুটে উঠেছে!
অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহ জানাই..... Thumbs Up Thumbs Up Rose Rose
১৮ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৯:৪৫
228737
মোঃ আবদুর রহিম লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ। দোয়া করবেন।
285389
১৮ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৮:৫৫
মামুন লিখেছেন : খুব সুন্দর লিখেছেন! অসাধারণ অনুভূতি! ভালো লাগা রেখে যাচ্ছি। Thumbs Up Thumbs Up Thumbs Up
১৮ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৯:৪৫
228738
মোঃ আবদুর রহিম লিখেছেন : আমার ব্লগ বাড়ীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ। দোয়া করবেন।
285501
১৮ নভেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:০৭
আফরা লিখেছেন : আবেগ ছাড়া জীবন চলে কিন্তু যখন আবেগের কারনে আমরা হই বিবেক বর্জিত তখন দেখা দেয় সমষ্যা ।

গল্প ভাল হয়েছে ।
১৯ নভেম্বর ২০১৪ দুপুর ১২:৫৫
229214
মোঃ আবদুর রহিম লিখেছেন : আমার ব্লগ বাড়ীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ।
286276
২০ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:১০
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো
২০ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:৫৯
229722
মোঃ আবদুর রহিম লিখেছেন : ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File