জিহাদ ট্রাজেডি এবং কিছু কথা
লিখেছেন লিখেছেন আলোক যাত্রী ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৩:৫৯:৪৭ দুপুর
শেষপর্যন্ত গভীর পাইপে পড়ে যাওয়া শিশু জিহাদ মারাই গেল । সেই সাথে গত ২৩ ঘন্টায় এই জাতির প্রতিক্রিয়া দেখে অবাকই হতে হলো । এই ঘটনা জানাজানির পর মানুষজনের ভিড়ে উদ্ধারকাজের বিঘ্ন ঘটেছে কয়েকবার । এদের মাথায় এই নুন্যতম জ্ঞানটাও নেই যে সেখানে কোন মান্ডার তেল বা মলম বিক্রি হচ্ছে না , কোন শ্বাসরুদ্ধকর ক্রিকেট ম্যাচও চলছে না ।সেটা বোঝানোর কোন ব্যাবস্থাও নেই , লোকজনকে সরিয়ে পূর্ন মনোযোগ নিয়ে উদ্ধার কাজ করার কোন বিকারও নেই । আর এদিকে ফেসবুকে একেকজন বিভিন্ন রকম conspiracy theory কপচাচ্ছেন । কান চিলেই যে নিয়েছে শুধু তা নয় , এই চিল কে পাঠালো , কার ষড়যন্ত্র ছিল এই নিয়েও জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই । মোটকথা ঘরে-বাইরে হুজুগে বাঙ্গালীর কোন অভাব নেই ।
এই পুরো বিষয়টাকে মোটেও দুর্ঘটনা বলা যায় না । অনেকের “ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি” বলে মুখে ফেনা তোলাটাও অবান্তর । এই ধরনের অব্যাবস্থাপনার ঘটনা এর আগে ঘটেছে কমপক্ষে হাজার বার । মহাসড়কের বেহাল অবস্থার কারনে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে , ফিটনেস বিহীন লঞ্চ চামে-চিকনে অনুমোদন পেয়ে চলার সময় ডুবেছে , বিদ্যুৎ তারের যত্ততত্র ব্যাবহারের কারন শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লেগেছে। সরকার দলীয় লোক তলার অনুমতি নিয়ে তার চেয়ে তলার রানা প্লাজা বানিয়েছে , তার উপরের তলায় আবার রেখেছে ভারী জেনারেটর – দেখার কেউ নেই । দূর্নীতি করে দুই নাম্বার সিমেন্ট লাগানোর ফলে ফ্লাইওভারের কালভার্ট ধ্বসেছে । কয়েকদিন আগেই তো লক্কড়-ঝক্কড় কন্টেইনার ডুবে ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ল সুন্দরবনে । এইবার শুধু জায়গা আর বস্তুর পরিবর্তন , অব্যাবস্থাপনার ধরন কিন্তু একই ।
অথচ এইসকল ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারের কোন সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই । এটা কাজ করেনি তবে ওটা নাহলে আরেকটা ধরনের trial and error পদ্ধতিতে কাজ করে তারা ! রানা প্লাজার উদ্ধার কাজেও আমরা দেখেছিলাম উদ্ধারের সরঞ্জাম নেই । কোন গভীর জায়গায় লঞ্চ ডুবলে নিরুপায় হয়ে অপেক্ষা করতে হয় কবে লঞ্চটা আপনাআপনি ভাবে ভেসে উঠবে । কালকেও যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলাম – একবার বস্তা ফেলছে , একবার জুস ফেলছে ,আরেকবার রশি ফেলছে । যখন একজন নামতে চাইল তখন তখন তাকে থামিয়ে পাইপে ভিডিও পাঠানো হলো । ভিডিওর ক্যামেরায় যখন 320 দেখা তখন সবাই ৮০ ফুট গেছে । যখন লেখা ২৫৪ তখন তারা বলল ২৫৪ ফুট গভীরে চলে গেছে – দক্ষ লোকদের হচ্ছে এই দশা ! আধঘন্টা ধরে ভিডিও পাঠিয়ে আবার আধাঘন্টা ধরে তোলা হলো এটা কি উদ্ধারকাজ নাকি দেখার কাজ আমার বোধগম্য হলো না । এক পর্যায়ে পাইপে ছেলেকে খুজে না পেয়ে সরকারের প্রতিনিধি বলেই ফেলল , পাইপে পরে যাওয়ার ঘটনা আসলে গুজব । আজকে দুপুরে যখন “প্রফেশনাল”-রা পাইপের ভেতর কিছু নেই নিশ্চিত হয়ে তল্পিতল্পা গুছিয়ে চলে যাচ্ছে তখন এলাকার পোলাপান মিলে পাইপের আকৃতির সিলিন্ডার রড বানিয়ে সেই ছেলেকে আধঘন্টার মধ্যে তুলে আনলো । আর ২৩ ঘন্টায় সব টেকনিক্যাল মানুষের মাথায় এই বুদ্ধি আসলো না ।
এই ধরনের অব্যাবস্থাপনা যেকোন দুর্যোগ , দুর্ঘটনা মোকাবেলায় অহরই হচ্ছে । অবকাঠামো সংক্রান্ত কাজে দুর্নীতির ক্ষেত্রেও তাই । এমন একেকটা ঘটনা ঘটে আর মানুষ হুজুগের তালে চিল্লাফাল্লা করে । তারপর তদন্ত কমিটি হয় জড়িত থাকা লোকদের বরখাস্ত , গ্রেফতার করা হয় । কয়েকদিন পর আবার সব কিছু আগের মতো । গ্রেফতার করা ব্যাক্তি জামিন নিয়ে বের হয়ে পরে , তদন্ত কমিটিরও কোন খোজ থাকে না । আবার কয়েকদিন পর এমন ঘটনা ঘটে আবার । যেই কারখানায় বিস্কুট তৈরী হয় সেই খানে যদি আটার জায়গায় বালুও ঢালেন তাহলেও সে অনুপাতিক হারে চিনি , ময়দা ইত্যাদি মিশিয়ে বিস্কুটই বানিয়ে দেবে, অন্যকিছু না ।যেই সমাজের সিস্টেমই এমন সেখানে হাজার পদক্ষেপ নিলেও এই সকল ঘটনাএ সঠিক ব্যাবস্থা নেয়া হবে না ।
জিহাদের মৃত্যুকে নির্ধারিত সময় থেকে কেউ একচুলও নড়াতে পারতো না কারন আল্লাহ এই সময়কে নির্ধারিত করেছেন । কিন্তু এই খোলা পাইপ রেখে দেয়া , কর্তব্যে গাফিলতি করার জন্য দায়ী ব্যাক্তিদেরও আল্লাহ সেরকমভাবেই পাকড়াও করেবেন । আল্লাহ বলেছেন একটা মানুষকে বাঁচানো মানবজাতিকে বাঁচানোর শামিল , এই সিস্টেম তো সেটা মানুষকে শেখায় না , মানুষ বাভানোর গুরুত্ব কিভাবে বুঝবে সবাই ! আল্লাহ কর্তব্যে গাফিলতি , দুর্নীতিকে করেছেন নিষিদ্ধ । আর এই রাষ্ট্রযন্ত্রে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে স্বাভাবিক বিষয় । এই সকল অবহেলার কারনে আমাদের পরিবার পরিজন আত্মিয় স্বজন কয়েকদিন পর পর বিল্ডিং চাপায় , পিলারের চাপায় পড়ে , আগুন মরে , পানিতে ডুবে , পাইপে পড়ে । ববাবরের মত এবারও মনে হয় অনিয়মকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য সরকারের সেই প্রতিনিধি “আল্লাহর মাল আল্লাহয় নিয়ে গেছে” ঘরনার বক্তব্য দিবে ।
হাশরের ময়দান জিহাদ সহ রানা প্লাজার , বহদ্দারহাটের মানুষগুলো আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে ক্ষতবিক্ষত আর থ্যাতলানো শরীর নিয়ে এবং উত্তমভাবে বেচে না থাকার অভিযোগ নিয়ে । এই সকল ঘটনার সাথে মানুষগুলোর অবস্থা সেদিন কি হবে ! আর আমাদের কি হবে যেখানে আমরা যারা এই অবস্থাকে এভাবেই চলুক বলে ছেড়ে দিয়েছি ? যারা পরিবর্তনের কথা না বলে নিরব থেকে সমর্থন দিয়েছি এসব অসঙ্গতি কে ?যেই আল্লাহর দেয়া ব্যাবস্থার প্রতিনিধিরা পেরেশান থাকত পশুপাখিরা পর্যন্ত অনিয়মের স্বীকার হয় কিনা এ নিয়ে ! সেই ব্যাবস্থা থাকলে হয়ত তাদের এভাবে মরতে হতো না । সবাই মিলে ন্যায়ের , ন্যায্য অধিকারের পরিবেশটা পাওয়ার জন্য সেই ব্যাবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য কোন পদক্ষেপ কি এনেছি !? নাহলে সেই অভিযোগ থেকে কি আমরা গা বাচাতে পারবো সেদিন !!!???
বিষয়: বিবিধ
১০৯৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
১৯৯৬ এ যখন বঙ্গবাজার পুড়ে যায় তখন ঢিল ছোড়া দূরত্বে থাকা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের হেড অফিসের লোকেরা সেটাকে ঠেকাতে পারে নি ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন