অবক্ষয়-২
লিখেছেন লিখেছেন আলোক যাত্রী ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৮:৫১:২৮ রাত
বাসের মধ্যে ভাড়া নিয়ে গ্যাঞ্জাম হওয়া যেন এক প্রত্যহ ঘটনা । বেশি ভাড়া হওয়ার কারনে তৈরি হওয়া রাগ গুলো সব পড়ে বাসের কন্ডাক্টারের উপর –যেন ভাড়াটা সেইই নির্ধারন করেছে । ঠিক এমন ঘটনাই দেখা যায় কোন কিছুর দাম বাড়ার সময় ; দোকানদার দাম বাড়ায়নি জানা কথা তবুও কেন যেন সবাই ঝাড়িটা সেই নিরীহ দোকানদারকেই মারে । পাবলিক পরিক্ষাগুলোর (এস.এস.সি/এইচ.এস.সি) রেজাল্ট বের হওয়ার সময় একটা কথা খুব প্রচলিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে , ‘আমার খাতা যে স্যার দেখসে তিনি বাজার করে এসে দেখসে/ বউয়ের ঝগড়া করে দেখসে , মেজাজ চড়া ছিল তাই নাম্বার দেয় নাই ।‘ অফিসের ঝামেলা শেষ করে , ৩ ঘন্টার জ্যাম পেরিয়ে , টুকটাক বাজার করতে গিয়ে জিনিসপত্রের চওড়া দাম দেখে বাসায় গিয়ে সবার সাথে চওড়া মেজাজ দেখানোই এখন মধ্যবিত্তদের কালচার । মশা যদি কাধের উপর বসে তাহলে কিন্তু থাপ্পড়টা গালে দেই না , কাধেই দেই । কিন্তু অন্যসব জায়গাতে আমরা যেন উলটো কাজটাই করি ।
এই পৃথিবী সৃষ্টির সময় সীমানা ছিল না । স্রষ্টার যদি মনে হত যে সংস্কৃতির ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গায় সীমারেখা দিয়ে দেই তাহলে তখনই দিয়ে দিতেন । এখন তো মানুষ পৃথিবির মধ্যে নিজের মনমত সীমারেখা দিয়েছেই তার উপর সেটা নিয়ে সস্তা বড়াই করাটা উচু মাপের মনসিকতা বলে গন্য হচ্ছে ! সেই সীমারেখার মধ্যে বাইরের লোক আসলে ধরে নিয়ে যাওয়া একটি প্রতিরক্ষামূলক কাজ ! এই বড়াইয়ের জন্য এখন নৃশংসভাবে হত্যা করাটা যেন বীরত্ব ! সীমানা আগে ছিল তো নাই , জায়গাও আমার না ; কিন্তু এটা নিয়েই এতো বড়াই ! এই পরিস্থিতি দেখে রবিন্দ্রনাথের ‘ভক্তিভাজন’ কবিতাটা মনে পড়ে যায় -
"রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম–
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে ’আমি দেব’ রথ ভাবে ’আমি’,
মূর্তি ভাবে ’আমি দেব’, হাসে অন্তর্যামি"
‘অবক্ষয়’ লেখা শুরু করেছিলাম ফেলানি হত্যা দিবস উপলক্ষেই । ২ দিনও হয়নি ফেলানি হত্যাকারীকে নির্দোষ ঘোষনা করা হয়েছে । মজার বিষয় হলো কয়েকদিন আগেই যারা মানবাধিকারের সংজ্ঞাসহ উদাহারনটা ভারত থেকেই নিত তারা পর্যন্ত এই রায়ের বিরোধিতা করছে । কেউ যদি তার নিজের বানানো(!?) জায়গাটাকে হুমকির(!?) মুখে দেখে তাহলে সেটা দোষের কি আছে !! এতো জ্ঞানী-গুনি-বুদ্ধিজীবিরা এই কথা টাই বুঝতে পারছে না । আসলে যখন রোহিঙ্গা মুসলিমরা অত্যাচারিত হয়ে বাংলাদেশের কাছে আশ্রয় চাইছিল তখন বাংলাদেশের এই বুদ্ধিজীবীরাই জাতিয়তাবাদের চেতনায় উজ্জিবিত হয়ে তাদের লাথি মেরে ভাগিয়েছে । তারা যেমন বাংগালি ফেলানিকে মানুষ মনে করেনি তেমনি আপনারাও কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিজ দেশি না বলে মানুষ মনে করেননি । জাতিয়তাবাদটা এমনই !!!!
যাই হোক, এই ঘটনার পর প্রতিক্রিয়াশীল বাঙ্গালী জনতা অনেক ধরনের প্রতিক্রিয়া, ক্ষোভ প্রকাশ করছে । এবং অনেক ধরনের সমাধানও দিচ্ছে । লাক্স সাবানের মোড়ক দু-তিন মাস পর পরই বদলায় আর বলা হয় ‘নতুন লাক্স’ আসলে ভেতরে সেই পুরোনো গন্ধে ,ফ্লেভারের লাক্সই পাওয়া যায় । সেরকমই এইধরনের সমাধানগুলো দেখতে অনেক ফ্লেভারের হলেও আসলে এগুলো একই ধরনের । যেমন ধরুন ভারতিয় পন্য বর্জন করুন !! যে ভারত পেয়াজ না পাঠালে পেয়াজের দাম দ্বি-গুন হয়ে যায় সেই ভারতের পন্য বর্জন করলে লাভটা হবে কার তার চেয়ে বড় কথা ভারত সরকারের এতে কিছুই যায় আসবে না । এই পিয়াজের চাহিদা অন্য দেশে আরো বেশি সেখানে রপ্তানি করে ভারতের লাভ বরং বেশিই হবে । আর ব্যাক্তিগতভাবে যতই পন্য বর্জন করি না কেন ;ভারতের চাল ,ডাল ,মোবাইল , এমনকি ফেন্সিডিল পর্যন্ত বাজারে খুবই সহজলভ্য । আর এই সব পন্য আমদানি করে কে জানেন রায় নিয়ে যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এতো হমতম্বি করছে তারই সরকার !!! তবুও পন্য বর্জনের আন্দোলন শুরু হবে খুব জোশে । তারপর দিওয়ালিতে ক্রিশ-৩ বের হবার সাথে সাথে আন্দোলন নিস্তেজ হয়ে যাবে !
এখানে একটা বিষয় খুব ভালো করে চিন্তা করা দরকার । ফেলানিকে যে হত্যা করেছে সে প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন কর্মচারী যারা শুধু ‘উপরের নির্দেশ’ মেনে চলে । এখন উপর খুজতে খুজতে বের হবে আর্ফি চিফ পর্যন্ত । আর আর্মি চীফ কিন্তু সরকারেই অধীনে । তাই শুধু সেই সৈন্য দোষী নয় বরং যারা সরকার ব্যাবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে তারা পর্যন্ত দায়ী । সুতরাং যেখানে বিচারের কাঠামো , অভিযোগের ভিত্তিটাই ঠিক নেই সেখানে আমরা রায় নিয়ে চিল্লা ফাল্লা করছি ! কি হাস্যকর !
দোষ কি শুধু তাদেরই ! ৪২ বছর ধরে ফারাক্কা বাধ চলছে কিন্তু দেশের মোড়লরা টু শব্দ করছে না । পশ্চিম বঙ্গের সীমান্তে ৫ হাজারের মতো ফেন্সিডিলের কারখানা আছে যেখান থেকে অনবরত ভাবে ফেন্সিডিল বেনাপোল দিয়ে ঢুকছে । সেখানে গরু চোর ঠিকই ধরা খায় এবং পেপারেও সেটা ফলাও করে আসে কিন্তু টনের পর টন ফেন্সিডিল ঢুকছে আর যুবসমাজে ধ্বংস হচ্ছে সেটা ধরা তো দূরে থাক এটা কোন মাথাব্যাথা তাদের নেই । তাদের মাথাব্যাথা হলো ‘মা দুর্গা’ কবে গজে চড়ে আসবেন আর একটি ‘বাম্পার ফলন’ উপহার দিয়ে যাবেন ! সমস্যা আসলে আমাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতিতে – সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সংগে শত্রুতা নয় ; সোজা কথায় শক্তের ভক্ত নরমের যম । একারনেই রোহিঙ্গাদের নেকড়ের মতন তাড়িয়ে দেয়া আর ফেলানি সহ ভারতের সকল ইস্যুতে নেড়ি কুকুরের লেজে পারা দেয়ার মতো আর্তনাদ করেই শেষ ।
একটি গাছ যখন আপনি কাটতে চাইবেন তখন তার শাখা কাটলে কিন্তু গাছটা কাটবে না –কয়েকদিনের মাঝেই দেখবেন কাটা শাখার জায়গাটা থেকেই নতুন পাতা গজিয়ে শাখার সুচনা করেছে । আসলে গাছ কাটতে হয় মূলে আঘাত করে । বাসের ভাড়া নিয়ে বেতনভুক্ত কর্মচারির সাথে ‘ফাপড়’ না ছেড়ে পারলে কর্তৃপক্ষের কাছে যান । দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতি কেন সেটা সমাধানের জন্য এই অর্থনীতি নিয়ে জানুন পড়ুন । ঠিক তেমনি আপনি যদি এসবের পরিবর্তন চান তাহলে যেতে হবে সমস্যার মূলে । নাহলে চিন্তা চিন্তার জায়গায়ই থাকবে , সমস্যা সমস্যার জায়গায়ই থাকবে , কোন সমস্যার সমাধান হবে না ।
জীবন সম্বন্ধে পরিপুর্ন চিন্তা না থাকাটা এক নিদারুন অবক্ষয় ...
সরাইখানা
৮ই সেপ্টেম্বর ২০১৩
বিষয়: বিবিধ
১৪১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন