মদীনার সৌরভে সুরভিত হৃদয় -০১

লিখেছেন লিখেছেন কথা সত্য ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৯:৩২:৩৬ রাত

১৯ জানুয়ারী ২০১৩। সেদিন শনিবার। কাতারের রাজধানী দোহার আল সাদে অবস্থিত কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ক্যাম্পাস থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশে আমাদের যাত্রা শুরু হল বেলা এগারটায়। বেলা দেড়টায় ফ্লাইট। কাতার এয়ারওয়েজের একটি প্লেন আমাদেরকে নিয়ে উড়ে যাবে মদীনায়। এখান থেকে মদীনার দূরত্ব প্রায় এক হাজার মাইল। তবুও যেন অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না। আর কতক্ষণ পর মদীনার আলো বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবো- সেই সৌভাগ্যময় মুহুর্তটির অপেক্ষায় অস্থির হয়ে আছি আমি।

আমাদের কাফেলার সদস্য সংখ্যা ১৫ জন। ১০ জন ছাত্র এবং বাকী ৫ জন আমাদের আবাসিক ক্যাম্পাস কর্মকর্তা। ছাত্রদের মধ্যে এশীয় ৩ জন, আফ্রিকার ৪ জন এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরবীয় ৩ জন। পুরো সফরের মেয়াদ মাত্র ৭ দিন। প্রথম ৩ দিন মদীনায় এবং তারপর বাকী দিনগুলো মক্কায়। শনিবারে যাত্রা শুরু হল এবং আগামী শুক্রবার মক্কার মসজিদে হারামে জুমার নামাজ আদায়ের মাধ্যমে এর সমাপ্তি।

প্রায় আড়াই ঘন্টা প্লেনটি আকাশে উড়ল। বিকেল চারটা। সূর্যের আলো এখন যাই যাই করছে। সন্ধ্যা নামছে। আমরা তখন মদীনার বিমানবন্দরে। ইমিগ্রেশন শেষ করে বের হতে হতে আরও প্রায় পৌনে এক ঘন্টা। আমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চারপাশের দিকে তাকিয়ে আছি। এই তো সেই মদীনা- কোটি কোটি মুমিন মুসলমানের আবেগ ও ভালোবাসার এই তো তীর্থস্থান। কি স্নিগ্ধ ও মায়াময় এর পরিবেশ। রোদের উত্তাপ নেই, বাতাসের ঝাপটা নেই, প্রকৃতিও যেন এখানে অবনত। এক নিরব চাদরে আমাকে ঢেকে দিল মদীনার প্রথম প্রহর।





মদীনার বিমানবন্দরে প্রায় সবাই বাংলাদেশী কুলি। ওদের কাজ হুড়মুড় করে যাত্রীদের লাগেজ ট্রলিতে ভরে তাকে স্ক্যানার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। তাদের হাঁক ডাকে মদীনার শান্ত কিন্তু ছোট বিমানবন্দরটি সদরঘাট হয়ে উঠছিল। আমি ভেবেছিলাম, মদীনার মেহমানদেরকে সমাদর করার জন্যই বুঝি বাংলাদেশী শ্রমিকদের এত তোড়জোড়। নবীর অতিথিদেরকে সাহায্য করার জন্য তাদের নিয়োগকর্তার পক্ষ থেকে হয়তো এভাবেই বলে দেয়া আছে। আমার এ আনন্দ বিষাদে পরিণত হলো তাদের দুঃখের গল্প শুনে।

প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একনাগাড়ে যাত্রীদের লাগেজ আর ব্যাগপত্র টানতে হয় ওদের। স্বেচ্ছায় নয়, পেটের দায়ে টানতে হয়। তারপর কুলিদের মতো হাত পেতে পেতে যাত্রীদের কাছ থেকে ১৫, ২০ কিংবা ২৫ রিয়াল আদায় করতে হয়। কারণ কোম্পানীর কর্তাকে সারাদিন বাবদ জমা দিতে হবে ১১০ রিয়াল। বাদবাকী যা থাকবে তা নিজের। এই ১১০ রিয়াল উঠিয়ে নিজের জন্য কিছু রাখতে হলে এমন হাউকাউ আর চেঁচামেচি করে লাগেজ টানাটানি এবং অতঃপর হাত পাতা ছাড়া তাদের গতি নেই।

কারণ অধিকাংশ যাত্রী নিজের ব্যাগ নিজেই হাতে করে নিয়ে যেতে চান। তারা খুঁজে খুঁজে মহিলা ও বৃদ্ধ যাত্রীদের কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে ট্রলিতে করে পার করে দেয়। তারপর গেট পার হওয়ার পর বখশিশের জন্য হাত পেতে অনুনয় বিনয়। এসব দেখে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আগত মদীনাগামী যাত্রীরা বাংলাদেশী কুলিদেরকে লোভী ও ঠগবাজ ভাবলেও তারা তো আর জানেন না যে দিনশেষে ১১০ রিয়ালের জমা জমে আছে এ অসহায় লোকটির ঘাড়ে। তাকে তো এভাবেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে।



এর ফাঁকে তাদের কিছু ছবি তুলে নিলাম। তারপর আমাদের জন্য নির্ধারিত বাসে গিয়ে উঠলাম। বাস রওয়ানা হচ্ছে মসজিদে নববী লাগোয়া দিয়ার ইন্টারন্যাশনাল হোটেল উদ্দেশে। মদীনায় থাকাকালীন এ হোটেলই আমাদের আবাসস্থল।

বাস চলছে। মদীনার সাদামাটা পথঘাট। তবুও এখানে ভীড় ও যানজট। অত্যন্ত বেদনার বিষয়, মদীনার রাস্তাঘাটে এখানে ওখানে ময়লা আবর্জনা পড়ে আছে। কোন কোন জায়গা নোংরা এবং ধুলোবালিতে ভরা। প্রিয়তম নবীর পবিত্র ও বরকতময় নগরী মদীনার এমন মলিন দৃশ্য আমাকে ব্যথিত করেছে। মুসলমানদের অন্যতম এ মিলনমেলা ও তীর্থস্থানকে সামনে রেখে ব্যবসা বাণিজ্যের জোয়ার চারিদিকে। মদীনার পথে পথে ব্যবসা আর বাণিজ্য। মদীনাবাসীর দেখা নেই। চারিদিকে শুধু অনারব আর ব্যবসায়ীদের হাঁকডাক। খামসা রিয়াল, আশরা রিয়াল, ইয়া হাজ্জি- এসব চিৎকারে হারিয়ে যাচ্ছে মদীনার শান্ত ও সুনসান অলিগলির দৃশ্যপট।

সহসাই বাসের ভেতর ডাকাডাকি। আমার সহযাত্রীরা ডাকছে। তারা আমাকে মসজিদে নববীর সুরম্য মিনারা দেখাতে চাচ্ছে। একে অন্যকে ডেকে ঐ আলোকিত মিনারা দেখানোর মধ্যেও লুকিয়ে আছে ভালোবাসার আনন্দময় প্রকাশ। কারণ ঐ যে নবীর মসজিদের মিনার। ওখানেই তো শুয়ে আছেন আমাদের প্রিয়তম পিয়ারা রাসূল।

আমার দৃষ্টিশক্তি ভয়াবহ পর্যায়ের দুর্বল। সামান্য তিন মিটারের বেশি দূরত্ব আমার কাছে অস্পষ্ট ও অন্ধকার। কাজেই তাদের ডাক যেন না শুনতে হয়, সেজন্য হেলান দিয়ে ঘুমের ভান করে রইলাম। মিনারা দেখতে গিয়ে আমার ব্যর্থ প্রয়াস তাদেরকে হয়তো আহত করবে নয়তো হাসির খোরাক হবে, দুটোই আমার জন্য বেদনাকর। আমি সযতেœ সেসব থেকে এড়িয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমি চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে তাদের আনন্দধ্বনি ও আবেগমাখা দরুদ ও সালাম শুনতে লাগলাম।

বাস থামল। আমরা নেমে আমাদের যার যার রুম বুঝে নিলাম। মাগরিবের আযানের আর বেশি বাকি নেই। আমি মসজিদের দিকে ছুটলাম। মাগরিবের পর তার কাছে হাযির হবো। তাকে আমার সালাম পেশ করবো। আনন্দময় আবেগ ও উত্তেজনা এবং সেইসাথে এক বুক ভয় আমাকে মোহগ্রস্ত করে রেখেছে।

রাসূলে পাকের রওযায় হাজির হওয়ার মুহুর্তগুলো অনুভবের, সেসব না হয় গোপন থাকুক। চলে আসছি মসজিদে নববী প্রসঙ্গে।



দশ বছর আগে দেখা মসজিদে নববীর সাথে এখনকার তেমন কোন পার্থক্য নেই। এখন সন্ধ্যা। চারিদিকে আলো ঝলমলে পরিবেশ। সুবিশাল চত্বর ছড়িয়ে আছে মসজিদের চারপাশজুড়ে। মানুষ আসছে, পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে নবীর প্রেমিক উম্মতেরা। সারা বছর এখানে একই রকম দৃশ্য। হজ্বের সময় ভিন্ন কথা।



এখানে ওখানে বসে আছে অজস্র মানুষ। পরিবারসহ বসে আছে অনেকে। তাদের সাথে ফ্লাস্কভর্তি চা, হালকা খাবার। মসজিদে নববী ঘিরে প্রিয়তম রাসূলের জন্য এ যেন মানববেষ্টনী। কি এক ভালোবাসা আর মায়ার টানে ছুটে আসছে মানুষ, দিন-রাত তারা সদাব্যস্ত ও কোলাহলমুখর করে রেখেছেন নবীর নগরীকে। বছরজুড়ে সবচেয়ে বেশি মুসলমান আসছেন ইন্দোনেশিয়া থেকে। মিসর, পাকিস্তান, তুর্কি থেকে আসা অতিথিদের সংখ্যাও অনেক। আমি চারিদিকে তাকিয়ে থাকি। মদীনার সুশীতল বাতাস বড় স্নিগ্ধ ও মায়াময় মনে হয়। মদীনার প্রেমে রাসূলের টানে ছুটে আসা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মুখে চির প্রশান্তির হাসি আমাকে মুগ্ধ করে চলেছে। কোথাও হৈ হুল্লোড় নেই, চিৎকার চেঁচামেচি নেই, অথচ নানা বর্ণের নানা মানুষ একসাথে এ আঙিনায়- প্রিয়তমের সান্নিধ্য প্রাপ্তির অপূর্ব আনন্দ খেলা করছে মানুষগুলোর চোখেমুখে। কি সৌভাগ্যবান এ প্রেমিকদল, আমিও কি আজ তাদের একজন!!

অসমাপ্ত

বিষয়: বিবিধ

১৩২৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File