শহীদ কিংবা শাহাদাত নিয়ে তামাশা নয়

লিখেছেন লিখেছেন কথা সত্য ২০ এপ্রিল, ২০১৩, ১২:৫৫:৩৮ দুপুর



সা¤প্র্্রতিক সময়ে বাংলাদেশ একটি উত্তপ্ত এবং উত্তাল সময় পার করছে। রাজনৈতিক সহিংসতার পরিস্থিতি তো বটেই, সাধারণ সময়েও অজ্ঞাত কারো হাতে কেউ নিহত হলে আমরা তাকে শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করতে আগ্রহী হই। তার নামের আগে শহীদ শব্দটি লাগিয়ে নিজেরা গর্ব বোধ করি। আবার হয়তো অনেক ক্ষেত্রে কোন মৃত ব্যক্তিকে শহীদ হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ থাকার পরও অসচেতনতাবশত আমরা তা এড়িয়ে চলি। ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজের এমনই কিছু ধারণা এবং দাবীদাওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে এ লেখাটিতে।

শহীদ শব্দের আভিধানিক অর্থ বেশ কয়েকটি হতে পারে। তবে সেসবের মধ্যে অন্যতম গ্রহণযোগ্য হচ্ছে- শাহাদাত বা সাক্ষ্য প্রদান থেকে এর উৎপ্িত্ত এবং সেটি কৃত অর্থে ধর্তব্য। সুতরাং তখন শহীদ শব্দের অর্থ যার জন্য জান্নাতের সাক্ষ্য দেয়া হয়েছে। অথবা মুশাহাদা বা প্রত্যক্ষ করা থেকে উৎপত্তি এবং তখন অর্থ হবে- সে আল্লাহ পাকের ফেরেশতা এবং জান্নাতের প্রত্যক্ষদর্শী। এ ছাড়াও আরও অনেক অর্থ হতে পারে এবং প্রায় সবগুলো অর্থই কাছাকাছি।

শহীদের সংজ্ঞা নিয়ে খুব সামান্য মতভেদ থাকলেও ফক্বিহ ইবনে আবিদীন রহ. তাজুল উরস নামক হানাফী মাযহাবের ফিকহী কিতাবে যা লিখেছেন- শহীদের পরিচয় হিসেবে সেটি উল্লেখযোগ্য এবং অর্থবহ। এর সারমর্ম হল, যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান, যাকে অন্যায়ভাবে কোন অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয়েছে, তাকেই শহীদ বলা হয়। বিদ্রোহীদের হাতে নিহত সাধারণ মুসলমান কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের হাতে নিহত ব্যক্তি এবং ডাকাতের আক্রমণে খুন হওয়া ব্যক্তিকেও শহীদ বলা হয়ে।

পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা বাকারায় ১৫৪ নং আয়াতে আল্লাহ পাক শহীদদের সম্পর্কে বলেছেন, যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তাদেরকে তোমরা মৃত ভেবো না। বরং তারা তো জীবিত এবং তাদের রবের কাছ থেকে তারা রিযিক পেয়ে যাচ্ছেন।’ সূরা আলে ইমরানের ১৬৯ নং থেকে ১৭১ নং আয়াতেও শহীদদের আত্মা এবং পরকালে তাদের আনন্দ সম্পর্কে আল্লাহ পাক আমাদেরকে জানিয়েছেন। এ ছাড়াও শহীদ শব্দটি সূরা তওবার ১১১ নং আয়াত, সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াত, সূরা যুমার এর ৬৯ নং আয়াত এবং সূরা আলে ইমরানের ১৪০ নং আয়াতেও এসেছে।

বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. বলেছেন, শহীদ কখনো তাকে হত্যা কিংবা আঘাতের কষ্ট অনুভর করে না। তার কাছে ঐসব আঘাত সামান্য খামচির মতো অনুভূত হয়। (নাসাঈ-৩১৬১, তিরমিযী-১৬৬৮, ইবনে মাজাহ-২৮০২)

এক হাদীসের সারমর্ম এমনও বর্ণিত হয়েছে যে, শহীদ ব্যক্তি জান্নাতে তার সম্মান এবং পুরস্কার দেখে বারবার সে আশা করবে, হায় যদি সে দুনিয়াতে ফেরত যেতে পারতো এবং আবারও শহীদ হতে পারতো। একবার নয়, দশবার যদি সে শহীদ হওয়ার সুযোগ পেতো!! (বুখারী-২৮১৭) আরেক হাদীসে রাসূল সা, বদর যুদ্ধের শহীদ হারেসার মাকে বলেছেন, তোমার ছেলে তো এখন জান্নাতের সর্বোচ্চ ফেরদাউসে বিচরণ করছে। (বুখারী-২৮০৯) একজন শহীদের সব গুনাহ আল্লাহ পাক নিজের দয়াগুণে মাফ করে দেন। তবে তার কাছে যদি কেউ পাওনা থাকে- সেটি ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। (মুসলিম-১৮৮৫) তিরমিযী শরীফের ১৬৬৩ নং হাদীসে বর্ণিত শহীদের সম্মান জানাতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল সা. আরও বলেছেন, কিয়ামতের দিন একজন শহীদ তার কাছের মানুষদের মধ্য থেকে সত্তরজনের জন্য সুপারিশ করার সুযোগ পাবে।

ঘটনাভেদে মৃত্যুর ধরণ ও কারণ ভিন্ন হলেও শহীদ মূলত দু প্রকার। হাদীস শাস্ত্রের প্রবাদ পুরুষ ইমাম নববী রহ. এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে শরহে নববীতে ২য় খন্ডের ১৬৪ নং পৃষ্ঠায় বিশেষ ভাবে এ দু শ্রেণীর শহীদের কথা বলেছেন।

আল্লাহ পাকের দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে কাফের শত্র“দের হাতে যাদের মৃত্যু হয়, চাই তা যে কোনভাবে হোক, তারা প্রথম শ্রেণীর ‘শহীদ’। দুনিয়া এবং আখেরাত- উভয় বিবেচনায় তারা সর্বোত্তম শহীদ। শরীয়তের নিয়মমতো এদেরকে তাদের পরনে থাকা কাপড় এবং গায়ে লেগে থাকা রক্তসহ দাফন করতে হয়। আর কাল কিয়ামতের মাঠে এটাই তাদের জন্য জ্বলজ্যান্ত সাক্ষ্য হবে।

দ্বিতীয় শ্রেণীর শহীদ- যারা আখেরাতে মর্যাদার বিবেচনায় শাহাদাতের সম্মান পাবেন, কিন্তু দুনিয়ায় তাদেরকে সাধারণ মৃতদের মতো গোসল করিয়ে কাফনসহ দাফন করতে হয়। এ শ্রেণীর মধ্যে রয়েছেন, পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী মরহুম, প্লেগরোগে মৃতব্যক্তি, কোন কিছু ধ্বসের নীচে চাপা পড়ে নিহত ব্যক্তি, নিজের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে অন্যায়ভাবে নিহত ব্যক্তি, পানিতে ডুবে নিহত মানুষ। গর্ভধারিণী মহিলার মৃত্যু হলে তাকেও শহীদ বলে গণ্য করা হবে। (আবু দাউদ এবং ইবনে মাজাহ)

তবে মৃত্যু পূর্ববর্তী সময়গুলোতে তারা ধৈর্যশীল ছিলেন কিনা এবং দ্বীন কিংবা দ্বীনি কোন বিষয়ে তারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন কিনা- সেটিও এখানে বিবেচ্য। আর এসব কারণে প্রাণহারানো নিহতদের বেলায় শহীদ শব্দটি ব্যবহৃত হলেও আখেরাতে মর্যাদার বিবেচনায় তারা প্রথম শ্রেণী থেকে সামান্য নীচু অবস্থানে।

মহান আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করতে গিয়ে প্রাণহারানো বীরদের সাথে অন্যসব প্রকারের কোন তুলনা হতে পারে না। শহীদদের মধ্যে এমন পার্থক্য বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য আরও দেখতে পারেন আল্লামা ইবনে হাজার এর ফাতহুল বারী, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মজমুঊল ফাতাওয়াসহ হাদীসের যে কোন গ্রহণযোগ্য গ্রন্থের শাহাদাত ও শহীদ অধ্যায়ে। যেমন- মুসনাদে আহমদ-১৭২০৪ নং হাদীস, সহীহ তারগীব-১৩৭০ নং হাদীস, আবু দাঊদ-১৪৪৯ নং হাদীস, নাসাঈ-২৫২৬ নং হাদীস।

এসব হাদীসের আলোকে আরেকটি বিষয়ে এখানে দৃষ্টি আকর্ষন করা যেতে পারে। আমাদের দেশে অহরহ অগ্নিকান্ডের দূর্ঘটনায় নিহত হচ্ছেন অজস্র গরীব নিরীহ নর-নারী। নদীপথে লঞ্চডুবিতে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যাও হাতে গোনা নয়। পাহাড় ধ্বস এবং সেতু-ব্রিজ ভেঙেও মারা যাচ্ছেন অনেক অসহায় মানুষ। অথচ হাদীসের কিতাবসমূহে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকার পরও এ লোকগুলোর বেলায় তাদের প্রাপ্যসম্মানটুকু আমরা জানাচ্ছি না। প্রিয়নবী সা. বলেছেন, আগুনে পুড়ে যাদের মৃত্যু ঘটে এবং কোনকিছু ধ্বসে যাওয়ার কারণে যারা প্রাণ হারায়, তারা আল্লাহ পাকের কাছে ‘শহীদ’হওয়ার গৌরব ও সম্মান লাভ করেন। (আহমদ-২৩৮০৪, আবু দাঊদ-৩১১১, নাসাঈ-১৮৪৬) ইবনে মাজাহ এবং আবু দাউদে জাবের বিন আতীক রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণকারীদেরকেও শহীদ বলা হয়েছে।

শহীদের লাশ কবরে অবিকৃত থাকে। মহান আল্লাহ পাক শহীদ বান্দার প্রতি সম্মান দেখিয়ে তার লাশকে মাটিতে পচে গলে যাওয়া থেকে হেফাযত করেন। ইতিহাসের অসংখ্য ঘটনায় এর প্রমাণ রয়েছে। সাহাবী জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. এর বাবার লাশ ছয় মাস পর উত্তোলনের ঘটনা, মুআবিয়া রা. এর আমলে হামযা রা. এর লাশ তোলার ঘটনা, তালহা বিন উবায়দুল্লাহ রা.সহ আরও অনেক সাহাবায়ে কেরাম- যারা বিভিন্ন জিহাদে শহীদ হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রয়োজনে তাদের লাশ উঠাতে হয়েছে- সবার দেহ ছিল অবিকৃত এবং জীবিত মানুষের মতো তরতাজা।

বিভিন্ন হাদীস থেকে মুহাদ্দিস এবং ফক্বীহগণ আরও বলেছেন, কয়েকটি বিষষ মানুষকে শাহাদাতের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে। এসবের মধ্যে জিহাদে গিয়ে খেয়ানত করা, মানুষের ঋণ পরিশোধ না করা, মা-বাবার অনুমিত ছাড়া জিহাদে অংশগ্রহণ করা অন্যতম। এগুলোর কোনটি পাওয়া গেলে তাকে শহীদ হিসেবে বিবেচনা করা শরয়ী দৃষ্টিতে প্রশ্নসাপেক্ষ।

সুতরাং যে কোন মুসলমান অন্যায়ভাবে নিহত হলে তাকে শহীদ হিসেবে গণ্য করা যাবে। চাই হত্যাকারী মুসলমান হোক কিংবা অমুসলিম। তবে আল্লাহার দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য যারা কাফেরদের সাথে সশস্ত্র জিহাদে নিজেকে বিলিয়ে দেয়- চাই সে জিহাদ আক্রমনাত্মক হোক কিংবা প্রতিরোধমূলক- তারা প্রথম শ্রেলী এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার শহীদ হিসেবে সম্মানিত। এদেরকে ছাড়া অন্য সব প্রকার এবং শ্রেণীর মৃত মানুষকে পৃথিবীতে সরাসরি শহীদ আখ্যায়িত করা নিয়েও উলামাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে নিয়ত এবং অন্যান্য শর্তসমূহ বিদ্যমান থাকলে আখেরাতের মর্যাদায় তারা সে সম্মান পাবেন।

এছাড়া নিজের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে ডাকাতের হাতে প্রাণবিসর্জনকারী মুসলমান যেখানে শহীদ হিসেবে বিবেচ্য, সেখানে দেশ এবং স্বাধীনতা সুরক্ষায় শত্র“দের হাতে প্রাণহারানো যোদ্ধারাও শহীদ হিসেবে সম্মান এবং মর্যাদার অধিকারী। তবে রাজনৈতিক সংঘাত এবং সহিংসতার ব্যাপারে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। পুলিশ নাকি নিহত ব্যক্তি- কে এখানে সংঘাতের সূচনা করলো এবং কে ছিল নিরীহ এবং নির্দোষ- নিহত ব্যক্তি কী উদ্দেশ্যে রাজপথে নেমেছিল, তার স্বার্থ কতটুকু ইসলামের জন্য উপকারী- এ সবকিছুর নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করেই হয়তো বলা যেতে পারে- কে শহীদ এবং কে হত্যাকারী?

আরও মনে রাখা প্রয়োজন- অন্যের হাতে নিহত হলেই যে কাউকে শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করা সচেতন মুসলমানদের কাজ নয়। শহীদ শব্দটিকে রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ের আবেগী প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করাও ইসলামের সাথে অবমূল্যায়নের শামিল। ক্ষমতা দখলের সহিংস রাজনীতি এবং নেতা-নেত্রীদের স্বার্থের সংঘাতে নিহতদের বেলায় ‘শহীদ’ ব্যবহারের সামান্য ইঙ্গিত কুরআন-হাদীসের কোথাও নেই। অথচ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের খেলায় কি অবৈধভাবে তামাশা করা হচ্ছে ‘শহীদ’ নামের এ পবিত্র ও মূল্যবান খেতাবটি নিয়ে, প্রতিবাদেরও যেন আজ কেউ নেই।

আজ থেকে চার দশক আগে আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা যুদ্ধে একদল মানুষের ভুল সিদ্ধান্ত এবং অদূরদর্শিতায় বেশ কিছু শব্দ চিরতরে ঘৃণ্য হয়ে আছে বাংলা অভিধানে। রাজাকার না হয় উর্দু শব্দ এবং সেটি নিয়ে আমাদের হায় আফসোস করার কিছু নেই। কিন্তু ইসলামের সর্বপ্রথম মহান জিহাদ ‘বদর’ নামটিও যে আজ স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের গুণ বর্ণনায় মিশে গেছে- আমরা এবং আগামী প্রজন্মের কেউ কি আর এ শব্দটি ব্যবহার করে কোন সংঘ কিংবা সভার নাম রাখতে পারবো? ইসলামী খেলাফতে এককালের প্রতাপশালী দুটি পদবী ‘খলিফা’ এবং ‘কাযী’ আজকের বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘কাপড় সেলানোর দর্জি’ এবং ‘বিয়ে পড়ানো মুন্সীর’ কাজে। অদূর ভবিষ্যতে ‘শহীদ’ শব্দটিও যে এর আপন স্বকীয় মর্যাদা ও সুমহান সম্মানের আসন থেকে বিচ্যুত হবে না- এ প্রতিশ্র“তি দেয়ার সৎসাহস কার আছে?

দিকে দিকে যখন ইসলাম নিয়ে সবাই স্বার্থের খেলা খেলছে- এমন সংকটাপন্ন সময়ে আমাদের সবার উচিত নিজেদের দ্বীন এবং দ্বীনি বিষয়গুলো স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র বজায় রাখার জন্য অন্যদেরকেও সচেতন করে তোলা। নয়তো অদূর ভবিষ্যতে হয়তো পবিত্র এবং সম্মানিত মর্যাদার প্রতীক শহীদ শব্দটিও তার সঠিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হবে।

বিষয়: বিবিধ

২৪৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File