মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন – এটা কি যৌক্তিক বিশ্বাস?
লিখেছেন লিখেছেন হাসান আল বান্না ১৪ জানুয়ারি, ২০১৩, ১১:২৯:৫৩ রাত
মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন এটা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করে। কিন্তু বিশ্বাস করেনা কিংবা ভুল ভাবে বিশ্বাস করে এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। বিশ্বাসের শুদ্ধতা নিয়ে নয়, আদৌ একজন স্রষ্টা আছেন কিনা এই প্রশ্নটাই বার বার ঘুরে ফিরে আসে তাদের মুখে যারা মানতেই চান না যে এই মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন। তারা কোন কিতাব থেকে উদ্বৃতি দেয় না বরং যুক্তিনির্ভর যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, এই মহাবিশ্বের কোন স্রষ্টা নেই। সুতরাং এই ‘মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছে’ - এটা প্রমাণ করতে হলে যৌক্তিক যুক্তিকেই প্রাধান্য দিতে হবে। অবশ্য যারা কোন ধর্ম মানেন না তারা নিশ্চয়ই যুক্তি মানবেন। ধর্ম কিংবা যুক্তি কোনটাই মানেন না এমন মানুষ খুজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না ।
শুধুমাত্র তিনটি যুক্তি দিয়েই এই লেখাটা শেষ করব।
১.
মহাবিশ্বের কার্যকর অবস্থা কিংবা সুবিন্যস্ততা:
প্রকৃতির দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন সবকিছু কেমন সুবিন্যস্ত । পানি চক্র, সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তন ইত্যাদির দিকে তাকান। মহাবিশ্বের কার্যকর পরিস্থিতির উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ফিজিসিষ্ট ষ্টিফেন হকিংস ব্যাখ্যা করেন যে, জোড়ালো ধারণাটি হল একটি বিন্যাস। আমরা যতই মহাবিশ্বটিকে আবিস্কার করছি ততই দেখতে পাচ্ছি যে এটা পরিচালিত হচ্ছে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন আইন দ্বারা (it is governed by rational laws) । এই পর্যবেক্ষণটি সংখ্যাগরিষ্ট বিজ্ঞানীদের দ্বারাও সমর্থিত।
যেহেতু মহাবিশ্বের শৃঙ্খলা আছে এবং ‘বৈজ্ঞানী আইন’ দ্বারা পরিচালিত, আমাদের প্রশ্ন করা উচিত এই শৃঙ্খলা কেমন করে এলো? সবচাইতে সেরা উপসংহারে পৌছানো যায় এমন যুক্তিই হতে পারে এই প্রশ্নের সবচাইতে কার্যকর উত্তর ।
উদাহরণস্বরূপ, আপনার মোবাইলটি নিন। আপনার মোবাইলটি প্লাষ্টিক, গ্লাস সহ আরও অনেক মেটাল দিয়ে তৈরী। গ্লাস এসেছে বালি থেকে, প্লাষ্টিক এসেছে তেল থেকে এবং মেটাল/ধাতু বের করা হয়েছে বিভিন্ন খনি থেকে। কল্পনা করুন আপনি ধু ধু মরুভূমির মাঝখানে হাঠছেন। যেখানে আছে অনেক তেল, বালি এবং মেটাল । এবং আপনি একটি ব্রান্ড নিউ মোবাইলও পড়ে থাকতে দেখলেন। এখন আপনি কি বিশ্বাস করবেন মোবাইলটি আপনা আপনিই সৃষ্টি হয়েছে? ধরুন সূর্য তার তাপ বিকিরণ করল, বাতাস হুহু করে ধেয়ে আসল, বজ্রপাত বিদ্যুত সৃষ্টি করল, তেলের বুদবুদ মাটির নিচ থেকে উঠে আসল আর এই প্রক্রিয়া মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে চলতে চলতে দৈবাৎ একটি পূর্ণাঙ্গ মোবাইল সৃষ্টি হয়ে গেল!
এরকম একটি ব্যাখ্যা কেউই বিশ্বাস করবে না। এই মোবাইল ফোনটি এমন পরিষ্কার একটি জিনিস যা সুনির্দিষ্ট যন্ত্রাংশের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে গঠন করা হয়েছে। সুতরাং এটা নিশ্চই যুক্তিসংগত বিশ্বাস যে, এই মোবাইল ফোনটির অবশ্যই সংগঠক রয়েছে। অনুরুপভাবে যখন আমরা মহাবিশ্বের নিপুন কার্যকর ব্যবস্থা আর সুবিন্যস্ততা দেখি তখন এটা বলা কি যুক্তিসংগত নয় যে – এই মহাবিশ্বেরও এক সংগঠক আছেন?
এই ‘সংগঠক’ই স্রষ্টার অস্তিস্থের সবচাইতে কার্যকর ব্যাখ্যা। স্রষ্টা হলেন তিনি যিনি মহাবিশ্ব ও এর সুবিন্যস্ততা (অর্ডার) কে সৃষ্টি করেছেন।
২.
যদি কোন কিছু সব সময়ই বিদ্যমান থাকে তবে তার কোন স্রষ্টা থাকার প্রয়োজনই নেই !
বিংশ শতকের প্রথম দিকে কিছু ফিজিসিষ্ট এই ধরণের অভিমত প্রকাশ করেন যে মহাবিশ্ব সব সময়’ই বিদ্যমান ছিল। মহাবিশ্ব যদি সব সময় বিদ্যমান থাকে তবে এর কোন স্রষ্টা থাকার প্রয়োজন নেই।
তথাপি, কসমলজি সাইন্টিষ্টদের হিসাব অনুযায়ী, ১৪ বিলিয়ন বছর আগে একটি মহাজাগতিক (কসমিক) ঘটনা, সাধারণভাবে যা ‘বিগ ব্যাঙ’ নামে পরিচিত - এর ফলেই মহাবিশ্ব সৃষ্ট হয়েছে। (কিন্তু তারা এটা স্বীকার করেন না যে এর ‘কারণ’ কি?)
ধরুন আপনি বিশাল এক শব্দ শুনতে পেলেন এবং কাউকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথা থেকে ওই শব্দ এল’? আপনি কি এই জবাবে সন্তুষ্ট হবেন যে, এই শব্দ এসেছে ‘কোন কিছু না’ থেকে, ‘ফ্রম নো-হয়ার’ এবং এটা ‘আপনা আপনিই ঘটেছে’, অবশ্যই না। আপনি তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এই বিশাল শব্দের ‘কারণ’ বা ‘কজ’ কি??
একই ভাবে, যৌক্তিক কারণেই ‘বিগ ব্যাঙ’ ঘটনার পেছনেও অবশ্যই একটা ‘কজ’ বা কারণ রয়েছে, যার কারণেই বিগ ব্যাঙ ঘটেছে। এখন আমরা প্রশ্ন করতে পারি, যেহেতু ‘বিগ ব্যাঙ’ এর একটি ‘কজ বা কারণ’ আছে, তবে কোন ‘কজ’টি ওই ‘কজ’ এর ‘কজ’? তারপর প্রশ্ন করতে পারি, কোন ‘কজ’টি ওই ‘কজ’ এর ‘কজ’ যার ‘কজ’ আরেকটি ‘কজ’ এর ‘কজ’ যার ‘কজ’ এর ফলে এই ‘বিগ ব্যাঙ’ ঘটেছে। কিন্তু এই ‘কজ’ অব ‘কজ’ অব ‘কজ’ কিংবা কারণের কারণ অনন্ত কাল চলতে পারে না, এটি অবশ্যই এমন জায়গায় গিয়ে স্থির হতে হবে যেখানে ‘ফার্ষ্ট কজ’ বা প্রথম কারণটি অবস্থিত। কারণটা এমন –
কল্পনা করুন, একজন স্নাইপার যে এই মাত্র তার টার্গেট দেখতে পেল, দেখামাত্রই সে তার বেস-এ কল করে (শুট করার) পার্মিশন চাইল। যে ব্যক্তি বেস-এ তার কলটি রিসিভ করেছে, সে বলল, অপেক্ষা কর, আমি আমার উপর যে আছে তার কাছ থেকে পার্মিশন নিচ্ছি। তো, এভাবে এক লোক তার উপরের লোকের পার্মিশন নিচ্ছে, সে তার উপরের, সে তার উপরের উপরে আর এভাবে অনন্তকাল যদি চলতেই থাকে তবে স্নাইপার কি কখনও তার টার্গেট শুট করতে সক্ষম হবে?
পরিস্কার উত্তর হল, সে কখনই শুট করতে সক্ষম হবে না। শুধুমাত্র একটি পন্থায় স্নাইপার তার টার্গেট শুট করতে পারবে, আর তা হল – অন্য কারও অনুমতির প্রয়োজন ছাড়াই, যদি সে নিজেই নিজেকে পার্মিশন দেয়। সেই স্নাইপারই হবে প্রথম কারণ বা ‘ফার্ষ্ট কজ’। একই ভাবে, ‘বিগ ব্যাঙ’ এরও অবশ্যই ‘ফার্ষ্ট কজ’ রয়েছে।
এখন আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, ‘ফার্ষ্ট কজ’কে অবশ্যই, এতটা ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে যে, তিনি সম্পূর্ণ মহাবিশ্বকেই অস্তিত্ব দিতে পারেন এবং তিনি অতি বুদ্ধিমান যেহেতু ‘বিজ্ঞানের আইন’গুলো যা মহাবিশ্বকে পরিচালনা করছে তা তিনিই সৃষ্টি করেছেন।
‘প্রথম কারণ’ বা ‘ফার্ষ্ট কজ’ এর এই সব গুণগুলোই স্রষ্টা সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা । স্রষ্টা হলেন ‘আনক্রিয়েটেড ফার্ষ্ট কজ অব দ্যা ইউনিভার্স’।
৩.
বিশ্বের ইতিহাসের গোড়া থেকেই মানুষ স্রষ্টায় বিশ্বাস করেছে। মানব মনের ভেতরেই এমন কিছু বিদ্যমান আছে যা আমাদের এমন বিশ্বাস করতে শেখায়।
শেষ দশক ধরে বিষ্মায়ভিভুত করার মত ফ্যাক্ট পাওয়া গেছে যে, শিশুদের মাঝে স্রষ্টার প্রতি সহজাত বিশ্বাস নিহিত রয়েছে। ড. জাষ্টিন বেরেট নামে অক্সফোর্ড সেন্টার ফর এনথ্রপলজি এন্ড মাইন্ড এর একজন সিনিয়র গবেষক বলেন, বিগত ১০ বছরের গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সাক্ষপ্রমাণে দেখা যায় যে, আমরা আগে যা ভাবতাম, শিশুদের স্বভাবগত মনোবিকাশ তার চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণে হতে পারে, যা অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে প্রাকৃতিক বিশ্বের গঠনকে দেখে থাকে যেমন উদ্দেশ্যমূলক ভাবে তা গঠিত হয়েছে, বুদ্ধিমান কেউ নিশ্চই এই উদ্দেশ্যের পেছনে রয়েছেন...।
তিনি যোগ করেন, আমরা যদি হাতে গোনা কিছু শিশুকে একটি দ্বীপ ফেলে আসি...তারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করবে। ব্যাপারটা সংক্ষিপ্ত করলে, তার উত্তর হবে, এই জন্যই কেউ স্রষ্টায় বিশ্বাস করবে কারণ আমাদের মনকে এটা বিশ্বাস করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে।
মানুষের জন্য স্রষ্টায় অবিশ্বাস এমন একটা বিষয় যা সম্পূর্ণ অপ্রাকৃতিক, আনন্যাচারাল। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি অব রিলিজিয়ন এর ডেভেলপমেন্ট সাইকোলজিষ্ট ড. অলিভার পেট্রোভিচ বলেন, স্রষ্টায় বিশ্বাস প্রাকৃতিকভাবেই হয় এবং নাস্তিক্যবাদ অবশ্যই একটি অর্জিত অবস্থান।
তো, স্রষ্টা আছেন এমন স্বাভাবিক বিশ্বাস কোথা থেকে এসেছে? যেহেতু এটা সহজাত বিশ্বাস, আমরা এটা বলতে পারিনা যে, এটা সমাজ শিখিয়েছে। এবং ষ্টাডিজে দেখা যায় যে, এটা সামাজিক চাপ থেকে মুক্ত এবং ক্রস কালচারাল।
এর সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা হতে পারে, স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস, স্রষ্টা নিজেই মানুষের মনের মধ্যে রোপন করে দিয়েছেন।
REFERENCES:
[-] Antony Flew, There Is a God: How the World’s Most Notorious Atheist Changed His Mind
[-] Derek Raine, An Introduction to Science of Cosmology (Astronomy & Astrophysics)
[-] Justin L. Barrett, Why Would Anyone Believein God?
[-] http://www.cam.ox.ac.uk/publications-original/why-would-anyone-believe-in-god/ (this link is broken now)
[-] Dr Olivera Petrovich, Childs Theory of World
[-] Justin L. Barrett, Jonathan A. Lanman, The Science of Religious Beliefs
লেখাটি http://www.onereason.org
এর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অনুবাদ
বিষয়: বিবিধ
২৪৯৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন