'মুসলিম উদ্দিন' প্রবাসে একটি স্বপ্নের অকাল মৃত্যু
লিখেছেন লিখেছেন মিকি মাউস ৩০ নভেম্বর, ২০১৫, ১১:২৮:৪৯ সকাল
দুচোখ ভরা স্বপ্ন আর বুকভরা আশা নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মুখে দুবেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে স্বপ্নের মালয়েশিয়ায় আসে মুসলিম উদ্দিন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বেশি টাকা উপার্জন করে সুখে সাচ্ছন্দে রাখবে পরিবার পরিজনকে এ উদ্দেশে।
পৈতৃক সূত্রে পাওয়া শেষ সম্বল মাঠের ধানি জমি বিক্রি করে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা স্থানীয় দালালের হাতে তুলে দেয়। লক্ষ্য একটাই, যে কোনো মূল্যে পোঁছতে হবে মালয়েশিয়া।
নির্ধারিত দিনে দালালের অমানুষিক শারীরিক অত্যাচার, খাবারহীন ৮ দিনের কঠিন সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে গত ফেব্রুয়ারী মাসে স্বপ্নের মালয়েশিয়া পোঁছায় মুসলিম উদ্দিন। কিন্তু সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার আগেই তাকে চির বিদায় নিতে হয় শুধু স্বপ্নের মালয়েশিয়া নয়, দুনিয়া থেকেও।
বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে মালয়েশিয়া আসা মুসলিম উদ্দিনকে মানবপাচারকারি দালাল পেনাংয়ের এক জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। মুহূর্তেই চুরমার হয়ে যায় মালয়েশিয়া আসার স্বপ্ন। অপরিচিত স্থান, বৈধ কাগজ পত্রহীন ও ভাষা না জানা মুসলিমকে পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হত।
বৈধ কাগজপত্র ছাড়া নিজদেশেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মালয়েশিয়া আসার চেয়ে দেশে ফিরে যাওয়াটাই এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়ে তার জন্য। এভাবে অর্ধাহারে অনাহারে কেটে যায় ৮ মাস।
এদিকে, অনাহার আর পুলিশী আতংকে মুসলিমের একটি 'পা' অবশ হয়ে যেতে থাকে। কষ্টকর হয়ে পড়ে এক পায়ে হাটা।
সম্মুখে ভয়ানক বিপদ দেখে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সাহায্য চান মুসলিম। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় প্রবাসীরা মুসলিমকে কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ দুতাবাসে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরে এক প্রবাসীর সহযোগিতায় পেনাং থেকে প্রায় ৪শ ৫০ কি.মি. পাড়ি দিয়ে ২৪ নভেম্বর সকালে দুতাবাসে পোঁছান মুসলিম।
অন্যদিকে প্রতিদিনের ন্যায় নিজের ডেস্কে একমনে কাজ করছিলেন বাংলাদেশ দুতাবাসের ফাস্ট সেক্রেটারি মুসাররাত জেবিন। কাগজপত্রহীন শ্রমিকদের ট্রাভেল পাস দিচ্ছিলেন তিনি। এ সময় রোগা শরীরের মুসলিমকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে তার দিকে আসতে দেখেন। মুসলিম এসেই হাও মাও করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'আমাকে একটা ট্রাভেল পাসের ব্যবস্থা করে দিন, আমি দেশে চলে যাবো।'
মুসাররাত জেবিন তাকে জেলার নাম জিজ্ঞাসা করলে কক্সবাজার বলে জানায় মুসলিম। প্রয়োজনীয় কাজপত্র না থাকায় প্রথমে রোহিঙ্গা বলে সন্দেহ করলেও পরে তার শারীরিক অবস্থা দেখে জেবিন নিজে কক্সবাজারে খোঁজ নিয়ে বাংলাদেশী বলে নিশ্চিত হন।
সঙ্গে সঙ্গে ট্রাভেল পাস করিয়ে দিলেও ততক্ষণে মুসলিম আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। দ্রুত তাকে নিজের গাড়িতে করে আম্পাং হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেন জেবিন।
প্রয়োজনীয় পরিক্ষা শেষে হাসপাতালের ডাক্তার একটা পা কেটে না ফেললে মুসলিমকে বাঁচানো যাবে না বলে জানান। মুসলিমের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুসাররাত জেবিন তার চিকিত্সার ভার নেন।
ডাক্তার মুসলিমকে অপারেশন করে একটা পা কেটে ফেলেন। কিন্তু এতে করেও মুসলিমকে বাঁচানো যায়নি। ২৭ নভেম্বর সকাল ১১ টায় পরপারে পাড়ি জমান মুসলিম।
হাসপাতাল থেকে মুসলিমের চিকিৎসা ব্যয় ৫ হাজার রিঙ্গিত হলে দুতাবাসের সহযোগিতায় কর্তব্যরত ডাক্তার মুসলিমকে বিল মওকূপ করে দেন। পরে ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০৮৭ ফ্লাইটে মুসলিম উদ্দিনের কফিন দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
মুসাররাত জেবিন বলেন, প্রবাসীদের কল্যাণে বাংলাদেশ হাই কমিশন সবসময়ই পাশে আছে। কারো কোন বিপদ হলে যথাসাধ্য তার কাছে ছুটে যায় হাই কমিশনের কর্মকর্তারা।
তিনি আরও বলেন, সমুদ্রপথে অবৈধভাবে আসা অনেকেই নিদারুণ কষ্টে মালয়েশিয়ায় রয়েছেন। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় প্রতিনিয়ত তাদের থাকতে হয় নানান ঝামেলার মধ্যে। ফলে মুসলিমদের মত খেসারতও দিতে হয়। সুতরাং দালালদের খপ্পরে না পড়ে বৈধ পথে মালয়েশিয়া আসা উচিত।
বিষয়: বিবিধ
১৪৮৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন