এক দু:খিনী মায়ের কান্না...

লিখেছেন লিখেছেন মিকি মাউস ১২ মে, ২০১৪, ০৩:১১:৪৫ রাত



‘মা আঁই যাইতান ন... এতারা কে... এতাগোরে তো আই চিনি না... আই আন্নের কাছে থাককুম...’ সাড়ে চার বছর বয়সি এক শিশুর বুক ফাঁটা কান্না সমবেত লোকদের চোখের কোনে পানি আটকিয়ে রাখতে পারে নি।

সভার প্রধান কঠিন হৃদয়ের অধিকারি মোড়ল সাহেবও কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত আল্লাহ তাদের কঠিন বিচার করবেন।

গ্রামের জনাকীর্ণ এক সভায় নারী লোভী এক নরপশুর একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছাতে এভাবেই ভেঙ্গে গেল একটি সম্ভাবনাময় দাম্পত্য জীবন। শিশুটি বঞ্চিত হলো মায়ের আদর থেকে। অথচ আমাদের তথাকথিত গুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থা পারিবারিক জীবনে শান্তির পরিবর্তে প্রতিনিয়ত নিয়ে আসছে অশান্তি।

‘সিয়াম’ ছোট্ট ছেলেটি আমি বাড়ি গেলেই মামা বলে দৌড়ে আসত। পুকুরে গোসলের সময় কোন কিছু আনতে ভুলে গেলে সামনে থাকা সিয়ামকেই বলতাম মামা... অমূক জিনিশটা নিয়ে আস তো। পারবে কিনা চিন্তা না করেই ভৌঁ দৌড় দিত। যতক্ষণ বাড়িতে থাকতাম আমার আশপাশেই থাকত।

আমার ভাতিজা-ভাতিজি কিংবা ভাগিনা-ভাগ্নি কেউ বাড়ি গেলেই তাদের অন্যতম খেলার সাথী ছিল সিয়াম।

সিয়ামের মা সাফিয়া। উজ্জল ফর্সা গায়ের রংয়ে অসম্ভব সুন্দরী। বাবার কর্মস্থল চিটাগং এ বেড়ে উঠা। হঠাৎ করে বাবার চাকুরীতে ইস্তফা দেওয়ার ফলে চলে আসে বাড়িতে।

গায়ের অনেক ছেলেই তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে। আসতে থাকে অনেক বিয়ের প্রস্তাব। তার বাবার একই কথা মেয়েকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবেন না। তা ছাড়া মেয়ের বয়স ও অনেক কম। মাত্র তো ক্লাস নাইন।

কিন্তু বাধ সাধে গ্রামের অশিক্ষিত সমাজ। যারা নিজেদের বিবেক বিক্রি করে দেয় অল্প কিছুর বিনিময়ে। এমনই একজনের পাল্লায় পড়ে সাফিয়া এক সন্ধায় ঘর ছাড়ে। অনেক খোঁজাখুজির পর তার সন্ধান পাওয়া যায় পাশ্ববর্তী গ্রামের এক লম্পট ছেলের ঘরে। ছেলের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয় মেয়ে নিজেই চলে এসেছে বাবা-মায়ের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেতে। কোন সন্তানের কাছে তার পিতা-মাতার চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় আর কোথায় হতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে জানা গেল অন্য ঘটনা।

যাক স্থানীয় মোড়লদের প্রভাব-প্রতিপত্তির ফলে মেয়ের বাবা-মা কিছুই করতে পারেনি। যথারীতি সে ছেলের সঙ্গে পরদিন বিয়ে হয়ে গেল। আর নিরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না মেয়ে পক্ষের।

এভাবে চললে নাটকের সুন্দর একটা সমাধান হতো। কারণ আমরা সবাই নাটক কিংবা সিনেমায় আর যাই ঘটুক নায়ক-নায়িকার মিলন ই দেখতে চাই। এ ব্যাপারে মনে হয় কেউ অমত করবেন না।

নাটকের চারভাগের একভাগে এসে নায়িকার বাবার মন কিছুটা গলে। মেয়েকে নিজের বাড়িতে আনতে দুপরিবারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। যেহেতু একমাত্র মেয়ে তাই সিদ্ধান্ত হয় সাধ্যানুযায়ী বিয়ের মত করেই একটি অনুষ্ঠান করা হবে।

সুন্দরভাবেই সম্পন্ন হওয়া অনুষ্ঠান শেষে মেয়েকে তুলে দেওয়া হয় নতুন মোড়কে আবদ্ধ পুরোনো বরের হাতে।

দিন চলছিল সুখেই। কিন্তু সে সুখও তার কপালে সইল না সাফিয়ার। নাটকের মাঝামঝিতে এসে গর্ভাবস্থায় শুরু হয় শাশুড়ী নামক এক দানবীর অত্যাচার। প্রথমে শুরু হয় মানসিক ভাবে নির্যাতন। ধীরে ধীরে তা রূপ নেয় শারিরিক নির্যাতনের দিকে। নির্যাতনের মাত্রা এমন ভাবে বাড়তে থাকে যে তা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়ায়।

এদিকে সাফিয়ার শরীর দিনদিন খারাপ হতে থাকে, এক সময় বাধ্য হয়ে বাবার বাড়ি চলে আসে। তার কিছু দিন পর তার কোল জুড়ে আসে একটি ফুটফুটে সন্তান। আশ্চর্যের বিষয় হল এর মধ্যে ছেলের পক্ষ কোন খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি।

সিয়ামের জন্মের ১ মাস পর তার ছোট ফুফু এক সেট জামা ও কিছু খাবার নিয়ে আসে। প্রথমে বাড়ির সকলে এসব রাখতে বাধা দিলে ও পরবর্তীতে মুরুব্বিদের কথায় সেসব রাখা হয়। তারপর থেকে আবার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সিয়ামের বাবার বাড়ি থেকে কেউই আর খোজ খবর নিতে আসে না।

সাফিয়া তার সন্তানকে নিয়ে তার আয়-রোজগারহীন বাবার বাড়িতে অনেকটা অসহায়ের মতই চলছিল। সমাজ ও ধর্মমতে তার যে একজন স্বামী আছে, যাকে ভালবেসে সে ঘর ছেড়েছিল সেই স্বামী নামক নরপশুটা তার সঙ্গে যোগাযোগ তো দুরের কথা দুধের বাচ্চাটির ভরণ-পোষণ কিংবা কোন ধরণের খোঁজ খবর ও নেওয়া থেকে বিরত থাকে।

সাফিয়ার বাবা মেয়েকে সান্তনা দিত এ বলে, ‘মা আমি তোর বাবা, যদি কপালে জোটে তাহলে একবেলা সবাই মিলে খাব আর না হলে খাব না। কিন্তু তোর এই দুধের শিশুটিকে অন্তত না খাইয়ে রাখব না।’

সিয়ামের নানা তার কথা রেখেছেন। নাতিকে সবসময় কাছে পিঠে রাখতেন। নাতির সঙ্গেই তার সবচেয়ে বেশি ভাব। কোথাও গেলে নাতিকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। গ্রামের ফেরিওয়ালার কাছ থেকে সাধ্যানুযায়ী খেলনা কিনে দিতেন। কোথাও কোন খাবারের দাওয়াতে গেলে নাতিকে অবশ্যই কাধেঁ করে নিয়ে যেতেন। অথবা কোথাও ভাল খাবার পেলে নাতির জন্য অবশ্যই নিয়ে আসতেন।



এভাবে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে সিয়াম। দুষ্টুমি আর সুন্দর সুন্দর কথায় বাড়ির সকলের মন ভরিয়ে রাখত সিয়াম। আমাদের ঘরে ছিল তার সবচেয়ে বেশি যাতায়াত। কেননা আমার আব্বু আম্মু ছাড়া বাড়িতে অন্য কোন ভাই নেই। আম্মু তাকে কাছে ডেকে আদর করে এটা ওটা খেতে দিতেন। সিয়ামও তার এই নানুমনির সঙ্গে মোটামুটি ভাব জমিয়ে ফেলেছিল।

সময় চলছিল তার নিজস্ব গতিতে, চলছিল কারো জন্য সুখের হয়ে আবার কারো জন্য অতি বিষাদের হয়ে। সাফিয়াও তার জীবন চালিয়ে নিচ্ছিল কোন রকমে।

এদিকে বিভিন্ন অনিয়ম এবং অনৈতিক কারণে সিয়ামের দাদার পরিবার বাড়ি থেকে একেবারে উচ্ছেদ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে বাড়ির সকল জমি-জমা বিক্রি করে ঢাকায় চলে আসে। জায়গা কিনে বানায় বাড়ি। একলাফে উঠে যায় সমাজের উচুঁ শ্রেণিতে। হয়ে উঠে নতুন করে সভ্য এবং ভদ্র লোক।

অন্যদিকে সাফিয়ার প্রবাসী নরপশু স্বামী সিদ্ধান্ত নেয় আমার এখনও সময় আছে, আছে অনেক অর্থ। ঢাকায় আছে বাড়ি। তাহলে আমি কেন গ্রামের অশিক্ষিত মেয়েকে নিয়ে ঘর সাজাবো। আমার বউ হবে আধুনিকা কোন মেয়ে। যে হবে আগের বউয়ের চেয়ে সুন্দরী। ইতোমধ্যে নতুন একজনকে বিয়ের জন্য সবঠিক করে ফেলে সে। বিয়ের দিনক্ষণ ও প্রায় ঠিক। এখন শুধু তালাকের পালা। এখান থেকে বিদায় নিতে পারলেই মুক্তি।

কিছু দিনের মধ্যে সিয়ামের দাদা-দাদীর সঙ্গে পরামর্শ করে নরপশু বাবা ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেয় সাফিয়াকে তালাক দেওয়ার। গতকাল (শনিবার) ছিল সেই মহান (কলঙ্কময়) দিন। যেদিন মাত্র ২ লাখ টাকার বিনিময়ে সিয়াম তার মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে একেবারে অপরিচিত একটি পরিবারের (বিদেশে থাকায় জন্মের পর বাবাকেও দেখেনি) কাছে চলে যেতে বাধ্য হয়। সিয়াম ছেড়ে যায় তার মা, মামা, নানি, খেলার সাথী নানা ভাই এবং ভাব জমানো আম্মুকে।

অথচ যার একদিন পরেই (১১মে রবিবার) মা দিবস। যে দিবসটি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ভক্তি ভরে পালন করে থাকে। কিন্তু কেউ কি বলতে পারবে কেন ২২/২৩ বছরের একজন মা কেন তার শিশু সন্তানকে এভাবে হারাল?

এ ঘটনায় আমার মমতাময়ী মা নিরবে চোখের জল ফেলছে। কেননা তিনি ও একজন মা।

১২.০৫.১৪

(সম্পূর্ণ সত্যি ঘটনা, ছবির শিশুটিই সিয়াম)

বিষয়: বিবিধ

১৫৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File