অর্থ জেনে শব্দের ব্যাবহার করি

লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ২৭ মার্চ, ২০১৩, ১১:৫৭:৪৫ সকাল

আমরা অনেক সময় অর্থ না বুঝে বিভিন্ন শব্দ ভুল জায়গায় ব্যবহার করে থাকি যেটাতে অনেক সময় আমাদের ঈমান নিয়ে সন্দেহ চলে আসে। যেমন:-

০১. গাউসুল আজম:- গাউস শব্দের অর্থ ত্রাণকর্তা, রক্ষাকর্তা, পরিত্রাণদানকারী, উদ্ধার কারী ইত্যাদি। এবং আজম শব্দের অর্থ মহান,বড় বা সর্বশ্রেষ্ঠ। গাউসুল আজম শব্দের অর্থ হল সর্ব শ্রেষ্ঠ ত্রাণকর্তা। এ কথাটি আল্লাহ ছাড়া আর কারো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে কি? মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ কি সর্বশ্রেষ্ঠ ত্রাণকর্তা হতে পারেন? কোন মানুষকে এ নামে ডাকার অর্থ হল তাকে আল্লাহর গুণাবলীতে গুণান্বিত করা। কোন মানুষ কি নিজেকে গাউসুল আজম দাবি করেছেন? তাহলে কেন তাকে আমরা গাউসুল আজম ডাকব? কাউকে এ নামে ডাকলে তা হবে শিরকের নামান্তর।

০২. মাযার বা দরগাহঃ- মাযার আরবী শব্দ যার অর্থ দর্শনীয় স্থান। দরগাহ ফারসী শব্দ যার অর্থ একই অর্থাৎ পরিদর্শনের স্থান, দর্শনীয় স্থান বা রাজসভা। এগুলো হল আভিধানিক অর্থ। সুতরাং কোন কবরকে মাযার বলা যায়না। রসুল(সা) কবরকে মাজার বলেন নাই, সাহাবীগণও বলেন নাই। কবর শব্দটি কুরআনে মোট আটবার এসেছে সুতরাং কবর বললে আমরা পূণ্যের প্রত্যাশী হইতে পারি। কারণ এটা কুরআনের শব্দ।

০৩. পীরঃ-
পীর শব্দটি ফারসী শব্দ। এটি আরবী শব্দ নয়। কুরআন হাদিসের পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত কোন শব্দও নয়। ব্যবহারিকভাবে মানুষের বয়স বেশি হয়ে গেলে সেই বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের উভয়কে পীর বলা হয়। পারস্যের অগ্নিপূজারীদরে পূরোহিতকে বলা হয় পীরে মুগাঁ। মুগঁ এর বহুবচন মুগাঁ-মানে অগ্নিপূজারীগণ। পীরে মুগাঁ মানে অগ্নি পূজারীদের পীর। ফারসী ভাষায় পীরে মুগাঁর অর্থ করা হয়েছে "আতাশ পোরস্তুকা মুরশেদ" অর্থাৎ অগ্নিপূজারীদের পীর। তবে মুগাঁরা যখন তাদের পীরকে ডাকেন তখন পীরে মুগাঁ বলে ডাকেন না, পীর বলেই ডাকেন।

আবার পানশালার মদ বিক্রেতাকেও পীরে মুগাঁ বলা হয়। কারণ সুফীবাদীরা আধ্যাতিক প্রেমকে রূপকভাবে মদরূপে অভিহিত করে, উক্ত প্রেমরস-পরিবেশককে পীর বা 'শুড়ী মশাই' নামে অভিহিত করে থাকেন। খৃষ্টানদের পাদরী, হিন্দুদের পুরোহিত এবং বৌদ্ধদের ভিক্ষু বলতে যা বুঝায় পীর বলতে ঠিক তাই বুঝায়।

কবি বলেছেন...

বমায়ে শাজ্জাদাহ‌ রঙ্গীন কুন

গিরাত পীরে মুগাঁ গোয়াদ

সে সালেক বেখবর নাবুদ

যে রাহে রাস‌মো মান‌যালহা।

অর্থাৎ পীরে মুগাঁ অর্থাৎ শুড়ি মশায় যদি বলেন, তাহলে তুমি জায়নামাজকে মদের দ্বারা রাঙিয়ে তুলো। কেননা পথের সন্ধান গুরুজী ভালভাবে অবগত আছেন। এই কবিতায় শুঁড়ি মশায়কে পীরে মুগাঁ বলা হয়েছে।

পীর, পুরোহীত বা পাদরী এর কোন প্রতিশব্দ কুরআন-হাদীসে নেই। আবু বকর, উমর, উসমান, আলী (রাঃ) প্রমুখ সাহাবীগণও কেউ কোনদিন পীর বলে দাবী করেননি। তাবেয়ীনদের যুগে পীরের অস্তিত্ব ছিলনা। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম নাসায়ী, ইমাম তিরমিযী, ইমাম ইবনু মাজাহ (রহ.) প্রভৃতি মহামতি ইমামগণও পীরগিরি করেননি। কোন‌ কুক্ষণে পারস্যের অগ্নি পুঁজারীদের সেই পীর তাওহীদবাদী মুসলিম সমাজের ঘাড়ে-গর্দানে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসল- তা ভেবে কুল পাওয়া যায়না। আরবী ভাষায় উসতায ও নেতাকে শাইখ বলা হয়।

০৪. অলি বা অলি আল্লাহ:- 'অলি' বা 'অলি আল্লাহ' সম্পর্কে আমাদের সমাজে অনেক ভুল ধারণা আছে। মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ বেশভূষা এবং বিশেষ ধরণ ধারণের ব্যক্তিদেরকে লোকেরা 'আল্লাহর অলি' বা 'অলি আল্লাহ' মনে করে অনেকে নিজেকে অলিকুল শিরোমনি বা অলিকুল সম্রাট উপাধি দিয়ে থাকে। কিন্তু আসল ব্যাপার আসলে তা নয়।

অলি শব্দের অর্থ- বন্ধু, অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক। অলির বহুবচন আওলিয়া।

'অলি আল্লাহ মানে- আল্লাহর বন্ধু বা আল্লাহে প্রিয়জন। আল্লাহর বন্ধু বা প্রিয়জন কে, তা কারো দাবি বা ডাকা দ্বারা নির্ধারিত হয়না। তা নির্ধারিত করার দায়িত্ব আল্লাহর।

আল্লাহ নিজেই কুরআন মজিদে 'অলি আল্লাহর' পরিচয় দিয়াছেন এভাবে: ''জেনে রাখো! আল্লাহর অলিদের ভয়ও নেই, দুশ্চিন্তাও নেই- যারা ঈমান এনেছে এবং ত্বাকওয়া অবলম্বন করেছে''। (সূরা ইউনুস, আয়াত-৬২-৬৩)

''নিশ্চয়ই তোমাদের অলি হলেন আল্লাহ এবং তাঁর রসুল আর ঈমানদার লোকেরা- যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দিয়ে দেয়, এবং আল্লাহর প্রতি অনুগত বাধ্যগত থাকে। যারা অলি মানে আল্লাহকে এবং আল্লাহর রসুলকে আর ঈমানদার লোকদেরকে, তারাই আল্লাহর দল এবং আল্লাহর দলই থাকবে বিজয়ী''। (সূরা আল মায়িদা, আয়াত-৫৫-৫৬)

এ দুটি আয়াত থেকে জানা গেল, সকল মুমিনই আল্লাহর অলি, যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহর অনুগত বাধ্যগত থাকে। ইমাম তাহাবী তাঁর ''আল আকীদা'' গ্রন্থে আহলুস সুন্নত ওয়াল জামাতের 'অলি আল্লাহ' সংক্রান্ত আকীদা পেশ করেছেন এভাবে:

''সকল মুমিনই আল্লাহ রহমানের অলি। তাদের কাছে আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত তারা, যারা আল্লাহর অধিকতর অনুগত এবং কুরআনের অধিকতর অনুসারী''।

০৫. উসিলা:- কিছু লোক 'ওয়াবতাগু ইলাইহিল ওসিলার' উল্লেখ করে বলে উসিলা মানে পীর বুযুর্গ ধরা। তারা আরো বলে বিপদ মুসিবত, দুঃখ কষ্ট ও আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওযার জন্য এইসব উসিলার সাহায্য নিতে হবে। এসব কাজে তাদের অনেক ক্ষমতা। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা মরা ও জীবিত ব্যাক্তিদেরকে উসিলা ধরে এবং তাদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করে, ফরিয়াদ করে, মুক্তি চায়।

যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করে, ফরিয়াদ করে, এবং যা আল্লাহর কাছে চাওয়ার তা তাদের কাছে চায়, তারা সরাসরি শিরকে লিপ্ত। তারা অন্যদের আল্লাহর সমকক্ষ বানাচ্ছে এবং তাদের ইবাদত করছে।

কারণ দোয়া হচ্ছে ইবাদত। রসুল (সা) বলেছেন: 'দোয়া হচ্ছে ইবাদত' (মিশকাত দোয়া অধ্যায়)

ওয়াবতাগু ইলাইহিল ওসিলার অর্থ পীর ধরতে হবে,এমন কথা যারা বলে, তারা কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞ এবং কুরআনকে নিজেদের দুনিয়াবি স্বার্থে ব্যবহার করে।

উসিলা শব্দটি কুরআন মজিদের দুই জায়গায় উল্লেখ হয়েছে তা হলো:

''হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তার নৈকট্য লাভের উসিলা(উপায়) অন্বেষণ কর, আর তাঁর পথে জিহাদ কর(প্রচেষ্টা চালাও), যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।'' ( সূরা আল মায়িদা, আয়াত-৩৫)

এ আয়াতে উল্লেখিত 'উসিলা অন্বেষণ করো' অর্থ কি? এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. বলেন-''উসিলা মানে নৈকট্য''। (তফসিরে ইবনে কাছির)।

প্রখ্যাত তাবেয়ী কাতাদা (রহ.) বলেন. ''উসিলা অন্বেষণ কর মানে: আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করো তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে এবং এমন উত্তম আমলের মাধ্যমে, যে ধরণের আমল দ্বারা তিনি সন্তষ্ট হন'' (তফসিরে ইবনে কাছির)

উসিলা শব্দটি সূরা বনি ইসরাইলেও এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন ''হে নবী! তাদের বলো: ''তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর যাদের কাছে (বিপদ মুসিবত ও দুঃখ কষ্ট দূর করার জন্য) দোয়া-প্রর্থনা-ফরিয়াদ করো, দুঃখ ও বিপদ মুসিবত দূর করার কোনো ক্ষমতা তাদের নাই। এরা যাদের কাছে প্রার্থনা করে তারা নিজেরাই তো তাদের প্রভূর নৈকট্য লাভের উসিলা সন্ধান করে, এ উদ্দেশ্যে যে, কে তাঁর কতো নৈকট্যে যেতে পারে, তারাও রহমত প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তির ভয়ে ভীত থাকে। কারণ তাঁর শাস্তি যে অতি ভয়াবহ।'' (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত- ৫৬-৫৭)

এ আয়াতগুলোতে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য এবং মুসিবত ও দুঃখ কষ্ট দূর করার জন্য মরা বা জীবিত উসিলা বানাতে কুরআন সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন। বলা হয়েছে:

০১. তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে আল্লাহর শরিক ও সমকক্ষ বানাচ্ছে।

০২. তারা যাদেরকে উসিলা বানায়, বিপদ মুসিবত ও দুঃখ কষ্ট দূর করতে তারা সম্পুর্ণ অক্ষম ও অসহায়।

০৩. তারা নিজেরাই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য উসিলা খোঁজে।

০৪. উসিলা মানে আল্লাহর আনুগত্য ও নেক আমল, যা আল্লাহর নৈকট্য ও দয়া লাভের উপায়।

০৬. শরীফ:- শরিফ অর্থ মর্যাদাবান, সম্মানার্হ, অভিজাত, ভদ্র ইত্যাদি। আমাদের উপমহাদেশে যে কোন কিছুর সাথে 'শরিফ' শব্দটি ব্যবহার করা হয়। শব্দটি ব্যবহার করা একটি বাতিকে পরিণত হয়েছে।

সাধারণত কোনো কিছুর সাথে শরিফ শব্দটি ব্যবহার করা হয় শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে 'শরিফ' প্রয়োগ করা যায়েজ। যেমন- কুরআন শরীফ, কাবা শরীফ, হারাম শরীফ, হাদিস শরীফ।

উল্লেখিত ক্ষেত্র সমুহে যেরূপ সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রকাশার্থে শরিফ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, অনুরূপ ভক্তি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনার্থে নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে শরিফ শব্দ প্রয়োগ করা একবারে না জায়েয। যেমন:- মাযার শরীফ, দরগাহ শরীফ, উরস শরীফ, আজমীর শরীফ।

এর কারণ হলো, ইসলামে প্রথমোক্তগুলো ঈমান, আকিদা এবং কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতেই সম্মানার্হ। কিন্তু শেষোক্তগুলোর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা প্রকাশ করা ঈমান আকিদার সাথে সাংঘর্ষিক। বরং অনেক ক্ষেত্রেই শিরক।

০৭. মুর্শিদঃ- মুর্শিদ অর্থ পথ প্রদর্শক। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ''আল্লাহ যাকে হেদায়াত দেন সেই হেদায়াত পায়, আর যাকে তিনি গোমরাহ করেন, আপনি কখনও তার জন্য কোন সাহায্যকারী (ওলী) ও পথ প্রদর্শক (মুর্শিদ) পাবেন না। (সূরা কাহাফ, আয়াত-১৭)

অতএব আল্লাহ ছাড়া কাউকে মুর্শিদ বলা হারাম বা নিষিদ্ধ।

০৮.বিশ্ব ব্রম্মান্ড্যঃ- এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বসী কোন ব্যক্তি কোন অবস্থাতেই পৃথিবীকে ব্রম্মান্ড্য বলতে পারেন না। কারণ এটা একটা শিরকী আকিদা।

ব্রম্মান্ড্য মানে-ব্রম্মা দেবীর ডিম। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী শিবের সাথে অবৈধ মিলনের ফলে ব্রম্মা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। তখন এ জগত ছিল মহাসমুদ্র। ব্রম্মা তার গর্ভ প্রসবের সময় মহা সমুদ্রের মাঝখানে একটা বিশাল আন্ডা প্রসব করে।

ব্রম্মার সেই আন্ডার নামই ব্রম্মান্ড্য যাকে পৃথিবী বলা হয়। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী পৃথিবী হলো সেই ব্রম্মান্ড।

আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে শিক্ষিত হিন্দু পন্ডিতরা এই বিশ্বাস এখন করেন কি-না জানা যায় না। তবে কিছু মুসলমান না বুঝেই পৃথিবীকে ব্রম্মান্ড্য বলে থাকেন।

০৯. ফায়েজ বা রূহানী ফায়েজঃ- ফয়েয আরবী শব্দ। এর অর্থ দয়া, দান, সমৃদ্ধি। রূহানী ফায়েয মানে- আত্মিক দয়া, দান ও সমৃদ্ধি।

যারা মৃত পীর বুযুর্গদের কবর থেকে কিংবা তাদেরকে ধ্যানের মাধ্যমে তাদের থেকে রূহানী ফায়েয লাভের চেষ্টা করে, তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত। এ ধরণের ফায়েয হাসিলের কোন ভিত্তি নেই। আল্লাহর রসুল (সা.) এবং সাহাবীগণ এ ধরণের ফায়েয হাসিল করার কোন পথের সন্ধান দিয়ে যাননি। এটা বিদআত এবং শিরক।

১০. গায়েবি ইলমঃ- কিছু কিছু পীর বুযুর্গ নামধারী ব্যক্তি তাদের কাছে গায়েবী ইলম আছে বলে দাবী করে থাকেন। বুঝতে হবে এটা তাদের পীরালী ব্যবসা বা পীরগিরি টিকে রাখার একটি পন্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ কুরআন সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ গায়েব জানে না। যেমনঃ-

''হে নবী! মহাকাশ এবং এই পৃথিবীতে যারা আছে কেউই গায়েব জানে না আল্লাহ ছাড়া। এমনকি কখন তাদেরকে পুনরুথ্থিত করা হবে সেটাও তারা জানে না।'' (সূরা আন নামল, আয়াত-৬৫)

''অদৃশ্য জগতরে কুঞ্জিগুলো (ভান্ডারগুলো) তাঁরই অবগত- তিনি ব্যতীত আর কেউ সে সম্বন্ধে অবগত নয়; (তাঁর জ্ঞান এত প্রশস্ত যে,) স্থল ও জলের সবকিছু তিনি অবগত আছেনঃ তাঁর অগোচরে গাছের একটি পাতাও খসে পড়েনা। ভূগর্ভস্থ অন্ধকার পূঞ্জের প্রত্যেকটি শস্যবীজ এবং প্রত্যেকটি সরল ও নীরস সমস্থই তাঁর জ্ঞানের পরিধির মধ্যে সুস্পষ্ট কিতাবে (লৌহে মাহফুজে) সন্নিবেশিত।

(সূরা আল আন-আম, আয়াত-৫৯)

''তাদের (সৃষ্ট জীব ও বস্তুর) অগ্র ও পশ্চাৎ সমস্তই তিনি বিদিত থাকেন; বস্তুত তাঁর জ্ঞানের অতি সামান্য অংশও মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টজীব আয়ত্ব করতে পারে না-তবে যেটুকু তিনি ইচ্ছে করেন।''

(সূরা আল বাকারা, আয়াত-২৫৫)

''আর প্রকৃত অবস্থা এই যে, তোমার পরওয়ারদেগারের ফৌজগুলোর বৃত্তান্ত তিনি ব্যতিত আর কেহই অবগত নয়।'' (সূরা মুদ্দাসসির, ৩১ আয়াতের শেষাংশ)

''বলে দাওঃ আমি তোমাদেরকে একথ বলিনা যে, গায়েবের ভান্ডারগুলো আমার অধিকারে আছে। আর না আমি গায়েব জানি। আমার কথা এও নয় যে, আমি (অতি মানব) ফেরেশতা। আমার মর্যাদা এতটুকু যে, আমি আল্লাহর প্রত্যাদেশ অনুযায়ী চলি। আর এ পথে চলার জন্য তোমাদেরকেও আহবান করি।'' (সূরা আল-আনআম, আয়াত-৫০)

''হে রসুল! এদেরকে বলোঃ ভবিষ্যতে আমার ও তোমাদের সাথে কি কি আচরণ করা হবে, আমি তা জানি না।'' (সূরা আহকাফ, আয়াত-৯)

''তোমাদেরকে জ্ঞানের অতি সামান্য অংশ প্রদান করা হয়েছে।'' (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৮৫)

''অবস্থা এই যে, তিনি নিজের খেয়াল খুশিমত কোন কথা বলেন না। (তাঁর) উক্তিগুলো অহী বৈ আর কিছুই নয়-যা তাঁর প্রতি প্রেরন করা হয়।'' (সূরা নাজম, আয়াত-৩-৪)

''আর তুমি (সে সময়) তূর পর্বতের পার্শ্বেও উপস্থিত ছিলেনা যখন (মূসাকে) আমরা আহবান করেছিলাম। তবে তোমার প্রভূর রহমত বশতঃ (তুমি এসব বৃত্তান্ত অবগত হতে পারলে।''

(সূরা কাসাস, আয়াত-৪৬)

''আরশের অধিপতির সত্তাই উঁচু মর্যাদা সমুহ দানকারী, নিজ আদেশ বলে জিবরাঈল পাঠিয়ে আপনার দাসদের মধ্য থেকে যার প্রতি ইচ্ছা ওহী নাযিল করেন তিনি।'' (সূরা মুমিন, আয়াত-১৫)

অতএব দেখা যাচ্ছে আল্লাহ ছাড়া কেউ ইলমে গায়েব জানেন না ।

১১. ওরসঃ- ওরস আরবী শব্দ। এর অর্থ বাসর রাতের মিলন। (আল ক্বামুস ২য় খন্ড ১২৩ পৃষ্ঠা)

আবার ওলীমার খানা ও খুশি প্রভৃতি। ( মিসবাহুত লুগাত-৫২০ পৃষ্ঠা)

কিছু লোকের পরিভাষায় ওরস বলা হয় কোন বুযুর্গ বা পীরের মাযারে তাঁর মৃত্যূ দিবস পালনের নামে ধর্মীয় জলসার আয়োজন করা। এবং তাঁর ভক্ত জনগনের ভিড় অর্থাৎ একটি মেলার রূপ ধারণ করা। আল কুরআনের কোথাও ওরস শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু হাদীসে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বাসর রাতের মিলন অর্থে।

যেমন বিখ্যাত সাহাবী আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনায় রসুলুল্লাহ (সাঃ) ক্ববরের বর্ণনা দিতে গিয়ে মালাইকারে (ফেরেশতার) মুখ দিয়ে নেককার লোকদের বলেন,নাম কানাওমাতিল আরুস অর্থাৎ তুমি বাসর রাতের বর-কনের ঘুমের মত ঘুমাও। (তিরমিযী, মিশকাত--২৫ পৃষ্ঠা)।

মহানবী (সাঃ) এর মৃত্যূর সময় তাঁর সাহাবায়ি কিরাম ছিলেন এক লক্ষ চৌদ্দ হাজার। (উলূমুল হাদীস ২৬৮ পৃষ্ঠা)

ঐ সব মাননীয় সাহাবীগণের মৃত্যূর নাম করে কোন রকমই ওরস পালন করা হয়নি বা হয় না।

তাবি-তাবিঈনদের পরবর্তী যুগে মুসলিমরা যখন ইসলামী শিক্ষা থেকে দূরে সরে যায় এবং মুশরিকদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পায় তখন তাদের সহচার্যে অজ্ঞ মুসলিমদের মধ্যে কিছু মুশরিকী ধ্যান ধারণা ও কার্যাবলী স্থান পায়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন রূপ শিরকের প্রচলন রয়েছে। আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহর নবী (সাঃ) এর ক্ববরে অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) ক্ববরে ব অন্য কোথাও, তাঁদের নামে ওরস বা ইসালে সওয়াবের অনুষ্ঠান হতে দেখা যায় না। এমনকি নবী (সাঃ) কোন জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস উৎযাপনের নির্দেশ দিয়ে যাননি। তাই সাহাবা (রাঃ)গণও তার প্রচলন করেননি। অথচ একদল লোক পীর মুর্শিদের মাযারে এবং অন্যত্র ওরস এবং ইসালে সওয়াব প্রভৃতি অনুষ্ঠানাদি করে যাচ্ছে। (সংক্ষেপিত।) ( সূত্র পাকা মাযার ও ওয়াসীলার তত্ত্বসার ৯-১১ পৃষ্ঠা)

১২. রওজা বা রওজা শরীফঃ- রওজা আরবী শব্দ। এর অর্থ বাগান বা উদ্যান। রসুল (সা) বলেছেন ''আমার ঘর এবং আমার মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানটি রওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাত'' অর্থাৎ জান্নাতের বাগান সমূহের একটি বাগান। (সূত্র-মুসলিম সমাজে প্রচলিত ভূল- আব্দুস শহীদ নাসিম)

মহানবী (সাঃ) কবরকে রওজা বলেছেন বা বলতে বলেছেন এমন কোন প্রমাণ কি আছে? কুরআন বা হাদীসে কোথাও কবরকে রওজা বলা হয় নাই। সাহাবীগণও বলেন নাই, তাবেয়ীগণও বলেন নাই।

সুতরাং যারা পূণ্যবান ব্যক্তিগণের কবরকে 'রওজা পাক', 'রওজা মোবারক' বা 'রওজা শরীফ' বলে তা কবরের প্রতি তাদের ভক্তি বা শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্যই বলে। এই ভক্তি বা শ্রদ্ধার বিষয়টি তাদের আকিদা বা বিশ্বাসে পরিণত হয়ে যায়। ফলে এটা শিরক পর্যন্ত পৌছুতে পারে।

কবরকে অন্য কিছু বলা উচিৎ নয়। কবরকে কবর বলাই ইসলামী পরিভাষা। কবরকে রওজা, দরগাহ, মাযার বলা যাবে না । 'শরীফ' তো প্রশ্নই আসেনা।

১৩.কুলখানি বা ফাতেহা খানিঃ- আমাদের দেশে, ভারত এবং পাকিস্থানে কিছু লোক আত্মীয়-স্বজন বা কেউ মারা গেলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এসবের নাম দিয়েছে কুলখানি, ফাতেহা খানি, চারদিনা, চল্লিশা ইত্যাদি। এগুলো এখন মুসলমানের গলায় কাঁটার মালার মতো ঝুলে আছে। আল্লাহর রসুল (সাঃ) এগুলো চালু করেন নাই। সাহাবীগণও এসব কাজ করেননি। এসব অনুষ্ঠান সুন্নতের খেলাফ।

এ ব্যাপারে কুরআন এবং হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য হলোঃ মানুষের মৃত্যূ হলে দুনিয়ার সাথে তার সকল আমল ছিন্ন হয়ে যায়। তবে তিনটি নেক আমলের সওয়াব তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকে।

সেগুলো হলোঃ-

০১) তিনি যদি নেককার দ্বীনদার সন্তান রেখে যান এবং তারা যদি তার জন্যে দোয়া করে, তবে তিনি সে দোয়ার ফল পাবেন।

০২) তিনি যদি দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে বা প্রচার করে গিয়ে থাকেন, তা ব্যক্তি ও প্রজন্ম পরম্পরায় যতোদিন হস্তান্তর হতে থাকবে, চর্চা ও আমল হতে থাকবে, তিনি তা থেকে সওয়াব হাসিল করতে থাকবেন।

০৩) তিনি যদি জনকল্যাণে কোন স্থায়ী কাজ করে গিয়ে থাকেন, তবে জনগণ যতোদিন তা থেকে উপকৃত হতে থাকবে,তিনি ততোদিন তা থেকে সওয়াব হাসিল করবেন।

১৪. মিলাদঃ- মিলাদ আরবী শব্দ এর অর্থ জন্ম বা জন্মদিন বা জন্মকাল ইত্যাদি বুঝায়।

আমাদের দেশে কারো মৃত্যু হলে বা কোন ব্যবসা শুরু করার সময় অথবা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে মিলাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। মৃত্যু হলে জন্মদিন পালন করছে শুধু অর্থ না বুঝে। এক শ্রেনীর আলেম এটা চালিয়ে যাচ্ছেন দু'টি পঁয়সার জন্য। প্রচলিত মিলাদ গোপন শির্ক এবং স্পষ্ট বিদআত। মিলাদ একারণে বিদআত যে, এ অনুষ্ঠানের দলিল কুরআন, হাদীস, ইজমা, ক্বিয়াস ও ফিক্বাহর কিতাব সমুহে কোথাও নেই। চার মাযহাবেও এর কোন স্বীকৃতি নেই। শুধু মাত্র বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের আলিমদের মধ্যেই এটা চালু রয়েছে। আরব, মিশর, কুয়েত, জর্দান, তুরস্কের মত কোন মুসলিম দেশে এ প্রথা অদ্যাবধি চালু হয়নি। কোন আলিম পরের বাড়িতে ছাড়া নিজের বাড়িতে এটা কখনো করেন না। মিলাদে ইজহার ইয়া রাসুলুল্লাহ বলে ডাকা এবং হাজির-নাজির ধারণা করা কেবল গোপন নয় প্রকাশ্য শিরক। (সংক্ষেপিত)

প্রাক ইসলামী যুগে এক জাতীয় আচার অনুষ্ঠান ছিল। যেমন- গ্রীক, ইউনান, ফিরায়ানা ইত্যাদি সভতায় তারা স্বীয় দেবতার অনুষ্ঠান উৎযাপন করত। তাদের থেকে গ্রহণ করেছে তাদের পরবর্তী খৃষ্টান সম্প্রদায়। যাদের কাছে বড় ঈদ তাদের নবীর জন্মদিন পালন করা। খৃষ্টানদের জন্মোৎসব বা বড়দিন অনুষ্ঠান শুধু প্রাক ইসলামী যুগেই ছিলনা বর্তমানেও আছে, সেখান থেকেই অনুসৃত হয়ে এক শ্রেনীর মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। (সংক্ষেপিত)।

১৫. সূফীঃ- 'সূফী' শব্দটি সাফ (পবিত্রতা) অথবা সূফ (পশম) অথবা সূফফা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তাসাউফ পন্থীদেরকে সূফী বলা হয়। এরা আধ্যাত্মিকতাবাদীও বটে। এদের গুরুকে পীর নামে অভিহিত করা হয়। (সূফী তত্বের অন্তরালে, অধ্যাপক আব্দুন নূর সালাফী ১ পৃষ্ঠা)

সূফীবাদ মূলতঃ ইরানী দর্শন, বেদান্ত দর্শন, গ্রীক দর্শন, জরথ্রোষ্ট দর্শন ইত্যাদি থেকে ইসলামে অনুপ্রবেশ করেছে। ঐ দর্শনগুলোর জগাখিচুরী রূপ হলো 'সূফীবাদ'। এ সূফী বাদ কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উৎপত্তি লাভ করে নাই। কুরআন ও সুন্নাহর কোথাও এর প্রমাণ নাই । (প্রাগুক্ত-পৃষ্ঠা-৪৯)

কুরআনের একটি আয়াতও এর প্রমাণে পেশ করা সূফীদের সাধ্যাতীত। রসুল কোন গোপন ইলম কোন সাহাবীকে শিক্ষা দিয়ে যাননি।

আল্লাহ তাআলা বলেন-''হে রসূল! তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে তোমার কাছে ওহীস্বরূপ যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তার সবগুলোকে হুবহু (জনগণের কাছে) পৌঁছিয়ে দাও। যদি তুমি তা না কর তাহলে তুমি তাঁর দেয়া রিসালাতের দায়িত্বকেই পৌঁছালে না।'' (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত-৬৭)

একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, নবী (সাঃ) তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। কিন্তু সূফীদের উক্তিঃ দ্বিতীয়টি (বাতেনী ইলম) অতি গোপনীয় যা মনোনীত সাহাবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এটাই ইলমে সীনা। তাদরে এ দাবীর দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে যে, রসুল (সাঃ) বহু জিনিসকে গোপন করেছিলেন। করলে তিনি রিসালাতের দায়িত্বই পালন করেননি বলে বুঝবে। (নাউজুবিল্লাহ)। অথচ তিনি একটি হুকুমও গোপন করেন নি।

১৬. শবে-বরাতঃ- শব শব্দের অর্থ রাত্রি আর বরাত অর্থ মুক্তি, অতএব শবে-বরাত অর্থ মুক্তির রাত্রি। কিন্তু নামটি হাদীসের ভান্ডারে কোথাও নেই। রসূল (সাঃ) এ নামে এ রাত্রিকে আদৌ উল্লেখ করেন নি। কারণ 'শব' ফারসী শব্দ আর 'বরাত' আরবী শব্দ। অর্ধেক ফারসী আর অর্ধেক আরবী শব্দ সংযোগে কোন আরবী নাম হতে পারে না। হাদীসে উক্ত রাত্রিকে 'লায়লাতুন নিসফো মিন শা'বান' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং বিভিন্ন হাদীসে এর কিছু ফজিলতও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কিছু হাদীস বিশেষজ্ঞদের মতে এ হাদীস গুলো সহীহ নয়। (আমরা সে তর্কে যাব না)। মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী স্বীয় মিরকাতে (২য় খন্ড ১৭৮ পৃষ্ঠা) শবে-বরাতের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। এ রাত্রে কবর জিয়ারতে যাওযার কোন নির্দেশ নেই। তবে কোন হাদীসেই ঘরবাড়ি সাজানো বা মসজিদ সাজানো, হালুয়া রুটি, পটকা ফোটানো, ঘরে মোতবাতি জ্বালানো রসম-রেওয়াজের উল্লখ নেই। বরং এসবই বিদআত ও অনৈসলামিক কাজ। তবে সামর্থ্যনুসারে অন্যান্য রাত্রির ন্যায় উক্ত রাত্রিতে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করা, তাসবীহ তাহলীল, কুরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদের সলাত ইত্যাদিতে লিপ্ত হওয়াতেই মঙ্গল। (বিস্তারিত দেখুন- ইসলামের দৃষ্টিতে শা'বান ও শবে-বরাত মাওলানা মুনতাসির আহমাদ রাহমানী)

বিষয়: বিবিধ

৯২৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File