চিনির ঠোঙা, সাদা বাবু এবং বিবর্তনের বীজ
লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ২৬ জুলাই, ২০১৮, ০৯:৫৯:০০ সকাল
সমকালীন ডেস্ক - ২০-জানুয়ারী-২০১৪ ৮:৩৮
১. সোহেল রোজারিও:
সাদা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে সোহেল মাঝে মধ্যে আমাদের সাথে জুম’আর সালাহ আদায় করত। ছোট শিশু যেমন তার বাবাকে দেখে দেখে ভুল ভুল সালাহ আদায় করে ঠিক তেমন করেই সে সালাহ আদায় করত। আমাদের মধ্যে দু‘একজন সোহেলকে কালেমার কি মানে তা বোঝানোর চেষ্টা করছিল। কেউ কেউ সোহেলকে মুসলমান হওয়ার জন্য আমন্ত্রণও করল। কেউ আবার আগ বাড়িয়ে মনে করল এই যাত্রায় সে মুসলমান হয়েই যাবে।
বেটে-খাটো একজন মানুষ সোহেল, বয়স তখন ২৮ থেকে ৩০ এর কাছাকাছি হবে। আমাদের বয়স তখন ১১ কি ১২ বছর হবে। তবে পাড়ায় খেলার সাথীদের মথ্যে কারও বয়স তখন ১৪-১৫ বা বেশী হতে পারে। খুব সহজেই এই ছোট ছোট ছেলে গুলোকে সোহেল তার বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে। মজার ব্যপার হল পাড়ার ২৮-৩০ বছর বয়েসি বড় ভাইরাও সোহেলের বন্ধু। এক কথায় সবাই সোহেলের বন্ধু। হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটি খেলায় অংশগ্রহন, ঈদ, শবেবরাত, জুম’আ সবকিছুতেই থাকত। আর তার ব্যবহারও ছিল খুব মধুর। মানুষের মন জয় করার মত মোটামুটি সব গুণ তার ছিল।
একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকত, তেমন কিছু করতে দেখতাম না। সারা দিন পাড়ায় বসে আড্ডা দেয়া ছিল তার কাজ। যখন যে গ্রুপ আড্ডায় সোহেল তখন সেই আড্ডায়। দিন যায়, মাস যায় বছর ঘুরে আসে ক্রিস্টমাস বা বড় দিন। একটা মানুষ সবার সাথে এত কিছু করল, এত ভাল সম্পর্ক নিয়ে পাড়ায় বাস করতে লাগল, আমাদের উৎসবগুলো পালন করত; তার একটা বড় দিবস আসলে আমরা যাব না—সে কেমন কথা? এটাতো কোন শিষ্টাচার হতে পারে না। হ্যা এই শিষ্টাচার দেখাল অনেকেই। মূলত যারা সোহেলের খুব কাছের বন্ধু ছিল তারাই সোহেলের বড় দিবসকে বড় করার জন্য সোহেলের ঘরে গেল। শুনেছি সেদিন আমার বয়েসি অনেকেই মদ পান করেছিল।
পাড়ার বেশীর ভাগ ছেলের মদ পানের শুরুটা এখানেই। তার বাসার ফ্রিজে সবসময় হুইস্কির বোতল থাকে; একটু এক্সট্রা খাতির দিলে মাঝে মাঝে ওখান থেকে একটু গেলা যাবে এই বাসনায় ছোট/বড়দের মধ্য থেকে কয়েক জন সোহেলকে প্রাণের বন্ধু বানিয়ে নিল।
একদিন আমিও আড্ডায় ছিলাম, হঠাৎ একজন সরাসরি জিজ্ঞাসা করে ফেলল, সোহেল ভাই তোমার ফ্রিজে মাল আছে? সোহেল ভাইয়ের উত্তরটা ছিল এমন: আছে, কিন্তু তুমি খাইবা? তোমার জন্য তো এটা হারাম। খাইয়ো না। সামান্য একটু মনে হয় আছে, আবার আনতে হবে। কিন্তু তুমি খাইলে তোমার পাপ হবে। কিন্তু পাড়াত সেই খেলার সাথী সোহেলের এই উত্তরে যেন আরও বেশী পিপাসু হয়ে গেল। পিপাসা মিটাতে চলে গেল সোহেলের ফ্লাটে।
উদ্দেশ্য কি:
ঐ সময় প্রায় সব পাড়া/মহল্লায় এমন দু‘একটা সোহেল থাকত। যারা আসলে কোন কাজ করত না কিন্তু তারা বিলাসি জীবন যাপন করত।পাড়া/মহল্লার সব কিশোর/যুবকদের কাছের বন্ধু হত তারা। আমি অন্তত তিন চারটি পাড়ার কথা বলতে পারব যেখানে সোহেলের মতই এক শ্রেনীর যুবক থাকত আর সে সবারই প্রিয়। আরও অবাক হওয়ার ব্যপার তাদের সবার সাথে সবার খুব ভাল যোগাযোগ ছিল।
সোহেলের উদ্দেশ্য গুলো এমন:
১. সোহেলের বিলাসি জীবন দেখিয়ে পাড়ার ছেলেদের বিলাসি জীবনের প্রতি লোভ সৃষ্টি করা।
২. সোহেলের দ্বীন কি এবং তার দ্বীনের সব অনুষ্ঠান সম্পর্কে পাড়ার যুবকদের একটা ধারণা দেয়া।
৩. পাড়ার ছেলেদের পর্ণগ্রাফীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া।
৪. পাড়ার ছেলেদের মদ পানে অভ্যস্ত করে দেয়া।
৫. সর্বোপরি সালাহ তথা ইসলাম থেকে দূরে রাখা।
আরও ভাল করে বিশ্লেষণ করলে আরও কিছু উদ্দেশ্য পাওয়া যাবে। তবে আমি এই পাঁচটি উদ্দেশ্যই প্রাধান্য দিচ্ছি। ২০ বছর আগে আমাদের সমাজের মানুষ খুবই ধর্ম ভীরু ছিল, যুবকদের মসজিদে যেতে দেখা যেত। মদ পান হারাম এবং অপরাধ মনে করা হত। তখন সোহেলের মত মানুষ দেখা যেত না বললেই চলে।
২০ বছর পরে:
ঐ যুবকদের মধ্য থেকে (যারা যারা মদ পানে যেত) বেশ কয়েক জন মারা গিয়েছে, দুই তিন জন পাগল হয়ে গেছে, বাকীরা ড্রাগ এডিক্টেড। অদ্ভুত ব্যপার মৃতরা এক সময় মদে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। পাগল হয়েছে যারা তারা মদ সহজে যোগাড় করতে পারত না, কারণ তখন গুলশানের ক্লাব/বার গুলোতে মদের দাম ছিল বেশী এবং সহজে কেনা যেত না। তাই কয়েকজন সহজ নেশা গাজায় আর ফেন্সিডাইলে আসক্ত হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে পাগল। একজন পাগলের কথা মনে পড়ে, ছিমছাম সুন্দর যুবক, অসাধারণ ব্যাডমিন্টন খেলত। কিন্তু সোহেলের শুরু করিয়ে দেয়া নেশা তাকে বদ্ধ পাগল করেই ছাড়ল।
আর ড্রাগ এডিক্ট হয়ে যারা বেঁচে আছে তারা জেল খাটছে বা ফেরারী আসামী হয়ে বেঁচে আছে।
ধর্মান্তরিত করার বা ধর্মকে দূষিত করার বিবর্তনের বীজ এভাবেই গুঁজে দেয়া হল। বিবর্তনের অ্যাম্বাসেডর হল সোহেল, পিন্টু, লিন্ডা, জেমস সহ আরও অনেকে। ২০ বছর পরে এটাই ছিল সোহেলদের সম্পর্কে আমার উপলব্ধি।
২. চিনির ঠোঙ্গা
ঠোঙ্গার সাথে পরিচয় নাই এমন বাংলাদেশী খুজে পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে ঠোঙ্গা বানানো হয় সব পুরাতন ফেলে দেয়ার উপযুক্ত কাগজ দিয়ে। পুরাতন বই, পত্রিকা, পরীক্ষার উত্তর পত্র, চিঠি, সরকারী কাগজ, পাঠ্যপুস্তক কি নেই এই ঠোঙ্গা বানানোর উপকরণে। কখনই ঠোঙ্গার কাগজের বিষয়বস্তু আমাদের আকর্ষণ করেনি। মাঝে মধ্যে দেখা যেত হয়ত কোন হাস্যকর কোন কিছু ঠোঙ্গায় থাকলে সেটা নিয়ে পাড়ায় বন্ধুরা আড্ডা জমাত।
কিন্তু এমন কখনও কি হয়েছে, আপনি দিনের পর দিন ঠোঙ্গার কাগজ জমিয়ে রাখছেন? ঠোঙ্গার ধারাবাহিক বিষয় গুলো নিয়মিত পড়ছেন?
আমার মায়ের অভ্যাস হল তিনি পত্রিকা জমাতেন, যদি কোন বড় বিষয় তার মনে ধরত কিন্তু সময়ের কারণে পড়তে পারতেন না, তিনি জমিয়ে রেখে অবসর সময়ে তা পড়ে নিতেন। আমরা কয়েক দিন পর পর মায়ের বালিশের নিচে বা পায়ের কাছে বিছানার নিচে এক বাঞ্চ পুরাতন পত্রিকা বের করতাম আবার ফেলে দিতাম। ব্যতিক্রম হল যখন মা ঠোঙ্গা জমানো শুরু করলেন। এবং খাবারের টেবিলে চিনির ঠোঙ্গা যত্ন করে খুলে নিয়ে পড়তে থাকতেন। প্রথম প্রথম ততটা খেয়াল করিনি, খেয়াল করার কথাও না। সবসময় তিনি নিউজ পেপার কাটিং পড়েন এটাও এমনই কিছু হবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে একটু লালচে ধরনের নিউজ প্রিন্ট পেপারে একটা টাইটেল লিখা ‘ঈসা (আঃ)’ যা মা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। আগ্রহ নিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলাম এমন আরও কয়েকটা ঠোঙ্গার ভাজ খোলা কাগজ। একটা নিয়ে পড়লাম। ছোট একটা গল্প যেখানে নবী ঈসা (আঃ) এর বিভিন্ন মুজেজার কথা বলা হচ্ছে।
আরেকটু খেয়াল করলাম, কাগজের ভাজ বন্ধ করলে একটা চিনির ঠোঙ্গার আকার ধারণ করছে, এমনকি ঐ একটা কাগজেই একটা গল্প বলা শেষ হয়েছে। আগ্রহের মাত্রা বেড়ে গেল। মায়ের হাতের সব গুলো কাগজ নিয়ে পড়লাম। অদ্ভুত ব্যপার প্রতিটা গল্প একটা করে ঠোঙ্গায় শেষ। এবং বেশীর ভাগ গল্পে নবী ঈসা (আঃ) কে ঈসা (আঃ) বলা হচ্ছে। কিছু শব্দ তারা ব্যবহার করছে তা ইসলামিক পরিভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত। আর প্রায় প্রতিটা ঠোঙ্গায় মরিয়াম (আঃ) এবং ঈসা (আঃ) এর ছবি আকা থাকত।
আমার মা অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ। দ্বীন ইসলামের সাথে তিনি আপোষ করেন নাই এটাই উনার কালচার। তিনি প্রতিটা গল্পকে নিয়েছেন ইসলামী কোন সাহিত্যের অংশ হিসেবে। আমার বয়স তখন খুবই কম, ১৩-১৪ হবে, স্কুলে পড়ি। আর সবার মতই আমার ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান। বলতে গেলে নামাজের নিয়ম ছাড়া আর কিছুই জানি না। তবে ইসলামিক সাহিত্য হলেও ছবি আকা থাকবে না এটা বুঝার জ্ঞান তখন আমার ছিল। তাই আমি মা-কে বললাম মা, এই ঠোঙ্গাগুলো তুমি আর পড় না। এগুলো কোন ইসলামি সাহিত্য না, বরং আমার মনে হচ্ছে এগুলো কোন খ্রিষ্টান সাহিত্যের বইয়ের পৃষ্ঠা। আমার মনে আছে ঐ ঠোঙ্গা গুলোকে খ্রিষ্টান সাহিত্য বলতে আমার খুব সমস্যা হচ্ছিল। প্রধান কারণ, বইয়ের গল্প আপনাকে এমন ধারণা দিবে যে আপনি মুসলিম আর খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মাঝামাঝি একটা ছবি দেখতে পাবেন।
বিশ্লেষণ এবং উপলব্ধি
১৯৯২/৯৩ সালে বাংলাদেশে কতজন খ্রিষ্টান ছিল আর কত জনই আমরা আমাদের সমাজে দেখতাম তা আমার সমসাময়িক সবাই জানেন।
সোহেল রোজারিও, পিন্টু, লিন্ডা, জেমস, পলাশ এদের মত অ্যাপয়েন্টটেড খ্রিষ্টান দায়ী ছাড়া সাধারণ খ্রিষ্টান দেখা যেত না বললেই সঠিক বলা হবে। সমসাময়িক কালে (ধর্মীয় বই ছাড়া) পরীক্ষার উত্তর পত্র, খাতা, নিউজ পেপার বা অন্যান্য কাগজ থেকে ঠোঙ্গা পাওয়া সম্ভব। কারণ একটা স্কুলে সারা বছরের জমানো কাগজ বিক্রি করে দিলেই বা সব ছাত্র ছাত্রীরা তাদের সারা বছরের ব্যবহৃত পাঠ্য বই, খাতা বিক্রি করে দিলেই আপনি ঠিক তার পরের বছর তাদের কাগজে তৈরী ঠোঙ্গা হাতে পেতে পারেন।
কিন্তু কত দিন ব্যবহার করার পরে একটা ধর্মীয় সাহিত্যের বই বা বাইবেল এতটাই পুরাতন হতে পারে যে তা বিক্রি করে দিতে হয় এবং তা থেকে ঠোঙ্গা প্রস্তুত হয়। যাদের ঘরে বেহেশতি জেওর টাইপ বই আছে আমার ধারণা ছিড়ে কুটে গেলেও তারা সেটা ফেলে দেন না। বাংলাদেশে ১৯৯২/৯৩ সালের আগে এমন কোন বড় খ্রিষ্টান কমিউনিটি ছিল না যে তাদের ব্যবহৃত ধর্মীয় বই গুলো পুরাতন হয়ে গিয়েছিল আর তারা তা বিক্রি করে দেয়ার পরে তা দিয়ে ঠোঙ্গা প্রস্তুত হয়েছে।
এখনও অংক টা যারা মিলাতে পারেন নাই তাদের অংক মিলিয়ে দিচ্ছি।
সেই সময়ে বাংলাদেশে কর্ম সংস্থান ছিল একটা সামাজিক সমস্যা। মাত্র স্বৈরাচারী সরকার এরশাদের পতন হয়েছে। স্বৈরাচারী সরকার এরশাদের সকল পাপের একটা বড় পাপ ছিল সে কোন কর্ম সংস্থান সৃষ্টি করতে পারছিল না। এরশাদের সময় মিশনারীদের তেমন সুযোগ দেয়া হত না এবং জবাবদিহিতা ছিল বেশী। সেই সময় এরশাদের পতনের পরে মিশনারীরা রকেটের গতিতে তাদের দাওয়াতি কাজ শুরু করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সফল হতে শুরু করে। কিন্তু নতুন খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করা মানুষ গুলো তাদের বাপদাদার ভিটায় থাকতে পারে না। কারণ সমাজ তাদের ঘৃণা করতে শুরু করে। তাদের ভিটে ছাড়া হতে হয় এবং তাদের কর্ম সংস্থানের প্রয়োজন হয়।
ধরা যাক ১০ টি নতুন খ্রিষ্টান পরিবারের নতুন কর্মসংস্থান দরকার। মিশনারী যদি কয়েক টন বাইবেল (বিশেষ ভাবে মুদ্রিত) সেই দশ পরিবারকে দিয়ে বলে এই বাইবেলের পাতা দিয়ে ঠোঙ্গা বানাও আর বিক্রি কর, তবেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। পাশাপাশি রক্ষনশীল মুসলমানদের ঘরে ঘরে চিনির সাথে ফ্রি বাইবেলের শিক্ষা পৌছে দেয়া যায়। অথচ সেই সময়ে এটা অসম্ভব ছিল কোন খ্রিষ্টান মিশনারী প্রকাশ্যে তার ধর্মের দাওয়াত দিবে। তাই রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে খ্রিষ্টান ধর্মের বাণী প্রচার করতে তারা এই পদ্ধতিটা বেছে নিয়েছিল।
৩. হানিফ সংকেত এবং সাদা ডাক্তার বাবু
ধরুন আপনি একজন সদ্য পাশ করা প্র্যাকটিসিং মুসলমান ডাক্তার। আপনাকে পঠিয়ে দেয়া হল বুরুন্ডী নামের আফ্রিকার প্রত্যন্ত এক দেশে। বুরুন্ডীতে পাঠানোর আগে আপনাকে কিছু ট্রেনিং দেয়া হল, কি ট্রেনিং দেয়া হল তা সময় হলে বলব।
এখন চলুন বুরুন্ডী। আপনি এখন বুরুন্ডীর বুরুহুকিরু নামক প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায়। সব ধরনের নাগরিক সুযোগ সুবিধায় বেড়ে উঠে দেশের সবচেয়ে নামকরা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এখন এসেছেন বুরুহুকিরুতে।
আপনি কোথায় আছেন তার একটা বর্ণনা শুনুন:
আপনার ডানে বায়ে কোথাও সুপেয় পানি নেই। খাবার পানি আনতে যেতে হয় কয়েক মাইল হেটে এক কুপ থেকে। গোসল করতে আপনাকে কেউ আটকাবে না, তবে গোসল করার জন্য কোন পানি পাওয়া যাবে না। সবুজ পাহাড়ি এই জনপদে কালো গোখরা সাপ আমাদের দেশে বর্ষার কেঁচোর মতই স্বাভাবিক। খাবারের তেমন সমস্যা হবে না আপনি খাবেন ফ্রেশ সব্জি, ফ্রেশ খাশির মাংস। গ্রামের ছেলেদের দুয়েক ফ্রান্ক দিলে তারা খরগোশ ধরে দিবে। আর বনজ ফল ফলাদির কোন অভাব হবে না। পরিষ্কার মিঠা পানিতে গোসল করতে হলে সপ্তাহে একবার যেতে পানে লেক তাংগানিকাতে। মিঠা পানির সমুদ্র বললে ভুল বলা হবে না। তবে যেতে হলে আপনাকে যেতে হবে প্রায় ৩০ মাইল দূরে। কোন বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। সন্ধায় সাপের উপদ্রব বাড়ে, রয়েছে নেকড়ের ভয়। তবে আপনি এখন যে বাড়িটিতে আছেন তা মাটির ঘর হলেও যথেষ্ট সিকিউরড। আপনার সাথে আমরা দিয়েছি ক্লোরোফর্ম যেন সাপ ঝামেলা না করে, তবে সাপ ঝামেলা করতে পারে এমন বিশ্বাস রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
আপনার কাজ হল গ্রামের ১৭০০ মানুষের মাঝে চিকিৎসা সেবা দিতে হবে। বিশেষ করে সাপে কাটা মানুষ, ম্যালেরিয়ার রোগী সহ সাধারণ যে কোন রোগের চিকিৎসা। চিকিৎসা করার পরে আপনি হাসি মুখে তাদের খোঁজ খবর নেবেন। ভুলেও টাকা চাইবেন না। তবে তারা কিছু দিতে চাইলে হাসি মুখে নেবেন—সেটা এক ছড়ি কলা হলেও। হাতে তাদের দেয়া উপহার নিয়ে হাসি মুখে জানতে চাইবেন তারা দুপুরে খেয়েছে কি না। বাচ্চা থাকলে তাদের হাত থেকে কলা খেতে দেবেন। আপনার সাথে দিয়ে দেয়া বেশ কয়েক প্যাকেট ক্যান্ডি/বিষ্কুট আছে। সব সময় সাথে কিছু রাখবেন, কারণ গ্রামে হাটতে হাটতে আপনার ক্লান্ত লাগবে তখন সেখান থেকে খেয়ে নেবেন আবার বাচ্চাদের সময় মত খেতে দেবেন। যেহেতু আপনাকে আমরা বুরুন্ডীর ভাষা শিখিয়েছি আশা করি গ্রামের মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে আপনার বেশী সমস্যা হবে না। তবে এক বছরের মধ্যে আপনি রুন্দী ভাষায় ফ্লুয়েন্ট কথা বলা শিখে যাবেন। আপনার যখন যা প্রয়োজন হবে তখন আমরা তা পাঠিয়ে দিব। আপনাকে মাসে একবার রাজধানী বুজুমবুরা যেয়ে আপনার জন্য পাঠিয়ে দেয়া জিনিস পত্র আনতে হবে।
কি করবেন?
আপনার এই বাসাটা একটা দুই বেডের হাসপাতাল। আপনি প্রতি দিন সকালে উঠে নিজে নিজে ফজরের আজান দেবেন, তারতিলের সাথে কোরান পাঠ করবেন। ফ্রেশ হয়ে সকালে একটু হাটতে বের হবেন। গ্রামের মানুষ তখন ঘুমাতে থাকবে, শুধু কিছু কাঠুরিয়া আর ফল চাষীর দেখা পেতে পারেন। তাদের সাথে কুশল বিনিময় করবেন। মত বিনিময় করবেন। তারা আপনার কোরান তিলাওয়াতের কথা জিজ্ঞাসা করলে হাসি মুখে বলবেন আপনি যে ধর্মের লোক সে ধর্মের কিতাব হল কোরান এবং এই মধুর তারতিল নিশ্চই তারা অগ্রাহ্য করতে পারবে না। কিন্তু কখনও ভুলেও তাদের ধর্মের দাওয়াত দেবেন না, ট্রেনিংয়ের সময় আপনাকে আমরা এই কথা বলেছি। যখন যেখানেই থাকবেন ওয়াক্ত হলে আপনি আপনার ওয়াক্তের সালাহ আদায় করে নেবেন। প্রতিদিন বিকালে গ্রামের সম্মানিত মুরুব্বিদের নিয়ে মিটিং করবেন কেমন করে ম্যালেরিয়া দূর করা যায়। কেমন করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা যায়। সুন্নাহর প্রতিটা একশন সঠিক ভাবে করবেন, কিন্তু ভুলেও বলা যাবে না এইগুলোও আপনার ধর্মের এবাদত। আপনার ধর্মের সকাল হতে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটা কাজ করবেন স্বাভাবিক ভাবে। যেন তাদের দেখে মনে না হয় এটা ধর্মীয় কাজ। সম্ভব হলে প্রতি ওয়াক্তে আজান দেবেন। আপনাকে তিন ধরণের সুরে আজানের ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। ফজরের আজান, দিনের ওয়াক্ত এবং এশার সময়ের। কখনই ফজরের সুর দিনের বেলায় দেবেন না।
ঈদের সময় চারটা খাসি কিনবেন, গ্রামের মানুষ খাশির মাংস খেতে পায় না। তাই তাদের ডেকে মাংস বিলিয়ে দেবেন। সম্ভব হলে কুরবানির সময় একটা গরুর ব্যবস্থা করবেন। ঈদ আপনার দ্বীনের আনন্দ এই কথা তাদের খুব সংক্ষেপে বলবেন। যেন তারা আপনার মধ্যে দাওয়াত দেয়ার প্রবণতা দেখতে না পায়। আবারও বলছি আপনি কখনও ধর্মের দাওয়াত দেবেন না। আপনার কাজ হবে শুধু মানুষের সেবা করা, মানুষকে গোসল, এস্তেঞ্জা, খাওয়া সব কিছুতেই শরিয়তের জীবন বিধান মত দেখিয়ে দেবেন। কিন্তু তারা মনে করবে একজন নিবেদিত প্রাণ ডাক্তার হাজার মাইল দূর থেকে এসে কত ভাল কাজ করছে, কত ভালো কাজ শেখাচ্ছে।
এভাবে চলে যাবে আপনার ৫ বছর। আপনার বিয়ে করা দরকার হবে। আপনি কয়েক সপ্তাহের জন্য দেশে আসবেন বিয়ে করে বউ নিয়ে যাবেন। আপনার আরেকটা জীবন শুরু হবে। আপনার বউও হবেন একজন ডাক্তার। এভাবে আপনারা আরও ৫ বছর পার করবেন। আপনাদের সন্তান আসবে। আপনাদের সম্মান হবে, আপনাদের সুনাম ছড়িয়ে যাবে সমস্ত বুরুন্ডীর থেকে সেন্ট্রাল আফ্রিকা পর্যন্ত।
বুরুন্ডীর টেলিভিশন থেকে তাদের জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠানের উপস্থাপক আসবে আপনার সাক্ষাৎকার নিতে। আপনি রুন্দী ভাষায় সুন্দর করে কথা বলবেন। আপনার গালে দাড়ি, মাথায় টুপি। আপনার কথায় মুগ্ধ হয়ে যাবে সমস্ত বুরুন্ডীবাসী। এই ভাবে আরও কয়েক বছর কেটে যাবে।
একদিন আপনি আপনার গ্রামের মানুষদের বলবেন আপনার দেশ থেকে কিছু ছেলে আসবে সরকারি সাংস্কৃতিক সফরে। তারা তিন মাস থাকবে এবং সরকার তাদের বুরুন্ডীর সংস্কৃতি জানার জন্য তাদের গ্রামই বেছে নিয়েছে। প্রায় ২০ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে তিন মাসের মধ্যে দুই মাস আপনাদের গ্রামেই থাকবে। আসলে এই পুরো ট্রিপটা আমাদের ডিজাইন করা। কিন্তু আপনি এই ব্যপারে কিছুই জানেন না।
আপনার প্রতি গ্রামবাসীর যার পর নেই বিশ্বাস, ভালবাসা তাই গ্রামবাসী যদি ২০জন ছেলেকে কোন সংবর্ধনা দিতে চায়, মানা করবেন না। তাদের যদি স্পেশাল খাতির করে না করবেন না। বরং আপনি বলবেন ১২/১৩ বছর হয়ে গেছে আপনি তাদের সাথে আছেন, এখন আপনার দেশের মানুষ আসবে সেই খবরে আপনিও আনন্দিত। তাই আপনি আপনার বউ নিয়ে স্পেশাল খাবার রান্না করবেন তাদের জন্য সাথে গ্রামের প্রায় ২০০ জন মুরুব্বী দাওয়াত করবেন সেদিন। এবং ছেলেদের পরিচয় করিয়ে দেবেন।
তাদের মধ্যে একজন খালি মুখে আজান দিবে। এই সুর অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা কারও নাই। ২০ জন সহ আপনারা দুই জন জামাতে সালাহ আদায় করবেন। গ্রামবাসী যদি জানতে চায় বলবেন তারাও আপনার ধর্মেরই। আপনার নিয়মিত জামাতে সালাহ আদায় করবেন। মানুষ দেখবে আপনারা ৫ ওয়াক্ত সালাহ আদায় করছেন। আপনি ক্ষেত করবেন, আপনার হাতে থাকবে কাদা, আপনি অজু করবেন তারা দেখবে। ছেলেরাও গ্রামের চাষীদের সাহায্য করবে, আজানের সময় নামাজে আসবে। গ্রামের মানুষ দেখবে আপনারা অজু করে সালাহ আদায় করেন। এরই মধ্যে আপনার হাসপাতাল দুই বেড থেকে ২০ বেডে উন্নীত হবে। এরই মধ্যে আপনি গ্রামের মুরুব্বিদের সহায়তায় গ্রামে একটা স্কুল করেছেন, আপনার ঘরের কাছে একটা ছোট মসজিদের মত বানিয়েছেন।
২০ ছাত্র সবায় স্পেশাল ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তারা গ্রামের সবার সাথে মিশে যাবে। তাদের সুখ/দুঃখ সব শেয়ার করবে। তারা একটু একটু রুন্দী ভাষায় কথা বলার ট্রেনিং নিয়েছে। তাই তারা সহজে কমিউনিকেট করতে পারবে। তারা যা করবে তা আমাদের রিসার্চ সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দেয়া হয়েছে। দুই মাসে তারা সমস্ত গ্রামের মানুষের মন জয় করবে। চলে আসার সময় তারা তাদের শরীরে ধারণ করা বেশ কিছু জিনিস যেমন ঘড়ি, জুতা, সানগ্লাস ইত্যাদি তাদের উপহার হিসেবে দিয়ে আসবে। এবং মমতায় তাদের চোখে জল আসবে। আপনিও চোখে জল ফেলবেন। বিদায়ের দিন এই ছেলেগুলোকে ১৭০০ মানুষ সহ আরও হাজার হাজার মানুষ আসবে অন্য গ্রাম থেকে বিদায় জানাতে। তারা চলে আসবে দেশে। আপনি আগের মতই আপনার কাজ চালিয়ে যাবেন। আবার টিভি আসবে। আপনি বলবেন বুরুন্ডী আপনার নিজের দেশ। বুরুন্ডী ছেড়ে যাওয়ার কথা আপনি চিন্তাই করতে পারেন না।
১৫ বছর পরে আমাদের দাওয়াত দল যাবে ইসলামের দাওয়াত দিতে। আপনার গ্রামে যেয়ে তারা শুধু তাওহিদের কথা বলবে। বাকী সবই তারা জানে, কারন এই ১৫ বছরে তারা সুন্নাহ মোতাবেক তাদের জীবন অভ্যস্ত করে নিয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, আদব, বিয়ে, মানুষের উপকার করা, সত্য বলা, সৎ থাকা, হিতোপদেশ সবই এখন তাদের জানা। শুধু তাওহীদ বুঝতে পারলেই কাজ হয়ে গেল।
ডাক্তার সাহেব কি ভাবছেন?
আরে ভাই মজা করলাম এতক্ষণ। আপনাকে কষ্ট করে বুরুন্ডী যেতে হবে না। সেখানে অনেক আগেই ঈসায়ী ডাক্তাররা চলে গিয়েছে এবং যা করার কথা ছিল তা করে দিয়েছে।
এখন কষ্ট করে একটু পার্বতীপুর যান, যেয়ে দেখেন সাদা কয়েকজন ঈসায়ী ডাক্তার এই কাজটাই করছে, আর হানিফ সংকেত ইত্যাদিতে তাদের বাংলা বলা দেখিয়ে হাত তালি নিচ্ছে।
ওহ পার্বতীপুর যেতে আলস্য লাগছে, থাক যেতে হবে না। চলেন আমরা ফেসবুকে স্টাটাস দেই।
সংগৃহীত-
বিষয়: বিবিধ
১১৪৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন