সংগৃহীত ঘটনা।
লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ১২ জানুয়ারি, ২০১৭, ০২:২১:০৫ দুপুর
আমি তখন যুবক ছিলাম। একদিন দেখি আকাশে খুব মেঘ। ভাবলাম ঝড় হ’তে পারে। পরিবারের সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিলাম। সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি সাগরের দিক থেকে বিরাট জলোচ্ছ্বাস ৩৫-৪০ ফুটের বেশী উঁচু হয়ে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। তখন ভাবলাম বাঁচার আর কোন উপায় নেই। সবাইকে জোরে অাঁকড়ে ধরেছিলাম। ৭-৮ বছরের এক ছেলে আমার কাঁধে ছিল।
পানি এতো জোরে এসে ধাক্কা দিল যে, ছেলেটা ছাড়া আর সবাই হারিয়ে গেল। তখন আমরা অনেক পানির নিচে। পানি আমাদেরকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে। যখন পানির উপরে উঠলাম তখন কোথাও কোন ঠাঁই নেই। কোথাও কোন গাছ বা উঁচু কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। ছেলেটা তখনও কাঁধে। গলা ধরে আছে। ওকে বললাম, আববা! তুমি দু’হাতে আমার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধর, ছেড় না যেন! তাহ’লে ডুবে যাবে। ছেলেটি কাঁদছে আর বলছে, আববা তুমি আমাকে ফেলে দিও না। তাহ’লে আমি কিন্তু ডুবে যাব। তখন আবার ঢেউ চলছে ২-৩ ফুট উঁচু হয়ে। আমরা সেই ঢেউয়ে ডুবে যাচ্ছি। পানি খেয়ে আবার উপরে উঠছি। ছেলেকে কাঁধে নিয়ে আধা ঘণ্টার মত খুব কষ্টে সাঁতার কেটে বেঁচে আছি। কোথাও কোন ঠাঁই দেখা যায় না। তখন ভাবছি, আর বোধ হয় বাঁচতে পারব না। জীবন যায় যায় অবস্থা। মনে মনে ভাবছিলাম, ছেলেটা যদি গলা ছেড়ে ডুবে যেত তাহ’লে হয়তো নিজে বাঁচতাম। পরে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বলে দিলাম, তুই আমার গলা ছেড়ে দে। ছেলে তখন কেঁদে ফেলল। আর কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আববা! তুমি আমাকে ছেড়ে দিও না, আমি ডুবে যাব। বার বার বলার পরেও যখন ছেলেটি গলা ছাড়ছে না, তখন আমি হাত ধরে টান দিই। ছেলে আরো জোরে কাঁদে এবং জোরে গলা জড়িয়ে ধরে। আমরা দু’জনের কেউ মরতে চাই না, আবার কেউ বাঁচতেও পারছি না। (এমন পরিস্থিতিতে আপনি আপনার সন্তানকে নিয়ে একটু কল্পনা করুন তো, কেমন লাগে!)। এটা ছিল মৃত্যুর পূর্বের ভয়াবহ অবস্থা। ছেলের কান্নাতে আমার আর মায়া হ’ল না। আমি ওর হাত টেনে কামড়িয়ে ধরলে সে আমার গলা ছেড়ে দেয়। সাথে সাথে ছেলেটি ডুবে যায়। পানির অনেক নীচে চলে যায়। তখন মনে মনে বললাম, বেঁচে গেছি। এর মাত্র ৫ মিনিট পর আমার পায়ে উঁচু গাছের ডাল লাগল। আমি তার উপরে দাঁড়ালাম। সাথে সাথে ছেলেটির হৃদয় বিদীর্ণকারী কান্নাজড়িত কথা কানে ভেসে আসল। চোখে বাঁধভাঙ্গা অশ্রু নেমে এলো। তখন ভাবছি এই তো ঠাঁই পেলাম, তবে কেন আমার ছেলেটাকে পানিতে ফেলে দিলাম! একি করলাম আমি? এইটুকু সময় আমি তাকে ধরে রাখতে পারলাম না! কত বড় ভুল হয়ে গেল! আমি সেখানে দাঁড়িয়ে জায়গাটাও বুঝতে পারছি। পানি সরে গেলে ওখানে লাশ পাওয়া যাবে। দেড়দিন পর পানি সরে গেল, আমি গাছে ছিলাম। একটু ক্ষুধাও লাগেনি, ঘুমও আসেনি। তারপর ছেলের লাশ সেখানে পেয়ে আরো কষ্ট হ’ল। যে কষ্ট আমি আজও ভুলতে পারছি না। আমার এখন কয়েকটা ছেলে-মেয়ে। বয়স ৬০ বছর। তবুও ঐ স্মৃতি আমাকে পাগল করে দেয়। তাই মাঝে মাঝে ভাবি, দুনিয়ায় এ অবস্থা হ’লে ক্বিয়ামতের দিন কি অবস্থা হবে? যেখানে কোন দিন মরণ হবে না। কেউ কাউকে সাহায্য করবে না।
বিষয়: বিবিধ
১৫৪২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
১৯৯১ সালের ঘুর্ণিঝড় এর সময় এমন অনেক সত্যি ঘটনা শুনেছি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন