বড় কমল দহ ঝর্ণাগুলো- পর্ব-০২
লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ২০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:৩৩:২৬ দুপুর
এটা সেই পথ।
এই পথের পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা। এসব ট্রেইল এক একটা অন্যরকম জগত! আপনাকে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে আবার হারিয়ে যাওয়ার ভয়ও করবে একই সাথে। কোথাও আপনাকে সাবধানে নিচে নামতে হচ্ছে তো একটু পরেই সাবধানে অনেক উচুতে উঠতে হচ্ছে। চলার পথে মাঝে মাঝেই দেখা পাবেন ছোট খাট অনেক ঝর্ণার। যেগুলো চলার শব্দ আপনার মনে ছন্দ জাগাবে, চলতে থাকবেন নতুন উদ্যোমে। পুরোটাই পাথুরে পথ। এক সময় আমরা ট্রেইলের শেষ মাথায় পৌছে গেলাম। ঝর্ণাটা খুব একটা ছোট না। পানি আছে বেশ। আমরা অল্প কিছু সময় অতিবাহিত করে পূনরায় ফেরার চিন্তা করলাম। এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে!
মাঝে মাঝে থেমেছি হঠাৎ।
এবার চলতে চলতে আর কোন শাখা প্রশাখায় প্রবেশ করলাম না। মূল ঝিরিপথ ধরে ফিরতে থাকলাম। আজ আর কোন শাখায় প্রবেশ করার ইচ্ছাও নাই সবার ইচ্ছা অন্যরকম।অনেকটা পথ হেটে ফিরে এসে মূল ঝিরিপথটা যেখানে বেশ চওড়া হয়েছে চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছোটবড় অনেক পাথর। সেখানে বসে পড়লাম সবাই। ব্যাগ হতে লোকেশনটা বের করে দেখতে থাকলাম। এখানেই কোন একটা ঝিরিপথ ধরে এগুলো ঝর্ণার পাশ দিয়ে পাহাড়ের উপরের দিকে একটা পায়ে চলা ট্রেইল উঠে গেছে। সেটা ধরে উপরে উঠলেই একটা পায়ে চলার পথ পাওয়া যাবে সেই রাস্তা ধরে হাটতে থাকলে এক সময় পাকা রাস্তা পাওয়া যাবে যেই রাস্তা গিয়ে মিশেছে মুল রাস্তার সাথে।
আমি সর্বদা মাঝখানে।
সবাই বসে পরামর্শ করছি ইনশা আল্লাহ যে করেই হোক সেই ঝিরি পথ এবং সেই পায়ে চলা ট্রেইল আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। পিছনের রাস্তায় ফিরে আগের সেই প্রথম ঝর্ণার বিপদ জনক রাস্তা নামার ইচ্ছা আমদের কারোই নাই! আল আমীন ভাই বললেন তিনি কয়েক দিন এই পাহাড়ে-জঙ্গলে কাটাতে রাজী কিন্তু সেই খাড়া পাহাড় বেয়ে আর নামবেন না! প্রয়োজনে তাকে কাল সকালে আমাদের দড়ি কিনে এনে নামাতে হবে তবুও তিনি সেই পথে নামতে রাজী না। আমিও কিছুতেই সাহস করতে পারছি না সেই পথে নামার।
এই ঝর্ণার বাম পাশ দিয়ে পাহাড়ে উঠার সেই পায়ে চলা ট্রেইল।
আমরা লোকেশন দেখে, পরামর্শ করে আমরা মূল ঝিরিপথ ধরে আসার সময় প্রথম যে শাখা ঝিরিপথ হাতের ডানে ফেলে এসেছিলাম সেটাই টার্গেট করলাম। এটাই সেই পথ যে পথে গেলে আমরা উপরের দিকে উঠার পায়ে চলা ট্রেইলটা পাব। আবার উঠে হাঁটা দিলাম। কারো কারো পা আর চলে না! পেটে ক্ষুধা। সকালে নাস্তা করা হয় নি। এভাবে বোকার মতো খাবার ছাড়া পাহাড়ে ট্রেকিং করতে আসা ঠিক হয় নি। ক্লান্ত আমরা। চলছি সেই পথের সন্ধানে যে পথ আমাদের বের করে নিয়ে যাবে এখান থেকে।
চলতে পথে এভাবে অনেক বার দম খেয়েছি!
এখন বাজে বারোটা বাজে। আকাশের মেঘ পরিস্কার হয়ে রোদ উঠল। দুপাশের পাহাড় হতে গাছের ছায়ায় ঢাকা ঝিরিপথ ধরে আমরা চলছি। ডাল পাতার ফাঁক দিয়ে হালকা রোদ গলে ঝিরিপথে পড়ছে। পথটা যেন আলো আধারীর খেলা। এক জায়গায় দেখলাম ঠিক ডুমুরের মতো দেখতে কিন্তু বিশাল সাইজের কয়েকটি পাকা আধা পাকা ফল পড়ে আছে। একটা একটা বড় আপেলের সাইজ! আমি এক জায়গায় লাঠি পুতে দিয়ে কাগজে লিখে আমাদের পরের টিমের জন্য দিক নির্দেশ দিয়ে গেলাম যে আমরা এ পথেই আছি।
আমার পিছু পিছু আসুন আমি এখন বস!!
শেষ মাথায় পাহাড়ের দেয়াল ধরে ঝরে পড়া বড়সড় একটা ঝর্ণার ধারে পৌছে আবার বিশ্রাম নিয়ে আমরা পথ খুঁজতে থাকলাম। চারজনে হন্যে হয়ে পথ খুঁজছি। কিন্তু জঙ্গলের ভিতর কোথায় সেই পায়ে চলা ট্রেইল!?! অনেক খোঁজাখুজি করে না পেয়ে আবার ফিরে আসলাম আগের সেই শাখামূখে যেখানে মূল ঝিরিপথ থেকে এই শাখা ঝিরিপথে প্রবেশ করেছিলাম। বাইরে এসে এক জায়গায় বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম আমাদের সাথে দেখা সেই তিনজনের দলের।
ট্রেকাররা যে ময়লাগুলো ফেলে এসেছে আমি আজ টোকাই হয়ে তা কুড়িয়েছি!
আমরা আলোচনা করছি আর অপেক্ষা করছি। কি করা যায় ভাবছি সবাই। অনেক সময় অপেক্ষা করার পর তাদের কোন খোজ না পেয়ে আবার উঠার চিন্তা করলাম। নিশ্চয় কোন পথ আছে যেটার হদিস আমরা পাচ্ছি না। আমাদের চোখ ফাঁকি দিচ্ছে। এবার আবার উঠে ভাল করে খুঁজতে হবে। এবার চার জন আলাদা আলাদা হয়ে খুঁজ কোথায় সেই পায়ে চলা ট্রেইল। আবার হাঁটা শুরু ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে। যা খেজুর ছিল একটা দুইটা করে খেয়ে নিলাম সাথে ঝর্ণার পানি।
সবাই আমাকে হেল্প করেছে।
তিনজনের দলটা না আসায় আমরা আবার উঠে গেলাম। নতুন উদ্যোমে সেই পাহাড়ে উঠার পথটা খুঁজে আমাদের বের করতেই হবে ইনশা আল্লাহ। চলতে থাকলাম। যাওয়া-আসার পথে ডুমুরের মতো দেখতে বিশাল যে ফল গুলো পরে থাকতে দেখলাম তার কয়েকটি ছবি তুললাম। জানি না এটা কি ফল। দেখতে অবিকল ডুমুর কিন্তু সাইজ বিশাল এক একটার। এগিয়ে গিয়ে এবার ছড়ার ডানেবামের পাহাড়ী পাথরের ফাটলের গা ছোট ছোট ধারা বেয়ে আসছে সেদিকে উঠে একটার পর একটা পথ খুজতে থাকলাম। এগুলো এতোই চিপা যে এক সাথে একজনের বেশি উঠা যায় না! কিন্তু উপরে গিয়ে দেখা যায় কোন রাস্তা নাই!!
আর কতো এবারের মতো ফেরার পালা।
কয়েকটাতে এমন খোঁজাখুজির পর হতাশ হয়ে আমরা আবার আগের জায়গায় ফিরে এসে অপেক্ষা করতে থাকলাম তিনজনের দলের। কিন্তু তাদের দেখা নাই! তবে আমাদের পিছনের পাহাড়ের ওপাশে মানুষের কন্ঠ পেয়ে আমরা তাদের আসার অপেক্ষায় থাকলাম। সময় বয়ে যায় কেউ আর আসে না! শুধু কথা শোনা যায়!! হঠাৎ এক সময় আমাদের পিছনে হো হো হো হাসির শব্দে ফিরে তাকালাম! দেখি সেই তিনজনের দলের একজন! আমাদের দেখে হাসছে বিকট শব্দে অবিরাম!! মানে তারাও আমাদের কথার আওয়াজ পেয়ে পাহাড়ের ওপাশে অপেক্ষা করছে আর আমরাও তাদের কথার আওয়াজ পেয়ে এপাশে অপেক্ষা করছি। দুই দলই বিশ্রামরত!!!
বিশাল বিশাল আপেল সাইজ সেই ডুমুর ফল।
তাদের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম তারা এখানে আরো বেশ কিছু সময় কাটাতে চায় কিন্তু আমাদের ফেরার পালা। তাই পথ খুজছি। তারাও পথ চিনে না। তাদের পরিকল্পনাও আমাদের বলছে না। অতএব আমরা শেষ বারের মতো আবার একবার খুঁজে দেখতে চাই আল্লাহর নামে। আবার চলা শুরু করলাম। কিছু্দূর যেতেই ডান পাশের পাহাড় হতে কাঠ কাঠার শব্দ পেলাম। থেমে সে লোকটাকে ডাকতে থাকলাম। এক সময় সে আমাদের ডাকে সারা দিয়ে পাহাড়ের জঙ্গল হতে বের হয়ে নিচে নেমে এল। তাকে সেই পাহাড়ী পায়ে চলা ট্রেইলের কথা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি দেখিয়ে দিতে রাজী হলেন। লোকটি আমাদের নিয়ে চলতে থাকলেন। ঝর্ণার কাছাকাছি গিয়ে হাতের বামে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সরু পায়ে চলা একটা পথ উঠে গেছে! আর এইটা খুঁজতেই কি না আমরা গলদঘর্ম!!
এই সেই পয়ে চলা পাহাড়ী পথ যেটা আমরা খুজেছি এতবার!
লোকটিকে বিদায় দিতে চাইলাম। তিনি বললেন আরো উপরে দেখিয়ে আসতে হবে তাছাড়া আমরা পথ হারাব! তিনি আগে আগে উঠতে থাকলেন আর আমরা পিছে পিছে। ঝর্ণার উপরে উঠে একটু বরাবর আর একটু উপরে উঠে তিনি রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। তাকে খুশি হয়ে ভাংতি চল্লিশ টাকা দিলাম। এবার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আমরা চারজনে উঠছি। মোটামুটি এক জায়গায় উঠে ভাবলাম এটাই শেষ। সামনে পশ্চিম দিকে পায়ে চলা পথ গেছে দেখা যাচ্ছে। সবাই হাপিয়ে উঠেছি একটু বিশ্রাম নিয়ে সেই পায়ে চলা পথে চলতে থাকলাম। কিন্তু সামনে গিয়ে দেখা গেল পথ দুভা্গ হয়ে গেছে এবং দু্ইটা পথই জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেছে! সামনে আর কোন পথ নাই! আতাউল্লাহ ভাই বললেন আমাদের সম্ভবত কোথাও ভুল হয়েছে। আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে একটা পথ পাহাড়ের আরো উপরের দিকে উঠে গেছে। আমরা ফিরে এসে আবার সেই পথে উঠতে থাকলাম।
এত উঁচুতে উঠে সবাই ধপ করে বসে পড়ল।
আমি সবার আগেই সেই পথে উঠে পেয়ে গেলাম আমাদের কাঙ্খিত সেই পায়ে হাটার পথ। এবার ক্লান্তি ভুলে মনের আনন্দে হাটা দিলাম। বেশ কিছু পথ হাটার পর দেখলাম বামের পাহাড় হতে পানি পড়ছে চুয়ে চুয়ে বেশ পরিস্কার। সবাই বোতলে করে খেয়ে নিলাম বেশ। আরো সামনে আসার পর দেখলাম কয়েকজন ছেলে পাহাড়ী আমলকি পেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিনে নিলাম খানিকটা । ক্ষুধায় সবাই মুড়ির মতো খাওয়া শুরু করল।
বার বার বলেছিলাম কেডস না পরে ট্রেকিং সেন্ডেল পরে নিতে। আমার কথা ভাল লাগে নাই! তাই জুতা হাতে!!!
বের হওয়ার পথে আনিস ভাই।
আঁকাবাকা এই পথের একদিকে পাহাড় অন্যদিকে গভীর গিরিখাদ। পথে একজায়গায় থামলাম ছবি তোলার জন্য। আমরা ছবি তুলছি হঠাৎ আনিস ভাইয়ের পিছনের জঙ্গল হতে একটা পাহাড়ী বন মুরগী কক কক শব্দ করে পাখা ঝাপটে ছুটে গেল আরো গভীর জঙ্গলের দিকে। আজ জীবনে প্রথম বন মুরগী দেখলাম জঙ্গলে এত কাছ থেকে। একেবারে ক্লিয়ার।
পাহাড়ের শরীর কেটে রাস্তা আর পিছনে গভীর গিরিখাদ।
ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরে আমরা চলছি। এভাবে কেউ অনেক এগিয়ে গেল কেউ বা পিছিয়ে পড়ল। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে দুপুরের খাবার সকালের নাস্তা কোনটাই হয় নি এখনও। জোহরের সালাত আদায় করতে হবে। এভাবেই এক সময় মেইন সড়কে চলে এলাম সি এন জি একটা নিয়ে সোজা সীতাকুন্ড। গিয়ে একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে একটা মসজিদে গিয়ে জোহর সালাত আদায় করে। ঢাকায় ফেরার বাস কাউন্টারে।
-
যেভাবে যাবেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের বাসে বড় দারগার হাট
নেমে উত্তর দিকে (ঢাকা মূখী) আসতে হবে ব্রিক ফিল্ড পার হয়ে প্রথম যে রাস্তা হাতের ডানে(পূর্ব দিকে) গেছে সেটা ধরে সোজা যেতে হবে প্রথমে পড়বে ঝিরিপথ, ঝিরিপথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৯১৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর ছবিগুলোর সাথে অদ্ভুত ভালোলাগা আর আবেগ মিশানো লিখাটি পড়ে ভীষণ ভালো লাগলো। সেইসাথে গাছে উঠে পাকা ডুমুর খাওয়ার ছোটবেলার দৃশ্য ভেসে উঠলো স্মৃতির ক্যানভাসে।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আসলে ডুমুরের মতোই দেখতে এত বড় এটা কি ফল জানি না ভাইয়া। হতে পারে পাহাড়ী ডুমুর।
যেকোন পর্যটন স্পট এই নোংরা করে রাখা কিছু মানুষ মনে করে এটা তাদের অধিকার। ফল টা কি চিনলাম না।
মন্তব্য করতে লগইন করুন