কমলদহ ঝর্ণাগুলো।
লিখেছেন লিখেছেন নেহায়েৎ ১৯ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:৩৫:৩৮ দুপুর
হাটা শুরু পাহাড়ের পানে।
সীতাকুন্ড-মিরসরাইয়ের বেশ কিছু ঝর্ণা দেখা হলেও বড় কমলদহের মতো বিখ্যাত ঝর্ণাগুলোয় এখনও যাওয়া হয় নি! এটা কেমন কথা! হঠাৎ প্রস্তাব দিলাম। তাৎক্ষণিক সবাই রাজী। আনিস ভাই টিকেট করে ফেললেন হানিফের। আমি, আনিস ভাই, আতাউল্লাহ ভাই আর আল আমীন ভাই মোট চারজন হলাম। বাকীরা আপতোত যেতে পারছেন না।
শুরু হল ঝিরিপথ প্যান্টতো গুটাতেই হবে!
২৯শে সেপ্টেম্বর গাড়ীতে উঠে বসলাম রাত ১১টার একটু পর। ঢাকা শহর পাড়ি দিয়ে মেঘনা ব্রীজে গিয়ে পড়লাম জ্যামে! কোন রকম জ্যাম পার হয়ে চলতে থাকলাম। ভাবতেছিলাম লেট হয়ে যাবে কি না! আল্লাহর রহমতে সাড়ে পাঁচটার গাড়ী আমাদের নামিয়ে দিল বড় কমলদহ। রাস্তার ওপারে গিয়ে একটা মসজিদে জামাত করে ফজরের সালাত আদায় করে পোষাক চেঞ্জ করে সবাই তৈরী হয়ে নিলাম।
পানি পথে এভাবেই।
রাস্তা পার হয়ে পূর্ব পাশে গিয়ে ব্যাগ হতে প্রিন্ট করা কাগজ বের করে লোকেশন মিলিয়ে নিয়ে হাটা শুরু করলাম বড় কমলদহ হতে(উত্তর দিকে) ঢাকা মূখী হয়ে। প্রথমে ব্রিক ফিল্ড পার হয়ে প্রথম রাস্তায় সোজা পূর্ব দিকে। দু্ই পাশে বাড়িঘর,গাছপালা, দুই/একটি দোকান পার হয়ে ক্ষেতের মধ্য দিয়ে রাস্তা। সামনে বিস্তৃত পাহাড় সারি আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওখানেই যাচ্ছি আমরা। ওই পাহাড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেকগুলো ঝর্ণা। আমরা সেসব খুঁজে খুঁজে বের করব।
এই ঝিরিপথের পরেই শুরু পাহাড়।
ক্ষেত পার হয়ে আমরা পড়লাম ঝিরিপথে। এই ঝিরি ধরেই আমাদের হাটতে হবে। লোকেশন তাই বলে। ঝিরিতে পানি একেবারে কম না। আমরা প্যান্ট গুটিয়ে নিয়ে হাটা শুরু করলাম। কিছুদূর হাটার পরই পেলাম প্রথম ঝর্ণাটা! পাথুরে পাহাড়ের পিচ্ছিল গা বেয়ে নেমে আসছে পানির ধারা। গত কয়েক দিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে বেশ পানি আছে এখন ঝর্ণাতে। এখানে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা উপরে উঠার কথা ভাবতে লাগলাম। লোকেশন বলছে এই ঝর্ণা ধরেই উপরে উঠতে হবে। এর পরে আছে এই ছড়ার অনেকগুলো ডাল-পালা, শাখা-প্রশাখা। আর প্রতিটি শাখাতেই ষ্টেপ বাই ষ্টেপ আছে কয়েকটি করে ঝর্ণা।
প্রথমটাতেই ধাক্কা খেলাম। এই রাস্তায় উপরে উঠা আমার পক্ষে সম্ভব না! এই পাথুরে পিচ্ছিল খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে গেলে জীবনের ঝুঁকি আছে! কমপক্ষে হাত-পা আস্ত থাকবে না সে ব্যাপারে গ্যারান্টি দেওয়া যায়। আমরা বসে বসে পরিকল্পনা করছি কি করা যায়। বাকী ঝর্ণাগুলো না দেখেই কি ফিরে যাব! এমন সময় আরো একটি কাফেলা আসল তিনজনের। তারাও আমাদের মতোই একই পথের পথিক। এসেছেন ঢাকা থেকে। দল বড় হওয়াতে আমরাও সাহস পেলাম। এখন আমরা সাত জন।
এটাই প্রথম ঝর্ণা উপরে উঠেছি।
এরই মধ্যে আমাদের আতাউল্লাহ ভাইকে খুঁজে পাচ্ছি না! তাকে ডাকাডাকি করে জবাব পেলাম ডানপাশে পাহাড়ের উপর জঙ্গলের ভিতর থেকে! উনি গাছের শিকর-বাকড় ধরে উপরে উঠে জঙ্গলের ভিতর চলে গেছেন। এবার আমাদের উঠতে বলছেন। আমরা একে একে উঠা শুরু করলাম। ভয়ংকর এক অভিযান! কাটা হাতে লেগে আমরা হাতে কয়েক জায়গায় রক্ত বের হয়ে গেল। এখন জোঁকে ধরলেও কিছু করার নাই। ছাড়াবার সুযোগ নাই। বহু কষ্টে উপরে উঠে আবার ঢাল বেয়ে ঝর্ণার উপরের ছড়ায় নামলাম।উপর থেকে চেয়ে দেখলাম কিভাবে পানি পড়ছে নিচের বেসিনে। সেখানে জমা হয়ে আবার সমতলের ঝিরি ধরে বয়ে চলছে।এখানে সেখানে ট্রেকারদের ফেলে যাওয়া খালি বোতল চিপস চানাচুরের প্যাকেটগুলো কুড়িয়ে আমি পলিথিনে ভরে নিলাম।
প্রথম ঝর্ণার উপরে উঠে ভাব নিয়ে একটা ছবি তুললাম।
শরীর-হাত-পায়ের কাঁদা-ময়লা ধুয়ে হালকা বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার চলা শুরু করলাম ছড়া ধরে। এখন শুধু পাথর বা পাথুরে মাটির রাস্তা। দুপাশে উচু পাহাড়ে গহীন জঙ্গল! ঝিরিপথে মাঝে মাঝে তৈরী হয়েছে পাহাড় থেকে নেমে আসা ডালাপালার ছাউনি! অসম্ভব সুন্দর এই রাস্তা ধরে চলা যায় যেন যুগ যুগ ধরে! আমরা সাতজনে চলছি। আমাদের টাগের্ট আজ বড় কমলদহের সবগুলো ঝর্ণার সন্ধান করা। এই মেইন ঝিরি পথে ডানে-বামে বেশ কয়েকটি শাখা আছে। আমরা প্রথমে বামের শাখাগুলো শেষ করব একেবারে শেষ মাথা পর্যন্ত।
আবার চলা শুরু।
বেশ কিছু পথ চলার পর আমরা প্রথম বামের শাখা ঝিরিপথ পেলাম। এবার প্রধান ঝিরিপথ ছেড়ে বামের শাখাঝিরি ধরলাম। মাঝে মাঝ মনে হতে পারে এই বুঝি রাস্তা শেষ আর কোন পথ নাই! খুব দূর্গম পথ। কিন্তু এসব পার হয়েই আমরা চলতেই থাকলাম। কোথাও পানি বেশ গভীর যারা সাঁতার জানেন না তাদের খুব সাবধানে চলতে হবে। হাতে লাঠি থাকলে ভাল হতো। তবে আমরা লাঠি জোগাড় করতে না পারলেও আনিস ভাই কোথা থেকে একটা লম্বা গাছের ডাল সংগ্রহ করেছেন। সেটা বেশ কাজে দিচ্ছে।
পথ চলতে চোখে পড়বে ছোট খাট এমন অনেক ঝর্ণা।
এক সময় আমরা পৌছে গেলাম শেষ মাথায়।যেখানে উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে ছন্দলয়ে ঝরে পড়ছে ঝর্ণার পানি। আমরা কিছু ছবি তুলে খুঁজে দেখার চেষ্টা করলাম উপরে উঠার কোন পথ পাওয়া যায় কি না। আমাদের সাথের এক ভাই(নাম মনে নাই) উনি বাম দিকের পাহাড় বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করে ফিরে এলেন! কোন রাস্তা নাই। হতে পারে এটা শেষ। যারা এই পথে ট্রেকিং করেছেন তারা ভাল বলতে পারবেন। আমাদের হাতে সময় কম আজকের মধ্যে সবগুলো শেষ করার ইচ্ছে, তাই অন্য ঝর্ণার উদ্দেশ্যে ফিরতি পথ ধরলাম।
এমন অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
আবার আগের প্রধান ঝিরিপথে ফিরে এসে সোজা সামনের দিকে চলতে থাকলাম। কিছু দূর চলার পর আবার একটা বামের শাখা ঝিরিপথ পেলাম। সেটা ধরে চলা শুরু করলাম। কোন কোন পথ অনেক বেশি দূর্গম। কোথাও গাছ উপ্রে বা ডালপালা পড়ে মনে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে! কিন্তু কষ্ট করে সেসব পার হতে পারলেই আবার ঝিরিপথ পাওয়া যায়! এই ঝিরিপথের শেষের ঝর্ণাটাও দেখে আমরা ফিরতি পথে প্রধান ঝর্ণায় ফিরে সামনে চলতে থাকলাম। আমরা রওয়ানা করেছি সকাল ছয়টার একটু আগে। এখন বাজছে প্রায় সাড়ে ৮টার মতো। তার মানে আমরা এরই মধ্যে প্রায় আড়াই বেশি সময় ট্রেকিং করেছি।
এমন অনেক জায়গা পেরিয়ে যেতে হবে কোন সন্দেহ নাই।
আমরা সাথে নাস্তা আনি নাই! নাস্তা করেও আসি নাই! সবাই একটু একটু ক্ষুধা অনুভব করছি।শেষ খাবার খেয়েছি আমরা দুইটা করে পরোটা কুমিল্লায় হোটেল বিরতিতে রাত সাড়ে তিনটার দিকে। পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তায় চলা অনেক পরিশ্রমের কাজ। রোমাঞ্চকর পরিবেশ, রাস্তার সৌন্দর্য আর এক ধরণের থ্রিলের মধ্যে থাকায় এতক্ষণ কেউ ক্ষুধার কথা বলছে না।আমি ব্যাগ হতে সবাইকে এক প্যাকেট করে লেক্সাস বিস্কুট বের করে দিলাম। আর সাথে আছে অল্প কিছু শুকনো খেজুর, কয়েকটি চকলেট।এটা লোকালয় থেকে বহু দূরে একটা জায়গা।এই জঙ্গলে কোন দোকান বা কোন ধরণের খাবার পাওয়ার আশা নাই।এমনকি কেউ বিপদে পড়লে দেখার মতো বা চিৎকার শোনার মতো কেউ নাই! পানি নিয়ে ভাবছি না। আজ সারাদিন ঝর্ণার পানিতেই চলে যাবে আমাদের। কিন্তু খাবারতো দরকার।
ছায়া ঢাকা গ ছম ছম করা এমন পথে যেতেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়।
একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা একে একে বামের ঝর্ণাগুলো দেখা শেষ করে প্রধান ঝিরিপথ ধরে সেই ঝর্ণার উদ্দেশ্যে চলতে থাকলাম। এটাতে যেতে এক জায়গায় উচু পাহাড়ের পাথুরে শরীর কেটে কোন রকম পায়ের আঙ্গুল রাখার জায়গায় করা হয়েছে! ভয়ংকর এই পথে আমাদের উঠতে হবে! আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। আমার আগে দুইএকজন উঠার পর আমি শুরু করলাম! মনে মনে আল্লাহকে ডেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উঠে গেলাম উপরে!! ডান-বাম আঁকাবাকা করে কিছু পথ চলার পর আমরা মূল ঝর্ণায় পৌছে গেলাম। ঝর্ণার পানিতে মুখহাত ধুয়ে বিশ্রাম নিলাম সবাই। এখানে দুইএকদিনের মধ্যে কারা যেন এসেছিল। রাতে ক্যাম্প করেছিল। ক্যাম্পফায়ার এর ছাই আধপোড়া ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! পরে আছে পানির খালি বোতল চিপস-চানাচুর এর প্যাকেট। আমি সেগুলো কুড়িয়ে একটি পলিথিনে ভরে নিলাম। এখানেও আমরা উপরে উঠার পথ খুঁজলাম কিন্তু না পেয়ে আবার ফিরতি পথ ধরলাম।
ট্রেকিংয়ের পথটা যদি এমন না হয় মজা নাই।
আমাদের সাথের তিনজনের দলটা একটু আগেই রওয়ানা করেছিল। পথে এক জায়গায় দেখি তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেখান থেকে একটা পায়ে চলা পথ পাহাড়ের উপরের দিকে জঙ্গলের ভিতর চলে গেছে। আমাদের ধারণা এটা মানুষের চলার পথ। হয়তো এটা কোন লোকালয়ে যেতে পারে। আমরা বিদায় নিয়ে এই পথে উঠতে থাকলাম। তিনজনের দলটা চলে গেল অন্য ঝর্ণা গুলোর উদ্দেশ্যে।
মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিতেই হবে।
কিছু দূর উঠার পর আমি আর আনিস ভাই অপেক্ষা করে আতাউল্লাহ ভাই আর আল আমীন ভাইকে পাঠালাম আরো উপরের দিকে কোন রাস্তা আছে কি না দেখার জন্য। তারা অনেক খানি উপরে উঠে আর রাস্তা না পেয়ে নিচে নেমে এল। মাঝখান থেকে কিছু জোঁকের কামড় খাওয়া হল শুধু! পা হতে জোঁক খুলে সবাই প্যান্ট উঠিয়ে চেক করে দেখে আবার চলা শুরু। আমরা নিচে নেমে পূনরায় ঝিরি পথে হাটতে থাকলাম এবার মূল ঝিরির ডানদিকের শাখা-প্রশাখাগুলোর ঝর্ণ বের করব।
পথে এভাবেই উঠতে হবে অনেকগুলো জয়গায়।
আসার পথের ডান দিকের ঝর্ণাগুলো ফেরার পথে পড়ছে হাতের বাম দিকে। তাই আমাদের আবার প্রথমটা হাতের বামদিকের শাখা ঝিরিপথে প্রবেশ মুখে এসে থামলাম। ভাবছি কি করব! এখন বাজে প্রায় সাড়ে দশটার মতো। পেটে খিদে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সবাইকে তিনটা করে খেজুর দিলাম। খেজুর আর পানি খেয়ে বসলাম বিশ্রাম নিতে। সকাল থেকে আকাশ মেঘাছন্ন। মাঝে মাঝে হালকা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। গরম খুব বেশি না তবুও সবাই ঘেমে গেছি। আমি মাঝ মাঝে ছাতা বের করে ধরেছি। সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার উঠে হাতের বামের ঝিরিপথ ধরে হাটা দিলাম।
কোন কোন ঝিরিপথের শেষ মাথায় পাবেন এমন এমন ঝর্ণা। তখন কষ্ট শেষ!
এই পথটা হালকা অন্ধকারাচ্ছন্ন। গাছপালা দুদিক থেকে নেমে এসে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। আমার আসার ইচ্ছা ছিল না। কেমন গা ছম ছম করছে। একেবারেই নিস্তবদ্ধ পরিবেশ। পাখির ডাকও শোনা যায় না খুব একটা অন্য ট্রেইলে আমরা বেশ পাখির ডাক শুনেছি, মাঝে মাঝে দুইএকটা বক চোখে পড়েছে! মাঝে মাঝে দুইএকটি ঝিঝি পোঁকার ডাক শোনা যায়। আমরা হাটছি খুব সাবধানে মাঝে মাঝে পাথুরে পথে শেওলা জমে বেশ পিচ্ছিল হয়েছে। কোথাও কোথাও বেশ বড় বড় পাথরের উপর দিয়ে পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আনিস ভাই পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন। আল আমীন ভাই দুই একবার পিচ্ছিল খেয়ে ব্যাথা পেয়েছেন। আমাদের সাথে পেইন কিলার নাই। দুজনে এ্যংলেট পড়ে নিয়েছেন। এভাবেই আমাদের চলতে হচ্ছে।
সবুজ শ্যামল সে পথ।
(পরের পর্বে শেষ)
বিষয়: বিবিধ
১৯৬২ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ছবিগুলির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
সুন্দর ছবিগুলোর সাথে বেশ উপভোগ্য ভ্রমণ কাহিনী বেশ ভালো লাগলো মাশাআল্লাহ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন